Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Kalaripayattu

কালারিপায়াতুর ইতিকথা

আত্মরক্ষার কৌশল শেখায় দক্ষিণ ভারতীয় এই যুদ্ধরীতি। এর নিয়মিত অভ্যাসে শরীরের উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ আসে।

An image of Martial Arts

—প্রতীকী চিত্র।

কোয়েনা দাশগুপ্ত
কলকাতা শেষ আপডেট: ০২ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ০৮:৫২
Share: Save:

‘ঝাঁপ দিব প্রাণ আজি সমর তরঙ্গে...’

বলিউড বা দক্ষিণী অ্যাকশন ছবিগুলি আমাদের অনেকেরই ভাল লাগে। ‘বাগী’ ছবিতে টাইগার শ্রফ বা ‘কম্যান্ডো’য় বিদ্যুৎ জামওয়ালকে মনে আছে? কিংবা ‘বিম্বিসার’ ছবিটি? এই ছবিগুলির অ্যাকশন দৃশ্য অন্যান্য ছবির চেয়ে খানিক আলাদা। সেখানে ব্যবহার করা হয়েছে প্রাচীন ভারতীয় মার্শাল আর্ট কালারিপায়াতুর নানা ফর্ম। প্রায় তিন হাজার বছরের পুরনো কালারিপায়াতুর জন্ম মূলত দক্ষিণ ভারতের কেরালায়। এ এক ধরনের যুদ্ধ বিষয়ক খেলা। কেরালা ছাড়াও তামিলনাড়ু, কর্নাটক, উত্তর পূর্ব শ্রীলঙ্কা এবং মালয়েশিয়ার মালয় সম্প্রদায়ের মানুষরাও অনুশীলন করেন কালারিপায়াতু।

তবে এ তো গেল অতীতের কথা। আজকের যুগে জিম, সাঁতার, ক্যারাটে, বক্সিং, তরোয়াল চালানো শারীরচর্চার জন্য তৈরি হওয়া হরেক রকম পদ্ধতির সব কিন্তু নিহিত রয়েছে কালারিপায়াতুর মধ্যেই। কথায় আছে, ‘বলং বলং বাহু বলং’। শাস্ত্রে, শিক্ষায়, মহাপুরুষের বাণীতে বাহুর জোর বাড়ানোর কথা উঠে এসেছে বারবার। রোগা না মোটা, লম্বা নাকি বেঁটে, এমনকি নারী, পুরুষ লিঙ্গভেদ জরুরি নয়, গুরুত্বপূর্ণ হল সুস্থ ও কার্যক্ষম শরীর। আর তা ধরে রাখতে সাহায্য করে এই দক্ষিণ ভারতীয় যুদ্ধরীতি।

ধাপে ধাপে শিখুন কালারি

‘কালারি’ কথার অর্থ ‘এলাকা’। ‘পায়াতু’ শব্দের অর্থ ‘যুদ্ধ’। অর্থাৎ এলাকার মধ্যে যুদ্ধ। বহু যুগ আগে গুহা তৈরি করে তার ভিতরে ছোট্ট জায়গায় মশাল জ্বালিয়ে গোপনে কালারিপায়াতু অনুশীলন করা হত। পরে প্রায় ৪২ ফুট লম্বা ও ২১ ফুট চওড়া গর্ত খুঁড়ে তৈরি হত কালারিপায়াতুর রিং। এখনও ছোট জায়গা নিয়ে তৈরি হয় কালারিপায়াতুর এরিনাগুলি। কালারিপায়াতু প্রশিক্ষক সোমা গিরি বললেন, “এর দু’টি ভাগ- সাদার্ন কালারি এবং নর্দার্ন কালারি। সাদার্নে ঢাল-তরোয়াল, ছুরি, বর্শা, ত্রিশূল, চাবুক ইত্যাদি ধারালো অস্ত্রের শিক্ষা বেশি হয়। নর্দার্নে অস্ত্রের পাশাপাশি গতিবিধির উপরে জোর দেওয়া হয়।”

  • এই প্রশিক্ষণের প্রথম ধাপ মেইথারি, যা মেরুদণ্ড শক্ত করে। প্রাথমিক ভাবে এই পর্যায়ে শিক্ষার্থীকে শারীরিক ভারসাম্য না হারিয়ে তার পা সামনে, পিছনে, পাশে এবং উপরের দিকে যে কোনও উপায়ে সরানোর প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এই পর্যায়ে শিক্ষার্থী আক্রমণের পাশাপাশি প্রতিরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপগুলি আয়ত্ত করে। তিরিশটি গতিবিধি সম্পন্ন প্রতিরক্ষার এই উপায়গুলিকে বলা হয় চুভাডু।
  • এর পর ভাদিভু অর্থাৎ অবস্থান প্রশিক্ষণ। লড়াইয়ের সময় যোদ্ধা আত্ম-সুরক্ষার জন্য বিভিন্ন পাখি বা প্রাণীর ভঙ্গি অনুসরণ করে। যেমন - গজ ভাদিভু (হাতি), সিংহ ভাদিভু (সিংহ), অশ্ব ভাদিভু (ঘোড়া), বরাহ ভাদিভু (বন্য শূকর), সরপা ভাদিভু (সাপ), কুক্কুড়া ভাদিভু (মোরগ), মার্জারা ভাদিভু (বিড়াল) এবং মৎস্য ভাদিভু (মাছ)। কালারিপায়াতুর ভাষায় এগুলিকে অষ্ট ভাদিভুকাল বলা হয়। উদাহরণস্বরূপ, সাপের ভঙ্গি যোদ্ধাকে যে কোনও দিকে দ্রুত চলাচলের জন্য পর্যাপ্ত জায়গা দেয়। ময়ূরের অবস্থান প্রসারিত অস্ত্র-সহ যোদ্ধাকে শত্রুর উপর আক্রমণ করার আগে, তার থেকে দেহের নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রাখতে সাহায্য করে।
  • আত্মরক্ষার জন্য, শত্রুর মোকাবিলা করার জন্য, পাল্টা আক্রমণ করার বা পালানোর জন্য ঠিক কৌশল নির্বাচন প্রয়োজন। তাই কালারিপায়াতুর শিক্ষার তৃতীয় ধাপ হল সেই প্রশিক্ষণ, আদাভু বা কৌশল।

প্রাথমিক এই শিক্ষা সম্পন্ন হওয়ার পর শুরু হয় বিশেষ শিক্ষা

  • কালারিপায়াতুর গুরুত্বপূর্ণ ধাপ ভেরুমকাই। এর অর্থ খালি হাতে লড়াই। ভেরুমকাই সশস্ত্র বা নিরস্ত্র শত্রুর বিরুদ্ধে নিজেকে রক্ষা করতে এবং শারীরিক ভাবে শত্রুকে পরাজিত করতে ব্যক্তির নিজের শরীরকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করার প্রশিক্ষণ দেয়। একই সঙ্গে প্রতিরক্ষা এবং আক্রমণ করতে শেখালেও, ভেরুমকাই কী ভাবে শত্রুর কবল থেকে পালাতে হয় তাও শেখায়।
  • এর পর কোলথারি। এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের লাঠিযুদ্ধ শেখানো হয়। তা ছাড়া রয়েছে অঙ্গাথারি। এতে বর্শা, উরুমি, ছুরি ইত্যাদি ধারালো অস্ত্রের ব্যবহার শেখানো হয়। কোলথারির উপর একবার দক্ষতা অর্জন করলে, অঙ্গাথারি শেখা কিন্তু সহজ।
  • আগুন দিয়ে শেষ হয় কালারিপায়াতু শিক্ষা। কাঠ, স্টিল, লোহা, ধারালো-ভোঁতা ইত্যাদি অস্ত্র শিক্ষা সম্পূর্ণ হলে তবেই আগুন শিক্ষা দেওয়া হয়।

নির্দেশাবলি

  • কালারিপায়াতু এক ধরনের যুদ্ধ কৌশল। তবে এটি আক্রমণের জন্য নয়, কেবল আত্মরক্ষার জন্য ব্যবহার করা উচিত। শিক্ষার প্রাথমিক নির্দেশই হল, এই কৌশলের অপব্যবহার করে স্বার্থসিদ্ধি করতে কোনও ব্যক্তিকে আক্রমণ করা যাবে না।
  • পাশাপাশি, লক্ষ্য রাখতে হবে, অভ্যাসকালে নানা অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহার করা হলেও, ইচ্ছাকৃত ভাবে কেউ যেন আহত না হয়।

অভ্যাসের খুঁটিনাটি

সোমা বলছেন, “কালারিপায়াতু শুরুর জন্যে রয়েছে কিছু নিয়ম। প্রথমেই কালারির জন্য শরীরকে তৈরি করতে হয়। এবং একবার শুরু করলে স্থির চিত্তে মনোনিবেশ করে একাগ্রতার সঙ্গে তা শেখা উচিত। যোগ দিয়ে শুরু হয় শিক্ষা। সূর্যোদয়ের আগে থেকে আরম্ভ করে সকালে তিন-চার ঘণ্টা অভ্যাস করা হয়। অন্তত দু’ থেকে তিন মাস শিখলে শারীরিক উন্নতি চোখে পড়ে। তিন বছর পর থেকে অস্ত্র শিক্ষা করার অনুমতি পাওয়া যায়, তাও নির্ভর করে দক্ষতার উপর। সম্পূর্ণ কালারিপায়াতু শিখতে কম করেও অন্তত পাঁচ বছর সময় লাগে।”

কারা করবেন?

বয়স এ ক্ষেত্রে বাধা না। তিন-চার বছর বয়সেই আপনার খুদেটিকে কালারিপায়াতুতে ভর্তি করতে পারেন। একইসঙ্গে শিখতে পারেন আপনি নিজেও। সোমা গিরির কথায়, “পঞ্চাশ-ষাট বছর বয়সেও অনায়াসে শেখা যায় কালারিপায়াতু। শারীরিক কোনও সমস্যা, ব্যথা কিংবা কোনও চোটের কারণে অনেকসময়ে জিম করা যায় না। কিন্তু এ ক্ষেত্রে কোনও সমস্যা হয় না। অতীতে মেয়েরা কালারিপায়াতু করত না, এখন সে প্রথা বদলেছে। পৃথিবীতে নারী কালারিপায়াতু প্রথম শুরু হয় কেরালায়। একে ‘পেন ফাইট’ বলা হয়।”

মার্মাথেরাপি

কালারিপায়াতুর অন্যতম একটি অংশ মার্মাথেরাপি। ঈশ্বরের আপন দেশেই এর জন্ম। সোমা গিরি জানালেন, কালারিপায়াতু করলে তো বটেই, তা ছাড়াও কিন্তু মার্মাথেরাপি উপকারী। কারণে-অকারণে ঘাড়ে, কোমরে ব্যথা, পেশিতে খিঁচ ধরার সমস্যায় ভুগতে হয় অনেককেই। এর থেকেই মুক্তি দিতে পারে মার্মাথেরাপি। এর মাধ্যমে নানা ভেষজ তেল দিয়ে শরীরের ১০৮টি বিশেষ পয়েন্টে মাসাজ করা হয়, যা শরীরকে সচল করে তোলে, যাবতীয় ব্যথা যন্ত্রণা সারিয়ে দেয়।

খাদ্যাভ্যাস

এ ক্ষেত্রে খাবারদাবার নিয়ে কোনও নির্দিষ্ট নিয়ম নেই। তবে কেরালার আবহাওয়ার সঙ্গে অন্যান্য জায়গার তফাত আছে, যার প্রভাব শরীরের উপর পড়ে। তাই শিক্ষার্থীরা কিছু নিয়ম মেনে চলেন।

  • কালারি করলে শরীর গরম হয়। তাই, মাংস বা ডিমের কুসুম এড়িয়ে চলা ভাল। কালারিপায়াতু গুরু-শিষ্যরা অনেকেই নিরামিষাশী। তবে তা হওয়া জরুরি না। সীমিত পরিমাণে মাছ ও ডিমের সাদা অংশ খাওয়া যায়।
  • সোমা গিরির মতে, শরীর ঠান্ডা রাখতে ধনে জল, জিরা জল ইত্যাদি খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। এ ক্ষেত্রে চার-পাঁচটি ধনে বা জিরা এক লিটার জলে ফুটিয়ে নেওয়া হয়। ভাতের মাড়কে পাতলা করেও খাওয়া হয়। কালারিপায়াতু অভ্যাসের পর এই জল খাওয়া জরুরি। চাইলে এ ধরনের জল সারাদিনই খেতে পারেন।

কেন করবেন?

  • রোগ মুক্তি: এখন অধিকাংশ মানুষের সময় কাটে মোবাইল-ল্যাপটপে ঘাড় গুঁজে। ফলে শরীরে বাসা বাঁধে নানা রোগ। বাড়ে ঘাড়, কোমরের যন্ত্রণা, যা থেকে মুক্তি দিতে পারে মার্মাথেরাপি ও কালারিপায়াতু। পাশাপাশি অন্যান্য কিছু রোগ মুক্তিতেও কালারিপায়াতু অব্যর্থ। মেয়েদের ঋতুকালীন নানা সমস্যা দূর হয়। অনিয়মিত ঋতুস্রাব, তলপেট, কোমরে ব্যথা ইত্যাদির হাত থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব হয়। কালারিপায়াতুতে শ্বাসনিয়ন্ত্রণ জরুরি। এর নিয়মিত অভ্যাসে হার্টের সমস্যার থেকেও রেহাই পাওয়া যায়।
  • ওজন হ্রাস: এতে শরীরের আকার-আকৃতি ঠিক থাকে, ওজন নিয়ন্ত্রণে থাকে। জিম, সাঁতার ইত্যাদি ছেড়ে দিলে ওজন বাড়ার সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু কালারিপায়াতুতে সে সমস্যা নেই।
  • মানসিক উন্নতি: নিয়মিত অভ্যাসে মন, আত্মা ও শরীরের উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ আসে। অবসাদ, বিরক্তি, অমনোযোগিতা থেকে রেহাই পাওয়া যায়। শারীরিক কমনীয়তা চলে গিয়ে, পেশির শক্তি বৃদ্ধি হয়। ধৈর্য, সংযম, আত্মবিশ্বাস বাড়ে।
  • কেরিয়ারে সুবিধা: দেশ জুড়ে কালারিপায়াতু নিয়ে উৎসাহ বাড়ছে। আজকাল বিভিন্ন স্কুল বা ফাইটিং ট্রেনিং সেন্টারগুলিতে কালারিপায়াতু শেখানো হয়। ছবিতেও কালারিপায়াতু অ্যাকশন ফর্মের চাহিদা বাড়ছে। সুস্মিতা সেন, শ্রাবন্তী চট্টোপাধ্যায়-সহ একাধিক নায়িকা এখন কালারি শিখছেন। তাই, উৎসাহ থাকলে বিকল্প কেরিয়ার হিসেবেও কালারিপায়াতু বাছতে পারেন। তা ছাড়া, ছোট থেকে এর অভ্যাস ভবিষ্যতে আপনার সন্তানকে পুলিশ ও মিলিটারিতে যোগ দিতে সাহায্য করতে পারে। থিয়েটার করেন যাঁরা, তাঁদের শারীরিক ভঙ্গিমা এই অভ্যাসে বেশি আকর্ষক হয়ে উঠবে।

কালারিপায়াতুর উপকার যেমন বহুমুখী, তেমনই তা ব্যয়সাপেক্ষও। দক্ষিণ ভারতের নানা জায়গা থেকে কালারিপায়াতু শিক্ষার্থীরা এখন দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে পড়েছেন। বিভিন্ন জায়গায় কালারিপায়াতু প্রশিক্ষণ কেন্দ্রও শুরু হয়েছে। তবে মনে রাখবেন, দিনে কেবল দু’-চার ঘণ্টা অভ্যাস করলেই হয় না, কালারিপায়াতু এক ধরনের যাপন। প্রাচীন এই পদ্ধতি কিন্তু বিজ্ঞানসম্মত।

অন্য বিষয়গুলি:

Kerela Martial Art
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy