তখন ব্রিটেনের গ্রীষ্ম বাতাসে উইলোর গান। অক্সফোর্ড বনাম কেমব্রিজ ‘ব্লু’ ম্যাচে, আভিজাত্য এবং প্রতিভার মিশেল এক রং, যার দিকে তাকিয়ে থাকতেন বাঘা বাঘা কাউন্টির কর্তারা। ষাটের দশকের গোড়ায় অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব মাঠ ‘পার্কস’-এ যদি আপনি রান পেয়ে থাকেন, তা হলে ইংল্যান্ডের ক্রিকেট কর্তাদের নজরে পড়বেনই।
এ হেন পার্কসে দুর্দান্ত ফ্রেডি ট্রুম্যানকে সামলে সাসেক্সের হয়ে ইয়র্কশায়ারের বিরুদ্ধে দাপুটে ১০৬ রান করে তখন আলোচনার কেন্দ্রে মনসুর আলি খান পটৌডি বা টাইগার পটৌডি। শুধু ব্রিটেন নয়, দেশেও তাঁকে নিয়ে কম আলোচনা হত না সেই ১৯৬১ সালে। কারণ এই ট্রুম্যানই তো তার ন’বছর আগের টেস্ট সিরিজ়ে শূন্য রানে চার উইকেটের লজ্জাজনক ইতিহাস রচনা করেছিলেন ভারতের বিরুদ্ধে। চারটি উইকেটই তুলেছিলেন তিনি। ফলে সেই দশকবাহিত ক্ষতে মলম লাগানোর কাজটিও করেছিল যুবক পটৌডির ওই উদ্ধত ১০৬।
উদযাপনের আরও কারণ ছিল। ইউনিভার্সিটি ক্রিকেটে এক মরসুমে সর্বোচ্চ ১৩০৭ রানের রেকর্ড থেকে মাত্র বিরানব্বই রান দূরে মনসুর আলি। তখনও বাকি তিনটি ম্যাচ। ফলে রেকর্ড নেহাতই দোরগোড়ায়। জুলাইয়ের ১ তারিখে শুরু হওয়া ম্যাচে অক্সফোর্ড মাত্র ৪ রানে হারিয়েছে দু’জন ওপেনারকে। পরের দিন মনসুর মুখোমুখি হবেন কার্যত নতুন বলের। চাপ কাটাতে রাতে কয়েক জন খেলোয়াড় বন্ধুর সঙ্গে গেলেন ডিনারে। যাওয়ার সময়ে রবিন ওয়াটার্স তাঁর মরিস ১০০০-এ চড়িয়ে সবাইকে নিয়ে গেলেন। ফেরার সময়ে কেউ কেউ বললেন, আর গাড়ি নয় হেঁটেই ফেরা যাক। খাবারটাও দিব্যি হজম হবে। ওয়াটার্সকে সঙ্গীহীন ভাবে একা ড্রাইভ করে ফিরতে হবে দেখে অগত্যা তাঁর পাশে গিয়ে বসলেন পটৌডি। আর মুচকি হাসল নিয়তি।
স্ত্রী শর্মিলার সঙ্গে একান্তে
তাঁরা তখনও পার্কিংয়ে, হঠাৎ করে একটা যাত্রীসমেত গাড়ি এসে তাঁদের ধাক্কা মারে। টাইগার উইন্ডস্ক্রিন ভেঙে ছিটকে পড়েন বাইরে। তখনও বেল্ট বাঁধার সময়টুকু পাননি। সকলে কেঁপে উঠল। তবে তখন দেখা গেল যে, ক্ষতি সামান্যই হয়েছে টাইগারের ডান হাতে। তাঁর নিজের ধারণা হয় কব্জি ভেঙেছে, আর পরের দিন ব্যাট করতে পারবেন না। অনেক পরে ব্রাইটন হসপিটালে গিয়ে দেখা যায়, টাইগারের ডান চোখে সরু কাচ ঢুকে আছে। জরুরি ভিত্তিতে সার্জারি করেও সেই চোখ বাঁচানো গেল না। মাত্র পাঁচ শতাংশ দৃষ্টি পড়ে থাকল ওই চোখে।
কন্যা সোহা আলি খানের কথায়, “ভাবতে পারা যায়, একটা মাত্র চোখ নিয়ে কোনও খেলায় অংশ নেওয়া কী ভয়ঙ্কর কঠিন? বাড়িতে চেষ্টা করে দেখুন, হাত দিয়ে এক চোখ ঢেকে গ্লাসে জল ভরতে। ব্যাপারটা আদৌ সহজ নয়। দূরত্বের মাপ বোঝার জন্য দুটো চোখই জরুরি। আর গ্লাস তো নেহাতই একটা স্থির বস্তু। এ বার কল্পনা করুন, ওই ভাবে ক্রিজ়ে দাঁড়িয়ে আছেন আর ঘণ্টায় ২০০ কিলোমিটার গতিতে বল করছেন অ্যান্ডি রবার্টস!”
দুই
একটু পিছনে ফিরে চোখ রাখা যাক এই নবাব বংশে। পটৌডি যে কোনও ব্যক্তি নন, বরং একটি জায়গার নাম, সেটাই এখনও জানেন না অনেকেই! পটৌডি হরিয়ানার একটি জনপদ, যেখানে সাকুল্যে পঁচিশ হাজার মানুষের বসবাস। ১৮০৪ সাল থেকে এখানে নবাবের শাসন। সে সময়ে এই নবাবির প্রবর্তন করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। দ্বিতীয় ইঙ্গ-মরাঠা যুদ্ধে মরাঠা সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে সাহায্য করার জন্য ফৈয়াজ় তালাব খানকে এই সম্পত্তি উপহার দেওয়া হয়েছিল।
অষ্টম নবাব ইফতিকার আলি খান পটৌডি ছিলেন মনসুরের পিতা এবং রাজকীয় এক ব্যাটসম্যান। ইংল্যান্ড ও ভারতের হয়ে ক্রিকেট খেলার জন্যই ইনি বেশি পরিচিত, পরে ভারতীয় ক্রিকেট দলের অধিনায়কও হন। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বেলিয়র কলেজে (যেখানে সত্তর বছর পরে পড়তে যান তাঁর নাতনি সোহা আলি খানও) হকি এবং ক্রিকেট ব্লু ছিলেন তিনি। সর্বোচ্চ স্তরে প্রতিযোগিতায় কৃতিত্ব অর্জনের জন্য অক্সফোর্ড, কেমব্রিজ এবং অন্যান্য কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে এই খেতাব দেওয়া হত।
১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ রাজের অবসান হলে, পটৌডি ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের অঙ্গ হয়ে ওঠে। দেশভাগের পর পরিবারের অনেকেই পাকিস্তানে চলে গেলেও ইফতিকার আলি কিন্তু ভারত ছাড়েননি। তাঁর পরিবারের অনেক সদস্য, এমনকি নিজের ছোট ভাই শের আলি খান পটৌডি, তুতো ভাই শাহাজাদা ইয়াকুব আলি খান দেশভাগের পরে পাকিস্তানকে বেছে নেন দেশ হিসেবে। মেধাবী পণ্ডিত এবং মুসলিম অভিজাততন্ত্রের এক গণ্যমান্য ব্যক্তিত্ব হিসেবে খুব সহজেই ইফতিকার সে দেশের সরকারে উঁচু পদ পেয়ে যেতে পারতেন। কিন্তু তিনি থেকে গেলেন ভারতে, চূড়ান্ত টানাপড়েনের সময়ে। তাঁর সাম্রাজ্য ছেড়ে দিতে হল বছরে ৪৮,০০০ টাকার প্রিভি পার্সের বিনিময়ে। ইফতিকার তাঁর ছেলে মনসুর আলিকে জানিয়েছিলেন যে, পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনের ভাবনাতেই তিনি বিশ্বাসী ছিলেন না। তাই স্থির করেন, নতুন তৈরি হওয়া রাষ্ট্র ভারতের সঙ্গেই থাকবেন, গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ উদার ধারণার সঙ্গে হাত মিলিয়ে।
তিন
উদারতা শুধুমাত্র রাজনৈতিক বা জাতীয় চিন্তাতেই নয়, টাইগার পটৌডির বাবা ইফতিকার ব্যক্তিগত জীবনেও ছিলেন খোলা মনের, যাঁর রক্ত আজীবন বয়েছে পুত্রের ধমনীতেও। ইফতিকারের স্ত্রী অর্থাৎ টাইগারের মা সাজদা সুলতান ছিলেন নবাব হামিদুল্লা খানের দ্বিতীয় সন্তান। ভোপালের শেষ নবাব ছিলেন হামিদুল্লা। যেহেতু পুরুষ উত্তরাধিকারী ছিল না তাঁর, তাই সাজদার বড় বোন আবিদা সুলতানেরই কথা ছিল নবাবের সিংহাসনে বসার। কিন্তু দেশভাগের পর আবিদা চাইলেন পাকিস্তানে চলে যেতে। স্বত্ব দিয়ে গেলেন তাঁর ছোট বোন সাজদাকে।
১৯৬০ সালে যখন হামিদুল্লা খান প্রয়াত হলেন, তখন ভারত সরকার সাজদাকে ভোপালের বেগমের স্বীকৃতি দিল। হায়দরাবাদের পর ভোপাল দেশের নবাবশাসিত দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম জনসংখ্যার স্টেট। জনসংখ্যা ১০ লাখ এবং ১৯টি গান স্যালুট সংবলিত। তুলনায় পটৌডি অল্প কিছু গ্রামের সন্নিবেশ। গান স্যালুটের কোনও ব্যাপারই নেই। শোনা যায়, যখন নবাব হামিদুল্লা জানতে পারেন সাজদা-ইফতিকারের প্রেমের কথা এবং তাঁরা বিবাহ করবেন বলে স্থির করেছেন, তিনি খুব একটা খুশি হননি। দুই ‘অসম’ পাত্রপাত্রীর মধ্যে এই পরিণয় প্রস্তাবে অসম্মতিই জানিয়েছিলেন। তবে বাড়ির মহিলাতন্ত্রের চাপে শেষ পর্যন্ত হামিদুল্লা সম্মতি দেন।
তবে বৈভব নয়, অনেকের সন্দেহ, তাঁর এই অনিচ্ছার মূল কারণটা ছিল স্পোর্টসম্যান সুলভ ঈর্ষা। নবাব হামিদুল্লা ছিলেন ‘নাইন গোল হ্যান্ডিক্যাপ’ পোলো প্লেয়ার। মাইনাস টু থেকে টেন পর্যন্ত রেটিং হয় পোলো খেলোয়াড়দের। মাইনাস টু হল একেবারে নতুনদের র্যাঙ্ক। টেন হল সর্বোচ্চ দক্ষতার নিদর্শন। আধুনিক বিশ্বে টেন হ্যান্ডিক্যাপে পোলো খেলোয়াড়ের সংখ্যা দু’ ডজনও হবে না। তাঁরা প্রায় সবাই আর্জেন্টিনার। হামিদুল্লা খান ভাল কুস্তিগিরও ছিলেন। কিন্তু ইফতিকার অর্থাৎ টাইগারের বাবা পুরো আলোটাই কেড়ে নিয়েছিলেন। তিনি পোলো, হকি, ক্রিকেট-সহ অন্যান্য সব খেলাতেই ছিলেন পারদর্শী। ১৯৩৯ সালের এপ্রিলে একে অন্যের প্রেমে হাবুডুবু এই জুটি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। কার্যত সেই থেকেই পটৌডি পরিবারের একটি শক্তপোক্ত ঐতিহ্য গড়ে ওঠে। তা হল একমাত্র নিখাদ প্রেমই হোক বিবাহের এক এবং একমাত্র শর্ত। টাইগারও সেই ঐতিহ্যকেই ধরে রাখলেন ১৯৬৯ সালে একজন হিন্দু অভিনেত্রীকে বিয়ে করে।
মাত্র ৪২ বছর বয়সে ইফতিকার আলি খান মারা যান। দিনটা ছিল ১৯৫২ সালের ৫ জানুয়ারি। তারিখটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ, সেটি ছিল টাইগারের এগারোতম জন্মদিন। বাড়িতে তিনি আর তাঁর স্কুলের বন্ধুরা মিউজ়িক্যাল চেয়ার খেলছিলেন, অপেক্ষা করছিলেন বাবা-মায়ের জন্য। জয়পুর পোলো গ্রাউন্ড থেকে তাঁদের ফেরার কথা ছিল। ঠিক ছিল, তাঁরা এলে কেক কাটা, খাবার পরিবেশন করা হবে। কিন্তু মনসুর আলি খানের বাবা আর ফিরলেন না। বিরাট এক হার্ট অ্যাটাকে চলে গেলেন। পোলো ম্যাচ চলাকালীনই স্তম্ভিত দর্শকের সামনে ঘোড়া থেকে পড়ে গিয়েছিল তাঁর দেহ। দীর্ঘ দিনের চেন স্মোকিংয়ের কারণেই এই দুর্ঘটনা ঘটে। বিয়াল্লিশতম জন্মদিনের মাস খানেক আগে অবশ্য সিগারেট ছেড়েও দিয়েছিলেন তিনি। মনুসরের সে দিনের সেই কেক আর কখনও কাটা হয়নি। পরবর্তী কালে আর একবারই জন্মদিন পালন করেছিলেন টাইগার। সেই প্রসঙ্গে পরে আসা যাবে।
চার
“আমাদের গল্পের মধ্যে আহামরি কিছু তো নেই। দেখা হতে ভাল লেগেছিল প্রথমেই। কয়েক বছর আমরা ডেট করি, বিয়ের আগে। প্রথম দিনের সেই ভাললাগাটা কিন্তু বদলায়নি আর। তার পর যখন স্থির করি যে বিয়ে করব, আমি হিন্দু, ও মুসলমান— এই সব চিন্তাভাবনা মাথায় উঁকিও দেয়নি। ভাগ্যিস আমাদের বয়স তখন এতটাই কম ছিল যে, এ সব নিয়ে ভাবার অবকাশও ছিল না। ষাটের দশকের শেষ দিকে আমাদের বিয়ে হয়,’’ স্মৃতিচারণা করছেন শর্মিলা ঠাকুর।
পটৌডি এবং শর্মিলা দু’জনেই ছিলেন স্বতঃস্ফূর্ত এবং আবেগপ্রবণ। তাঁদের প্রেমও ছিল ছকে বাঁধা একঘেয়েমির বাইরে। বিয়ের পরেও। সেফের জন্মের পরে ধীরে ধীরে সেই উদ্দামতা থিতু হয়। শর্মিলা জানাচ্ছেন, “একবার নভি মুম্বইয়ের কাছে পানভেলে শুটিং করছি। টাইগারের আমদাবাদ যাওয়ার কথা। হঠাৎ মনে হল, যাই এয়ারপোর্টে গিয়ে বিদায় জানিয়ে আসি। হাতে তখন বেশি সময় নেই। ড্রাইভারকে বললাম, জলদি চালাও। এয়ারপোর্টের সামনে পৌঁছে দেখি ও সবে গাড়ি থেকে নেমেছে। আমি ‘বাই’ বলতেই ও বলল, ‘তুমি কী করছ এখন? চলো, যাবে নাকি?’ আমিও আর কিছু না ভেবে চললাম। সঙ্গে বাড়তি জামাকাপড় কিছুই ছিল না। এমনই ছিল সে সব দিন। এ রকম অনেক ইমপালসিভ কাজকম্মো করতাম আমরা। কিন্তু সইফু আসার পরে ধীরে ধীরে জীবন শান্ত আর নিয়মমাফিক হয়ে ওঠে।’’
কী ভাবে টাইগার প্রপোজ় করেছিলেন শর্মিলাকে? সেও এক মজার ঘটনা! শর্মিলা জানালেন, প্যারিসে আনুষ্ঠানিক ভাবে প্রপোজ় করার আগেই তাঁর মাকে টাইগার নাকি জানিয়ে দিয়েছিলেন যে, তাঁরা বিয়ে করবেন বলে স্থির করেই ফেলেছেন!
সে সময়ে তাঁদের বিয়ে নিয়ে সামাজিক প্রতিক্রিয়া যে একেবারে হয়নি, এমনটাও নয়। শর্মিলা বলছেন, “কিন্তু আমাদের গায়ে এসে লাগেনি সে সব। খুব একটা পাত্তাও দিইনি। আমরা তখন বম্বেতে। বিয়ের পরে একদিন হঠাৎ ঘুম থেকে উঠে দেখি, বাইরের ঘরে দু’জন বসে রয়েছে। তাদের পাঠানো হয়েছে দিল্লি থেকে আমাকে সুরক্ষিত রাখার জন্য! আমি তাদের বোঝাতে পারি না যে, আমার কোনও সুরক্ষার দরকার নেই। মনে আছে, বাবা অনেক চিঠি পেতেন এই বিয়ে বন্ধ করার জন্য। টাইগারের ‘বারাত’-এ পাকিস্তান থেকেও অনেক অতিথি এসেছিলেন। সেনাবাহিনীর থেকেও কেউ কেউ এসেছিলেন। তবে কোনও ঝঞ্ঝাট হয়নি। তবে সে যে কত রকমের উপদেশ সে সময়! কাজ বন্ধ কোরো না, কাজ ছেড়ে দাও, বিয়ে কোরো না, না-না, বিয়েটা করেই নাও... মনে আছে, যশ (চোপড়া) কেরিয়ারের ওই পর্যায়ে আমাকে বিয়ে না করারই পরামর্শ দিয়েছিল। আর একজন বলেছিলেন, নবাবরা খুবই উদ্দাম প্রকৃতির হয়। তাদের কোনও দশটা-পাঁচটার জীবন থাকে না। আবার অন্য দিকে সিনেমার অভিনেত্রী সম্পর্কে সাত-সতেরো কথা শুনতে হয়েছিল টাইগারকে! সব মিলিয়ে সবাই ভেবেছিলেন বছর দুয়েকের বেশি টিকবে না এই বিয়ে। কিন্তু আমরা থেকে গেলাম আজীবন, একে অন্যের সঙ্গে!”
শর্মিলা জানাচ্ছেন, টাইগার কোনও দিনই নাক গলাননি তাঁর ফিল্মি কেরিয়ার নিয়ে। খুব যে দেখেছেন তাঁর সিনেমা, এমনটাও নয়। ওঁর প্রিয় নায়িকা ছিল বৈজয়ন্তীমালা এবং মীনাকুমারী। “এক জনপ্রিয় ম্যাগাজ়িনের প্রথম পাতায় পুরস্কার হাতে আমার ছবি দেখে খুবই খুশি হত টাইগার। কিন্তু সঙ্গে এটাও বলত, ‘তবে আমাকে কিন্তু তোমার ছবি দেখতে যেতে বোলো না!’ আসলে আমরা কেউ কারও কেরিয়ারে মাথা গলাইনি। আমি যখন কাজে ডুবে আছি, ও তখন বাচ্চাদের দেখাশোনা করে গিয়েছে নিয়মিত। স্বামী হিসেবে ভীষণ সাপোর্টিভ এবং বুঝদার ছিল টাইগার।’’
দু’জনের প্রেমের সূচনা ১৯৬৫ সালে। দিল্লিতে তখন ফিল্মের শুটিংয়ের জন্য এসেছিলেন শর্মিলা। কয়েক জন বন্ধুর সূত্রে টাইগারের সঙ্গে আলাপ হয় তাঁর। শর্মিলা তখন হিন্দি সিনেমার নামজাদা নায়িকা। পটৌডিও ভারতীয় ক্রিকেট টিমের ক্যাপ্টেন। দু’জনেই নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত, দু’জনেই বিখ্যাত। আর টাইগারের রসবোধ এবং অসম্ভব ভদ্র ব্যবহারে মুগ্ধ হয়েছিলেন শর্মিলা।
তবে চট করে শর্মিলাকে প্রেমপ্রস্তাবে সম্মত করাতে পারেননি পটৌডি। এর জন্য বেশ কাঠখড় পোড়াতে হয়েছিল নবাবকে। নায়িকার মন পেতে তাঁকে নাকি সাতটি রেফ্রিজারেটর পর্যন্ত উপহার দিয়েছিলেন পটৌডি! পরের দিন শর্মিলা ফোন করে টাইগারকে ছদ্ম ধমক দিয়ে বলেন, ‘এটা কী হচ্ছে!’ কিন্তু এ সব সত্ত্বেও চার বছর অপেক্ষা করতে হয়েছিল টাইগারকে। তার পরে বিয়েতে সম্মতি জানান শর্মিলা। ১৯৬৯ সালের ২৭ ডিসেম্বর বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন দু’জনে।
পাঁচ
স্মৃতির রহস্যময় গলি ধরে আবার পিছিয়ে যাওয়া যাক ষাটের দশকের গোড়ায়। সেটা ছিল ১৯৬২ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ়ের ভারত সফর। নরি কন্ট্রাক্টর ছিলেন ভারতের অধিনায়ক। সদ্য চোখ-দুর্ঘটনা থেকে উঠে আসা একুশ বছরের মনসুর আলি খান পটৌডি তখন সহ-অধিনায়ক। আজ আমাদের ক্রিকেটাররা যা পরে খেলেন, সেই হেলমেট, অ্যাবডোমেন গার্ড, থাই গার্ড, চেস্ট গার্ডের যুগ ছিল না সেটা। বল করছিলেন আগুনে ফাস্ট বোলার চার্লি গ্রিফিথ। এই সেই গ্রিফিথ, যাঁর সম্পর্কে পটৌডিরই বলা একটা মজার গল্প রয়েছে। পটৌডি একবার ব্যাট করতে নেমে দেখেন, উইকেটকিপার ক্রিজ়ের থেকে দূরে প্রায় বাউন্ডারির কাছে দাঁড়িয়ে। টাইগার তাঁকে জিজ্ঞেস করেন, ‘‘এখানে দাঁড়িয়ে কী করছ?’’ চোখা উত্তর এসেছিল, ‘একটু পরে নিজেই টের পাবে বাছা!’ চার্লি গ্রিফিথ বল করছিলেন সে সময়।
অনেকের মনে থাকবে, নরি কন্ট্রাক্টরের ক্রিকেট জীবন অনেক আগেই গুটিয়ে গিয়েছিল এই চার্লির জন্য। সেই টেস্টে কন্ট্রাক্টরের মাথায় চার্লির বল লাগে, গোলা ফাটার মতো শব্দ হয়েছিল! টাইগার পরে বলেছিলেন ড্রেসিংরুম থেকেও নাকি তা শোনা গিয়েছিল। বালি দিয়ে পিচ থেকে সেই রক্ত শুষে নিতে হয়েছিল। অনেক সার্জারি করে তাঁর মস্তিষ্ক থেকে জমাট রক্ত বার করা হয় এবং শেষ পর্যন্ত প্রাণে বেঁচে যান কন্ট্রাক্টর। কিন্তু তার পর আর টেস্ট ক্রিকেটে ফিরতে পারেননি নরি। তড়িঘড়ি টাইগারকে অধিনায়কের দায়িত্ব দেওয়া হয়। অনেকের মতে, ওই দায়িত্বের জন্য সেই সময়ে প্রস্তুত ছিলেন না তিনি।
সদ্য দুর্ঘটনা থেকে উঠে আসা মনসুর আলি খান ওই ’৬২-র সিরিজ়ে ওয়েসলি হল বা চার্লি গ্রিফিথের বিরুদ্ধে খুব ভাল রান করতে পারেননি ঠিকই। কিন্তু অনেক পরে ক্লাইভ লয়েডের অধিনায়কত্বে ওয়েস্ট ইন্ডিজ় ভারতে এলে শোধ নেন। প্রথম দুটো ম্যাচ জিতে ওয়েস্ট ইন্ডিজ় তখন সিরিজ়ে এগিয়ে।
১৯৭৪-এর ২৭ ডিসেম্বর কলকাতার ইডেন গার্ডেন্সে তৃতীয় টেস্ট। খেলার গোড়ার দিকেই অ্যান্ডি রবার্টসের বাউন্সার সরাসরি পটৌডির চোয়ালে লাগে। হাড় ভাঙে। মাঠে বসা এক লাখ লোকের আশাও। তবে সহজে ছেড়ে দেওয়ার বান্দা তিনি ছিলেন না। চোয়াল ঠিক করিয়ে উইকেটে ফিরে এসে ভ্যানবার্ন হোল্ডারকে এক ওভারে চারটে বাউন্ডারি হাঁকান। ভারত জেতে ৮৫ রানে। আজও ওই ঐতিহাসিক জয়কে আমাদের টেস্ট বিজয়ের এক মাইলফলক হিসেবে দেখা হয়।
এই প্রসঙ্গে সোহা আলি খানকে তাঁর বাবা একবার বলেছিলেন (যা সোহা লিখেছেন তাঁর বই, ‘দ্য পেরিলস অব বিয়িং মডারেটলি ফেমাস’ বইতে), “আমার এক চোখের দৃষ্টি গিয়েছে ঠিকই, কিন্তু নিজের লক্ষ্য থেকে আমার নজর কখনও সরেনি।” সোহার স্মৃতিচারণ, “আমি বরাবরই ভেবেছি আব্বার কাহিনি লোকে জানুক। লেখা হোক। প্রায়ই জিজ্ঞেস করতাম, আত্মজীবনী লেখার কোনও পরিকল্পনা তাঁর রয়েছে কি না। রহস্যময় গলায় আব্বা বলতেন, ‘সত্যি কথা বলা চলে না। আর আমি তো মিথ্যে বলব না।’ ধাঁধার মতো তাঁর কথার অন্তর্নিহিত অর্থ বোঝার চেষ্টা শেষমেশ ছেড়েই দিতাম… আব্বা সম্পর্কে যে সব জোরালো স্মৃতি আমার রয়েছে, তার অনেকটা জুড়ে তাঁর প্রিয়তম আস্তানা বাড়িতে একটা জানালার সামনের ছবি। বাইরে গাছ আর পাখপাখালি দেখতে দেখতে তাকিয়ায় হেলান দিয়ে বই পড়ছেন আর তাঁর প্রিয় ভৃত্য গিয়াসুদ্দিন পা টিপে দিচ্ছে।”
অনেক পরে, পরিবারের বাকি সদস্যরা যখন গোটা দেশ ঘুরছেন সিনেমার কারণে— বক্তৃতা, ছবির প্রোমোশন, পুরস্কার অনুষ্ঠান, দৌড়ঝাঁপ... তাঁরা নিশ্চিত জানতেন মনসুর আলি খানকে পাওয়া যাবে বাড়ির ল্যান্ডলাইনের পাশে। তার কোনও নড়চড় নেই। টেলিফোনের সঙ্গে তাঁর নাকি ছিল একই সঙ্গে প্রেম ও অপ্রেমের সম্পর্ক! যদিও সব সময়ে ফোনের কাছেই বসতেন, কিন্তু বারবার ফোন বাজলে বিরক্ত হতেন। টিনএজার সোহার বন্ধুরা একের পর এক ফোন করে কথা বলতে চাইছে, আর গম্ভীর, চূড়ান্ত ব্যক্তিত্বশালী মানুষটি খুব ছোট করে ‘না’ বলে ফোন রেখে দিচ্ছেন, এমনটা প্রায়ই ঘটত পটৌডি পরিবারে। যে বিরাট একটা এক্সটেনশন কর্ড দিয়ে ওই ফোন নিয়ে তিনি শোয়ার ঘরেও যেতেন, তার ডায়ালে তালা লাগানো থাকত! কথা বলার সময়ে তাঁর শব্দচয়ন ছিল শোনার মতো, কিন্তু শব্দ নষ্ট করায় বিশ্বাস করতেন না।
সুনীল গাওস্কর তাঁর সঙ্গে প্রথম ঘরোয়া ম্যাচ খেলতে গিয়ে বিপাকে পড়েছিলেন। কী নামে ডাকা যায় এই নবাবকে! সঙ্গীদের সঙ্গে আলোচনা করে স্থির হয়েছিল, বিপক্ষের প্রথম উইকেটটি পড়লে সকলে যখন মাঠের মাঝে জমা হবে, তখন খোদ মনসুর আলির কাছ থেকেই জেনে নিতে হবে। ঘটনাচক্রে সানি গাওস্কর প্রথমেই রান আউট করেন এবং মাটিতে হাঁটু মুড়ে বসে জুতোর লেস বাঁধতে ব্যস্ত পটৌডিকে প্রশ্ন করেন, ‘কী বলে ডাকব আপনাকে? স্কিপার না টাইগার নাকি প্যাট?’ এর পর গাওস্কর বলছেন, ‘‘উনি জুতো বাঁধা হয়ে গেলে উঠে একবার আমার দিকে তাকালেন, তার পর কোনও বাক্যব্যয় না করে, নিজের ফিল্ডিং পজ়িশনে চলে গেলেন।’ পরে বন্ধুত্ব হয়ে গেলে ‘টাইগার’ বলেই তাঁকে সম্বোধন করতেন সানি।
ক্রিকেটের ময়দানে
শব্দ ব্যবহারেই নয়, তাঁর এই মিতব্যয়িতা অন্যান্য ক্ষেত্রেও দেখা যেত। বিদেশি গাড়ি পারতপক্ষে চড়তেন না। ব্যতিক্রম ছিল একটি মাত্র দুধসাদা টু সিটার জাগুয়ার (যার লাইসেন্স প্লেটে লেখা ছিল প্যাট)। কখনও খুব দামি ডিজ়াইনার ব্র্যান্ডের জিনিস কিনতেন না। যদি লন্ডনের বাজারে গেলেন একজোড়া মোজা বদলানোর জন্য, তবে শুধু সেটাই করে চারপাশের মহার্ঘ সব পণ্যের দিকে চোখ বুজে থাকবেন। যতটুকু দরকার শুধুমাত্র ততটুকুই, তার বাইরে একটি জিনিসও নয়। টাকাপয়সার ব্যাপারে অত্যন্ত সতর্ক। তাঁর বাড়ির নানা ডেস্ক টেবলে সব সময়ে ছোট ছোট হলুদ স্টিকি নোট সাঁটা থাকত। সেখানে অনেক সময়েই লেখা থাকত চারটি শব্দ— ‘টার্ন দ্য লাইট অফ’। পেট্রলও অযথা নষ্ট করতে চাইতেন না টাইগার।
সম্ভবত নিরাপত্তাহীনতার একটা বোধ তাঁর মধ্যে কাজ করত এবং সে কারণেই এই মিতব্যয়িতা। এত কিছু তাঁকে হারাতে হয়েছে! শুধু চোখ হারানোই তো নয়, এগারো বছর বয়সে বাবাকে হারানো। খেতাব এবং প্রিভি পার্স হারানো তিরিশে। ছেড়ে দিতে হয়েছে দিল্লিতে ১ ডুপিলেক্স রোডের তিন একরের সুবিশাল গোলাপ বাগানওয়ালা বাংলো। তা সত্ত্বেও বরাবর থেকেছেন অভিযোগহীন এবং মিতভাষী।
নিজের জীবনের হতাশার দিকগুলো নিয়ে কথা বলতে চাইতেন না পরিবারের সদস্যদের সঙ্গেও। চোখ নিয়ে প্রশ্ন উঠলে ‘আ বিট অফ আ ব্যাড লাক’ বলে এড়িয়ে যেতেন। ওই দুর্ঘটনার আগে (এবং পরেও) বিদ্যুতের মতো ক্ষিপ্র ছিলেন ফিল্ডিংয়ে। যখন তাঁর মাত্র ১২ বছর বয়স, টাইগারের মা অর্থাৎ সাজদা তখন ঠিক করলেন, ইংরেজ পেশাদার ক্রিকেটার ফ্র্যাঙ্ক উলিকে টাইগারের জন্য নিয়োগ করবেন। সাজদা প্রতিটি কোচিং সেশনে যেতেন এবং দূর থেকে নজর রাখতেন। কিছু দিন পরেই দেখলেন, উলি চুপচাপ দাঁড়িয়ে টাইগারের নেট প্র্যাকটিস দেখছেন। বেশ কিছু দিন এ ভাবে চলার পর তিনি উলিকে গিয়ে বিনীত ভাবে বলতে বাধ্য হলেন যে, তাঁকে যথেষ্ট অর্থ দেওয়া হচ্ছে কোচিং দেওয়ার জন্য। উলি নাকি তখন ওঁর দিকে চেয়ে বলেছিলেন, “আমি ওর খেলার ধরন একটুও বদলাতে চাইছি না। একটুও না।’’
ছয়
২০১১ সালের ৫ জানুয়ারি পটৌডিতে পরিবারের সঙ্গে শেষবার টাইগারের জন্মদিন পালন হয় (এবং তাঁর বাবার মৃত্যুর পর প্রথমবারও বটে)। কাছের আত্মীয় বন্ধুদের সঙ্গে তিনি পানাহার করেন। কবিতা পড়া, ম্যাজিক শো হয়। ওঁকে নিয়ে ছেলেমেয়েদের তৈরি করা একটা শর্ট ফিল্ম দেখানো হয়। তার মাত্র ৮ মাসের মধ্যে এক মারাত্মক অসুখের প্রকোপে (ইডিয়োপ্যাথিক পালমোনারি ফাইব্রোসিস) তাঁর ফুসফুসের কার্যক্ষমতা ধীরে ধীরে কমে আসছিল। যে তিন সপ্তাহ হাসপাতালে ছিলেন, স্টেরয়েড তাঁর মাংসপেশির অর্ধেকেরও বেশি খেয়ে নিয়েছিল, কিন্তু তখনও হৃৎপিণ্ড দুরন্ত সচল। আইসিইউর ডাক্তাররা বলেছিলেন, এমনটা ওঁরা দেখেননি।
এক দুর্লভ আভিজাত্যে মোড়া ইনিংস যখন শেষ করলেন মনসুর আলি খান পটৌডি, তখন গোটা পরিবার তাঁর শয্যাপার্শ্বে। এত অল্প বয়সে ওই দুর্ঘটনা যদি না ঘটত, তা হলে তাঁর ক্রিকেট জীবন কোন অবিশ্বাস্য উচ্চতায় পৌঁছত, তা নিয়ে গবেষণা চলতেই থাকবে। সম্পূর্ণ দৃষ্টিনির্ভর এই খেলায় তিনি একটি চোখ ছাড়াই যে ম্যাজিক দেখিয়ে গেলেন, তা কী করে সম্ভব, সেই আলোচনা থামবার নয়, অন্তত ক্রিকেট সভ্যতা যত দিন থাকবে।
অবশ্য তাতে আর কিছু যায় আসে না অভিযোগহীন, নম্র ওই মানুষটির। যিনি উত্তরাধিকারসূত্রে শুধু নন, মানুষের ভালবাসায় নবাব। পটৌডিতে তাঁর প্রিয় গাছগাছালি আর পাখির ডাকের মধ্যে ঘুমিয়ে রয়েছেন যিনি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy