Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪

নীলকণ্ঠ বিদ্যাসাগর

সমাজ সংস্কারক, দয়ার সাগর... নানা অভিধায় বাঙালি আগলে রাখে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে। কিন্তু সব স্তরেই অপমানিত হতে হয়েছে তাঁকে। তেমনই কিছু টুকরো চিত্র সন্ধানের চেষ্টায় অর্ঘ্য বন্দ্যোপাধ্যায়

বিদ্যাসাগর সবচেয়ে বেশি আঘাত, যন্ত্রণা পেয়েছেন বোধহয় ছেলে নারায়ণচন্দ্রের কাছ থেকে।

বিদ্যাসাগর সবচেয়ে বেশি আঘাত, যন্ত্রণা পেয়েছেন বোধহয় ছেলে নারায়ণচন্দ্রের কাছ থেকে।

শেষ আপডেট: ১২ অক্টোবর ২০১৯ ০০:১৪
Share: Save:

(১)

মা-ছেলেতে বেশ বাদানুবাদ চলছে। ছেলে সুরেশচন্দ্র সমাজপতি বিলেত গিয়ে আইন পড়ে ব্যারিস্টার হতে চান। তাই গোপনে মায়ের অনুমতি নিয়ে রওনা হওয়ার পরিকল্পনা করলেন তিনি। গোপনীয়তার কারণ, দাদামশাইকে বললে যদি অনুমতি না মেলে! কিন্তু মা হেমলতাদেবী জানালেন, তিনি তাঁর বাবাকে একটি বার বিষয়টি বলবেন।

দাদামশাইয়ের কাছে গোপন থাকল না কিছুই। সব জেনে নাতিকে বললেন, ‘টাকাপয়সার বড় অনটন হয়ে পড়েছে, এ-অবস্থায় আর হয় না।’ সুরেশচন্দ্রের মুখ ভার। কয়েক দিন পরে বাড়িতেই মাকে বললেন, ‘আমার বাবা থাকলে কি আর তোমার বাবার কাছে আবদার করতে যেতাম?’ কথাটা কানে যেতেই দু’চোখে বান ডাকল দাদামশায়ের। নাতিকে বললেন, ‘তোরা আমাকে পর ভাবিস…’

দাদামশাই, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। এ অভিমান তাঁর করা সাজে। বড় মেয়ে হেমলতার সঙ্গে গোপালচন্দ্র সমাজপতির সংসার বেশি দিন টেকেনি। বিয়ের পাঁচ বছরের মাথায় গোপালচন্দ্রের মৃত্যু হল। মেয়ে, নাতি তো বটেই, সঙ্গে গোপালচন্দ্রের বাকি পরিবারটির জন্যও যাবতীয় ব্যবস্থা করলেন ওই দাদামশাই।

কিন্তু এত করেও আঘাত! এই আঘাত অবশ্য নিকটজনদের অনেকেই করেছেন।

প্রথমে ভাইদের কথা। মোট সাত ভাই। তিন জন শৈশব, কৈশোরেই মারা যায়। বড় ভাই বিদ্যাসাগরের জীবন সূত্রে আসে দীনবন্ধু ন্যায়রত্ন, শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্ন, ঈশানচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়— এঁদের কথা।

প্রথমে ঈশানচন্দ্রের প্রসঙ্গ। বাবা ঠাকুরদাস সেই সময়ে কলকাতায় রয়েছেন। ঠিক করলেন, কাশীবাসী হবেন। বড় ছেলে বাধ সাধলেন। ছেলের অনুরোধে বীরসিংহে ফিরতে নিমরাজি হলেন ঠাকুরদাস। কিন্তু ঈশানচন্দ্র বাবাকে বললেন, ‘আমার মতে দেশে গিয়ে সংসারী ভাবে থাকা আর আপনার উচিত নয়, এ সময়ে আপনার কাশীধামে বাস করাই উচিত।’ অত্যন্ত অসন্তুষ্ট, খানিক বিড়ম্বনায় পড়া অগ্রজ চললেন কাশী, যাতে বাবার সেখানে থাকার কোনও অসুবিধে না হয়।

বিদ্য়াসাগরের বাড়ি

বাবা কাশীবাসী হলে প্রায়ই সেখানে খোঁজখবর করার জন্য যেতে হয় বিদ্যাসাগরকে। এক বার গ্রীষ্মে তেমনই কাশী যাওয়ার তোড়জোড় করছেন। তা দেখে একজন জানালেন, গরমে কাশী যাওয়া যে বড্ড ভয়ের। শুনে উত্তর, ‘ডিউটি করতে যাব, তাতে প্রাণের ভয় করলে চলবে কেন!’ জীবনভর এই ডিউটি অর্থাৎ কর্তব্যপালনই করলেন বিদ্যাসাগর।

সে কর্তব্যপালন কেমন, তা টের পান ভাই দীনবন্ধুও। ‘সংস্কৃত প্রেস ও ডিপজিটারী’র মালিকানার অধিকার দাবি করলেন দীনবন্ধু। ছাপাখানার অধিকার নিয়ে অগ্রজের সঙ্গে বিবাদ আদালত পর্যন্ত গড়ানোর উপক্রম হল। শেষমেশ সালিশিতে বসে মীমাংসা মিলল। ছাপাখানার অন্যায্য দাবি ত্যাগের পাশাপাশি, অগ্রজের থেকে প্রতি মাসের টাকাটি নেওয়াও বন্ধ করলেন দীনবন্ধু।

কিন্তু গোপনে নিজে গিয়ে দীনবন্ধুর স্ত্রীর আঁচলে টাকা বেঁধে দিলেন বিদ্যাসাগর। বললেন, ‘মা, এই নাও, দীনোকে বলো না, আমি জানি, তোমাদের কষ্ট হচ্ছে, এই টাকায় সংসার খরচ চালাবে।’ বিষয়টা চাপা থাকল না। দীনবন্ধুর
স্ত্রী বাধ্য হলেন টাকা ফেরাতে।

বীরসিংহে বিদ্যাসাগরের স্মৃতিমন্দির (ছবি: কৌশিক সাঁতরা)

কিন্তু সময়ে ঠিক গুমর ভাঙল দীনবন্ধুর। সম্পর্ক না রাখলেও দাদার কাছ থেকে টাকা নিতে আর বাধল না তাঁর।
দাদাকে অপমান করেছেন ভাই শম্ভুচন্দ্রও। ক্ষীরপাইয়ের বাসিন্দা কেচকাপুর স্কুলের প্রধান পণ্ডিত মুচিরাম বন্দ্যোপাধ্যায় এবং কাশীগঞ্জের মনোমোহিনী দেবীর বিধবা-বিবাহ উপলক্ষে ঘটনার সূত্রপাত। শম্ভুচন্দ্রের মতে, ক্ষীরপাইয়ের হালদারবাবুর অনুরোধে বিদ্যাসাগর এই বিয়েতে ‘সংস্রব’ রাখেননি। কিন্তু তাঁরই ভাইপো গোপালচন্দ্র ও ভাই ঈশানচন্দ্র চাঁদা তুলে এই বিয়ে দিলেন। দেশে বিধবা-বিবাহের সূত্রপাত যাঁর হাতে, সেই মানুষটি কেন এই বিয়েতে মত দিলেন না (শুধু অনুরোধে নিশ্চয়ই নয়), তা একটি গুরুতর কৌতূহল। কিন্তু কারণ যা-ই হোক না কেন, শম্ভুচন্দ্র এই ঘটনাকে বিদ্যাসাগরের ‘পশ্চাৎপদতা’ ও ‘কাপুরুষতার পরিচয়’ বলে বিঁধলেন। এমন ‘সুমধুর বিশেষণ’ ঈশ্বরের ঘোরতর বিরোধীও প্রয়োগ করেননি।

বিদ্যাসাগর সবচেয়ে বেশি আঘাত, যন্ত্রণা পেয়েছেন বোধহয় ছেলে নারায়ণচন্দ্রের কাছ থেকে। নারায়ণ বিধবা বিয়ে করে (পাত্রী ভবসুন্দরী দেবী) যে তাঁর মুখ উজ্জ্বল করেছেন, সে কথা নিজেই জানিয়েছেন বাবা। কিন্তু সময় যত গড়িয়েছে, বাবা ঈশ্বরের চোখে ছেলে ‘নারায়ণবাবু’ হয়েছেন। ছেলের কাজকর্মেও আর সমর্থন নেই। মধুসূদন ভট্টাচার্য নামে এক ব্যক্তির স্ত্রী বিন্ধ্যবাসিনী দেবীকে তাঁর স্বামীর সম্পত্তির ‘উপস্বত্ত্বভোগ’ থেকে বঞ্চিত করার চেষ্টা চলল।
সেই চেষ্টার প্রধান এক মাথা ঈশ্বরপুত্র নারায়ণ!

বিদ্যাসাগরের মনে হল এমন কাজ ‘পিতৃদ্বেষ’! ছেলের এমন আরও নানা কাজকর্ম দেখে বিদ্যাসাগর স্পষ্ট লিখলেন, ‘আমার পুত্র বলিয়া পরিচিত শ্রীযুত নারায়ণ বন্দ্যোপাধ্যায় যারপরনাই যথেচ্ছাচারী ও কুপথগামী এজন্য ও অন্য অন্য গুরুতর কারণ বশতঃ আমি তাঁহার সংস্রব ও সম্পর্ক পরিত্যাগ করিয়াছি…’ যদিও পুত্রবধূর প্রতি আচরণে কোনও রকম বিদ্বেষ থাকল না।

ছেলের পাশাপাশি, জামাইয়ের কাজেও বিস্মিত হলেন বিদ্যাসাগর। সেজ মেয়ে বিনোদিনী দেবীর সঙ্গে বিয়ে হয় সূর্যকুমার অধিকারীর। মেট্রোপলিটন কলেজের অধ্যক্ষ সূর্যকুমারের কাছ থেকে হিসেবখাতা নিয়ে বিদ্যাসাগর দেখলেন, দু’-তিন হাজার টাকা কম পড়ছে। তিন দিন বাদে ফের এলেন। তখনও সদুত্তর নেই জামাইয়ের মুখে। বিষয়টা বুঝে জামাইকে শ্বশুরমশাই বললেন, ‘টাকার যদি দরকার ছিল তো আমায় বললে না কেন?’ দেরি না করে মুহূর্তে জামাইকে অধ্যক্ষ পদ থেকে বরখাস্ত করে সেই দায়িত্ব বৈদ্যনাথ বসুর হাতে দিলেন ঈশ্বর।
কিন্তু পারিবারিক পরিসরে বিদ্যাসাগরের সঙ্গে তাঁর স্ত্রী দিনময়ী দেবীর সম্পর্কের কথা তুলে পরবর্তী কালের অনেক গবেষকই অনুযোগ করেছেন। এটা সত্য, বিদ্যাসাগরের বিপুল ব্যক্তিত্বের সামনে সংসার জীবনের এক বড় পর্যায় পর্যন্ত দিনময়ী নিতান্তই এক কোণে পড়ে থেকেছেন। তাঁর অন্তর্ব্যথার নিপুণ ছবি রয়েছে বনফুলের ‘বিদ্যাসাগর’ নাটকেও।

কিন্তু সমাজ ও শিক্ষা নিয়ে ব্যস্ত বিদ্যাসাগর সম্পর্কে স্ত্রীর প্রতি অবহেলার অনুযোগও কি পুরোপুরি ধোপে টেকে? ১৮৭৬ থেকে কলকাতার বাদুড়বাগানে স্বামীর সঙ্গে সহযাপন শুরু হয় প্রৌঢ়া দিনময়ীর। এমনকি ১৮৮৮-র ১৩ অগস্ট স্ত্রীর মৃত্যুর খানিক আগে তাঁর ইচ্ছেপূরণের চেষ্টাও করেছেন স্বামী।

মৃত্যুশয্যায় স্ত্রীর পাশে দাঁড়িয়ে বিদ্যাসাগর। বারবার কপালে আঘাত করছেন দিনময়ী। ইঙ্গিত ধরতে পেরে ঈশ্বর বললেন, ‘বুঝেছি, তাই হবে; তার জন্য আর ভাবতে হবে না।’ ছেলে নারায়ণচন্দ্রের জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করেছেন স্ত্রী। কতটা মন থেকে তা জানা যায় না, কিন্তু মায়ের শ্রাদ্ধ ও পারলৌকিক ক্রিয়াকর্মের জন্য ছেলের হাতে যাবতীয় খরচ দেন ঈশ্বর। আর স্ত্রীর চতুর্থী শ্রাদ্ধের দিন খেতে বসে তাঁর নিজের অনুভূতি প্রসঙ্গে বলে উঠলেন, ‘‘দ্বিজ রামপ্রসাদ ভণে ‘কান্না যাবে, অন্ন খাবে অনায়াসে’।’’

এর অনেক আগেই স্ত্রীকে বিদ্যাসাগর লিখেছেন, ‘এক্ষণে তোমার নিকট এ জন্মের মত বিদায় লইতেছি এবং বিনয় বাক্যে প্রার্থনা করিতেছি যদি কখন কোন দোষ বা অসন্তোষের কার্য্য করিয়া থাকি, দয়া করিয়া আমায় ক্ষমা করিবে।’— দূরত্ব থাকলেও এ বাক্য কি বিদ্যাসাগরের দাম্পত্য দায়বদ্ধতার বিষয়ে নানা প্রশ্নের উত্তর দেয় না?

কিন্তু ক্ষমা বিদ্যাসাগর নিজেই কি করতে পারলেন তাঁর সংসার, তাঁর প্রিয় স্বদেশ বীরসিংহকে? বোধহয় তা পারেননি বলেই বীরসিংহ ত্যাগের সিদ্ধান্ত। কারণ হিসেবে মুচিরামের বিয়ের বিষয়টি প্রচলিত হলেও তা বোধহয় ঠিক নয়। মা ভগবতী দেবী, স্ত্রী ও বীরসিংহের ‘প্রধান’ গদাধর পালকে চিঠি লিখে বিদায় জানাচ্ছেন— আর ফেরা নয় এই গ্রামে। ফিরলেনও না, জীবনের অবশিষ্ট প্রায় ১৯টি বছর। জন্মভিটে ছাড়ার সময়ে গ্রামবাসী আর ভাইদের বললেন, ‘তোমরা আমাকে দেশত্যাগী করালে!’
এখন প্রশ্ন, এই ‘তোমরা’ বিদ্যাসাগরকে গ্রামে ফেরানোর চেষ্টা কি আদৌ করেছে বা করলেও তা কতটা আন্তরিক?

(২)

বিদ্যাসাগর যুগপুরুষ ঠিকই। কিন্তু সেই যুগ বা সমকাল অর্থাৎ উনিশ শতকের বাংলা তাঁকে ঠোক্কর মেরেছে বারবার।

অল্প বয়স থেকেই এই সমাজের সঙ্গে পরিচয় তাঁর। ঘটনাস্থল সংস্কৃত কলেজ। সাহেব জন মিয়র প্রায়ই নানা বিষয়ে ছাত্রদের সংস্কৃত শ্লোক লেখার প্রতিযোগিতার আয়োজন করেন। এক বার পদার্থবিদ্যা বিষয়ে একশোটি শ্লোক লেখার প্রতিযোগিতা আয়োজিত হল। এক সহপাঠী ঈশ্বরকে প্রস্তাব দিলেন, দু’জনে ৫০টি করে শ্লোক লিখলে কেমন হয়? পুরস্কার পেলে টাকাও ভাগাভাগি হবে। কিন্তু নির্দিষ্ট দিনের কিছু আগে ছেলেটি জানালেন, তাঁর শ্লোক-রচনা করা হয়নি। বিদ্যাসাগরের তা হয়ে গেলেও নিজে যে পাতায় ৫০টি শ্লোক লিখেছিলেন, তা ছিঁড়ে ফেললেন। অথচ দেখা গেল, সেই ছাত্রটি নির্দিষ্ট দিনে পুরো ১০০ শ্লোকই জমা দিয়েছে! আসলে এ ছিল সেই ছেলের বিদ্যাসাগর-কাঁটা উপড়ে ফেলার কৌশল। পরের বার পুরস্কারটা অবশ্য জিতলেন ন্যায়শ্রেণির ছাত্র ঈশ্বরই।

ছাত্রাবস্থার পরেও নানা অপমান, দুর্নামের সম্মুখীন হতে হল ঈশ্বরকে। তত দিনে তিনি সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ। ‘সম্বাদ ভাস্কর’-এ এক পত্রলেখক অভিযোগ করলেন, বিদ্যাসাগর ইংরেজ সরকারের বিশেষ প্রিয়পাত্র। তিনি মানুষকে মানুষ জ্ঞান করেন না। এমনকি তাঁর চক্রান্তে সরকারি স্কুলে অন্য লেখকের ভাল বইও আদর পায় না! এখানেই শেষ নয়। বিদ্যাসাগর নাকি তার তুলনায় কোনও বাঙালির সাহেবমহলে প্রতিপত্তি হোক, এমনটা চাইতেন না। পরের দিকে এমনই দৃঢ় ধারণা হল কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্যেরও।

অথচ সরকারি প্রয়োজনে বিদ্যাসাগরের মতো একজন দেশীয় পণ্ডিতকে যতটা দরকার, তার চেয়ে বেশি ‘অনুগ্রহ’ দেখায়নি ইংরেজ। বিদ্যাসাগরেরও সে সবের প্রয়োজন হয়নি। ১৮৫৭-র ২৪ নভেম্বর থেকে ১৮৫৮-র ১৫ মে-র মধ্যে বিদ্যাসাগর মোট ৩৫টি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করলেন। ইংরেজ সরকার এই ‘প্রিয়’ পণ্ডিতের কাছেই জানতে চাইল, কেন বিদ্যাসাগর প্রত্যাশা করছেন স্কুলগুলির জন্য সরকারি সাহায্য মিলবে এবং কেনই বা কোনও লিখিত নির্দেশ ছাড়া এই কাজ করা হয়েছে? নানা ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে শেষমেশ সরকারি কাজেও ইস্তফা দিলেন তিনি।

শুধু তা-ই নয়, ১৮৮০-র পয়লা জানুয়ারি সরকার বিদ্যাসাগরকে সিআইই উপাধি দেওয়ার কথা জানায়। কিন্তু কেতাদুরস্ত পোশাক পরে রাজদরবারে গিয়ে পুরস্কার গ্রহণের লোক এই মানুষটি নন। তাই তিনি চলে গেলেন কার্মাটাঁড়ে। কিছু দিন পরে লাটসাহেবের দফতরের এক কর্মচারী ও এক চাপরাশি পদক নিয়ে হাজির হলেন পণ্ডিতমশায়ের কাছে।
বিদ্যাসাগর তা গ্রহণ করলেন। কিন্তু দু’জনেই দাঁড়িয়ে। বকশিস চান। বিদ্যাসাগর বললেন, ‘এই পদক বেনের দোকানে বেচে দাও। যা পাবে, দু’জনে ভাগ করে নিও।’ শুধু তা-ই নয়, পরে লাট সাহেবের প্রাইভেট এন্ট্রির তালিকা থেকে নিজের নামটি সযত্ন কাটিয়েও দিলেন এই ‘প্রিয়পাত্র’!

আসলে দান বা দানধর্মী অনুগ্রহ স্বীকারে বিদ্যাসাগরের চিরকালের অনীহা। তা সে ইংরেজ সরকার বা বর্ধমানের মহারাজা— যাঁরই দেওয়া হোক। কারণ হিসেবে, বিদ্যাসাগরের এ বিষয়ে এক রা, ‘আমি কারো দান নিই না। কলেজের বেতনেই আমার স্বচ্ছন্দে চলে।’ কিন্তু এই আচরণের জন্য ‘অহঙ্কারে একেবারে চক্ষুঃ কর্ণ উভয়েন্দ্রিয় হারাইয়াছেন’ বিদ্যাসাগর, এমন তোপ দেগে বসল ‘সম্বাদ ভাস্কর’।

অথচ প্রকৃত অহংয়ের জন্যই এই মানুষটি গৃহস্থালীর টুকিটাকি জেনে পরিচারককে বলতে পারেন, ‘তুমি আমার শিক্ষক, তুমি আমার গুরু।’
জনজীবনে এ সব অপমানের তবুও কোথাও বাঁধ ছিল। কিন্তু বাঙালি সেই অপমানেরও বাঁধ ভাঙল বিধবা-বিবাহ আন্দোলনের সময়ে। কিছু দিন হল বিদ্যাসাগরের ‘বিধবাবিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব’ বইটি প্রকাশিত হয়েছে (জানুয়ারি, ১৮৫৫)। প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে বাংলার পথে-ঘাটে-সমাজে তীব্র আলোচনা শুরু হল। পক্ষে মত কম না হলেও বিপক্ষে মত ধারে-ভারে অনেকটাই এগিয়ে।
বিদ্যাসাগরের এই বই ও ভাবনার প্রতি শোভাবাজারের রাজা রাধাকান্ত দেব প্রথমে সহানুভূতিশীল থাকলেও পরে বিরুদ্ধবাদীদেরও ‘তুষ্ট’ করলেন। কিন্তু ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত সোজাসুজিই লিখলেন, ‘বাধিয়াছে দলাদলি লাগিয়াছে গোল।/ বিধবার বিয়ে হবে বাজিয়াছে ঢোল।।’ ‘সংবাদ প্রভাকর’-এ একটি চিঠিতে পত্রলেখক বিদ্যাসাগর সম্পর্কে রীতিমতো নানা অশালীন ইঙ্গিত করলেন। তবে দাশরথি রায় আর শান্তিপুরের তাঁতিরা দাঁড়ালেন বিদ্যাসাগরের পক্ষে। ‘বিদ্যাসাগর পেড়ে’ শাড়ি বুনলেন তাঁতিরা। পাড়ে লেখা থাকল বিদ্যাসাগরের জয়গান, ‘সুখে থাকুক বিদ্যাসাগর চিরজীবী হ’য়ে।’ যদিও এর পাল্টা বাঙালি শুনল, ‘শুয়ে থাক বিদ্যাসাগর চিররোগী হয়ে।’

এমনই নানা বাদ-প্রতিবাদের মধ্যে শেষমেশ বিধবা-বিবাহ আইন পাশ হল। কিন্তু প্রবল বিরুদ্ধবাদীরা ভাবলেন, আইনে কী বা হয়। কিন্তু সেই ধারণাও গুঁড়িয়ে গেল ১৮৫৬ সালের ৭ ডিসেম্বর। আইনসম্মত বিধবা বিবাহ হল শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্ন এবং কালীমতী দেবীর।

বিদ্যাসাগরের জয় হলেও এই বিয়ের সূত্রেই তাঁর বৌদ্ধিক ধারণায় নেমে এল আঘাত। এ বার রমাপ্রসাদ রায়ের কাছ থেকে। তিনি এ বিয়েতে আসবেন বলেছিলেন। কিন্তু বিয়ের কিছু দিন আগে তিনি জানালেন, এ বিয়েতে তাঁর মনে মনে মত রয়েছে। সাধ্য মতো সাহায্যও করবেন। কিন্তু বিবাহস্থলে না-ই বা গেলেন! ঈশ্বর সব বুঝলেন। আর দেওয়ালে টাঙানো মনীষীর ছবিটির দিকে ইঙ্গিত করে বললেন, ‘ওটা ফেলে দাও, ফেলে দাও।’ ছবিটি রাজা রামমোহন রায়ের। রমাপ্রসাদ তাঁরই পুত্র।

রমাপ্রসাদ যে আঘাত দিলেন, পথে নেমে কুৎসিত ভাবে তা-ই যেন প্রকট করল সে কালের বাঙালি জনতার বড় অংশ। বিধবাদের বিয়ে দেওয়ার ‘অপরাধে’ সমাজে একঘরে করা হল বিদ্যাসাগরকে। পথে বেরোলেই জোটে গালমন্দ, ঠাট্টা, অশালীন ইঙ্গিত। কেউ বা মারধর, খুনের হুমকিও দেয়। ব্যাপারটা শুধু হুমকিতে থামল না। বিদ্যাসাগর শুনলেন, তাঁকে খুন করার জন্য ভাড়াটে গুন্ডাদের বরাত দিয়েছেন কলকাতার এক নামী ব্যক্তি। বিদ্যাসাগর নিজেই সেই তথাকথিত নামীর ঘরে গেলেন। বললেন, ‘শুনলাম, আমাকে মারবার জন্য আপনাদের ভাড়াটে লোকেরা আহার-নিদ্রা ছেড়ে আমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে।’ এই সময়পর্বে ছেলেকে রক্ষার জন্য ঠাকুরদাস বীরসিংহ থেকে জেলে-সর্দার তথা লেঠেল শ্রীমন্তকে বিদ্যাসাগরের কাছে পাঠান। ঠনঠনের কাছে এক হামলার উপক্রম থেকে বিদ্যাসাগরকে রক্ষাও করলেন শ্রীমন্ত সর্দার।

(৩)

শুধু সমাজ নয়, বাঙালির বড় আপনজন, বড় গর্বের দু’জন ব্যক্তিরও বিদ্যাসাগরকে বুঝতে সমস্যা হল— বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও মাইকেল মধুসূদন দত্ত।

প্রথমে মাইকেল প্রসঙ্গ। ‘বিদ্যোৎসাহিনী সভা’র এক অনুষ্ঠান। ১৮৬১-র ১২ ফেব্রুয়ারি। অনুষ্ঠানে মধুসূদন সৃষ্ট অমিত্রাক্ষর ছন্দকে অভিনন্দন জানানো হবে। সে কালের বহু গুণিজন সেখানে থাকলেও নেই বিদ্যাসাগর। ছন্দটি পছন্দ হয়নি তাঁর। কিন্তু ছন্দ পছন্দ না হলে কী হবে, ব্যারিস্টারি পড়তে মধুসূদনের ইংল্যান্ড যাওয়াকে সমর্থন করলেন। পাশাপাশি দিলেন সাহায্যের প্রতিশ্রুতিও।

মধুসূদন তখন ফ্রান্সে। কার্যত কপর্দকশূন্য। পরপর চিঠি লিখছেন ঈশ্বরকে। সাতটি চিঠির পরে অষ্টম চিঠি লেখার মাঝে ঘটল ঘটনাটা।
মধুসূদনের স্ত্রী হেনরিয়েটা: ‘ছেলেটা বড্ড মেলায় যাওয়ার বায়না ধরেছে। কিন্তু, হাতে মাত্র তিন ফ্রাঁ।’ মধুসূদন নিশ্চিন্ত। বললেন, ‘চিন্তা নেই, আজকে ডাক-আসার দিন।’ ডাক এলও। সঙ্গে ১৫০০ টাকা। নবম চিঠির পরে ফের এল ২৪৯০ ফ্রাঁ! মধু-কবির এ বার দাবি, প্রয়োজন পাঁচ হাজার টাকা। বিদ্যাসাগর ধার করলেন আট হাজার টাকা। মধুসূদনের সম্পত্তিও বন্ধক রাখা হল ১২ হাজার টাকায়। চিঠির সূত্রেই ভিনদেশে বাঙালির মহাকবিকে রক্ষা করলেন বিদ্যাসাগর।

স্ত্রী, ছেলেমেয়েকে বিলেতে রেখেই দেশে ফিরলেন মধুসূদন। খবর পেয়ে একটি বাড়ি ভাড়া করে ঘরদোর ইউরোপীয় কায়দায় সাজিয়ে অপেক্ষা করছেন বিদ্যাসাগর। কিন্তু মধুসূদন এসে উঠলেন হোটেল স্পেন্সেসে। কবির এ আচরণ বিদ্যাসাগরের কাছে অবশ্য ‘শিশুসুলভ অসঙ্গতি’।
এই অসঙ্গতি দেখেও হাইকোর্টে ব্যারিস্টার মধুসূদনের প্রবেশের জন্য চরিত্র-শংসাপত্র লেখা, কবির ঋণ-শোধের জন্য প্রিয় ‘সংস্কৃত যন্ত্র’-এর একাংশের মালিকানা বিক্রি করেছেন বিদ্যাসাগর। কিন্তু মধুসূদন জাত-ঋণী। এক দিকে ঋণ করেন, অন্য দিকে ঈশ্বরের কাছে সাহায্য প্রার্থনা। শেষমেশ বিদ্যাসাগরকেও বলতে হল, ‘আই…অ্যাম স্যাডলি কনভিন্সড দ্যাট ইওর কেস ইজ় অ্যান আটারলি হোপলেশ ওয়ান...’
এই ‘হোপলেশ ওয়ান’ই অবশ্য ছন্দে-কথায় শ্রদ্ধা জানিয়েছেন তাঁর ভরসা ঈশ্বরকে।

মধুসূদন নাহয় অসঙ্গতির কারণে বিদ্যাসাগরের কাছে বারবার টাকা চেয়ে বিড়ম্বনা বাড়িয়েছেন। কিন্তু সরাসরি বিরোধীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন বঙ্কিমচন্দ্র।

১৮৮৫ সালে বঙ্কিমচন্দ্র এক লেখায় রামমোহন রায়ের পরে ‘দেশবাৎসল্যের প্রথম নেতা’ হিসেবে হরিশ্চন্দ্র মুখোপাধ্যায় এবং রামগোপাল ঘোষের কথা বললেও অনুচ্চারিত থাকল ঈশ্বরের নাম! বিদ্যাসাগরের ‘বহুবিবাহ রহিত হওয়া উচিত কি না এতদ্বিষয়ক বিচার। দ্বিতীয় পুস্তকের’ তীব্র সমালোচনা করলেন বঙ্কিম। এমনকি ‘বঙ্গদর্শন’-এ প্রকাশিত ‘বিষবৃক্ষ’ উপন্যাসের সূর্যমুখীকে দিয়েও বঙ্কিম লেখালেন, ‘ঈশ্বর বিদ্যাসাগর নামে কলিকাতায় কে না কি বড় পণ্ডিত আছেন, তিনি আবার একখানি বিধবাবিবাহের বহি বাহির করিয়াছেন। যে বিধবার বিবাহের ব্যবস্থা দেয়, সে যদি পণ্ডিত, তবে মূর্খ কে?’

বিষয়টি নিয়ে বিরূপ মন্তব্য না করে রসিকতা করলেন বিদ্যাসাগর। এক বার বিদ্যাসাগর বর্ধমানে গিয়েছেন। তারকনাথ বিশ্বাসদের বাড়িতে। এসেছেন বঙ্কিমচন্দ্র, সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ। রান্না করলেন বিদ্যাসাগর, আম, আদা দিয়ে পাঁঠার মেটের অম্ল। সকলেই ভীষণ বাহবা দিচ্ছেন। বঙ্কিম যেন একটু বেশিই খুশি। তা দেখে সঞ্জীবচন্দ্র ফাঁস করলেন, ‘ও রান্না বিদ্যাসাগরের।’ আর তা শুনে পাচক উবাচ, ‘না হে না, বঙ্কিমের সূর্যমুখী আমার মত মূর্খ দেখেনি।’ হাসির রোল উঠল। বঙ্কিম শুধু অম্লে মন দিলেন।

বঙ্কিম প্রাথমিক ভাবে বিদ্যাসাগরের গদ্য-ভাষা, সমাজ-সংস্কার, দুই সম্পর্কেই বিরূপ ছিলেন। পরে অবশ্য বিদ্যাসাগরের ভাষাকেই ‘আমাদের মূলধন’ বলেছেন তিনি।

(৪)

জীবিত অবস্থায় বিদ্যাসাগর অনেকের শ্রদ্ধা পেলেও তুলনায় কাছের লোক, পরিচিতদের থেকে পাওয়া আঘাত, অপমানই বড় হয়ে বেজেছে তাঁর বুকে। সে সম্পর্কে বিদ্যাসাগর নীরবও নন। তাই কখনও কখনও অনুযোগ করেছেন। লিখছেন, ‘আমার আত্মীয়েরা আমার পক্ষে বড় নির্দ্দয়; সামান্য অপরাধ ধরিয়া অথবা অপরাধ কল্পনা করিয়া আমায় নরকে নিক্ষিপ্ত করিয়া থাকেন।’

কিন্তু অভিমান, রাগ, দুঃখের মতো মানবপ্রবৃত্তির কারণেও ‘ডিউটি’ ভোলেননি তিনি। আর তাই গ্রাম ছাড়লেও তাঁরই হাতে তৈরি গ্রামের স্কুলকে ১০০ টাকা, চিকিৎসালয়ের জন্য ৫০ টাকা এবং ‘ঐ গ্রামের অনাথ ও নিরুপায় লোক’দের জন্য ৩০ টাকা উইলে বরাদ্দ করেছেন।
তবে সব ভুলেই হয়তো এই গ্রামে ফিরতে চেয়েছিলেন বিদ্যাসাগর। কিন্তু ‘ফিরব বললে ফেরা যায় না কি’! গ্রামে ফেরার অপূর্ণ ইচ্ছে নিয়েই ১৮৯১-এর ২৯ জুলাই চিরঘুমে চলে যান বাঙালির প্রিয় ঈশ্বর।

নশ্বর দেহটি শেষ হল। গর্বের পাশাপাশি বিদ্যাসাগর বাঙালির জন্য রেখে গেলেন তাঁর অভিমানও। তাই কি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিদ্যাসাগর সম্পর্কে বলে উঠলেন, ‘বৃহৎ বনস্পতি যেমন ক্ষুদ্র বনজঙ্গলের পরিবেষ্টন হইতে ক্রমেই শূন্য আকাশে মস্তক তুলিয়া উঠে— বিদ্যাসাগর সেইরূপ বয়োবৃদ্ধিসহকারে বঙ্গসমাজের সমস্ত অস্বাস্থ্যকর ক্ষুদ্রতাজাল হইতে ক্রমশই শব্দহীন সুদূর নির্জনে উত্থান করিয়াছিলেন… তাঁহার মহৎ চরিত্রের যে অক্ষয়বট তিনি বঙ্গভূমিতে রোপণ করিয়া গিয়াছেন তাহার তলদেশ সমস্ত বাঙালিজাতির তীর্থস্থান হইয়াছে।’
সেই তীর্থস্থান রক্ষার দায়িত্ব প্রত্যেক বাঙালির। আর তা হলেই নীলকণ্ঠ বিদ্যাসাগরের বুকে জমে থাকা অপমানের বোঝা খানিক লাঘব হবে।

ঋণ: ‘করুণাসাগর বিদ্যাসাগর’: ইন্দ্রমিত্র, ‘বিদ্যাসাগর’: চণ্ডীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, ‘ভ্রমনিরাশ’, ‘বিদ্যাসাগর-জীবনচরিত’: শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্ন, ‘বিদ্যাসাগর-প্রসঙ্গ’: ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, ‘বিদ্যাসাগরচরিত’: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘কোরক’ প্রভৃতি

অন্য বিষয়গুলি:

Ishwar Chandra Vidyasagar Renaissance
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy