Advertisement
২৪ নভেম্বর ২০২৪
বড় একা লাগে-৩

চল্লিশ পেরোলে নিজেকেও সময় দিন

সন্তান বিদেশ বিভুঁই চলে গেলে অনেক সময় স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের কঙ্কাল বেরিয়ে পড়ে। তার আগে ছড়িয়ে দিন নিজের সত্ত্বাকে। মনোরোগ চিকিৎসক রিমা মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে কথা বললেন সোমা মুখোপাধ্যায়। প্র: এটা তো ভারী অদ্ভুত! সন্তান যথেষ্ট সফল না হলে অবসাদ-হতাশা, আবার সফল সন্তানকে ঘিরেও স্বস্তি নেই। এখন কি বাবা-মায়ের যাবতীয় অবসাদের উৎসই সন্তান?

শেষ আপডেট: ০৩ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০০:০০
Share: Save:

প্র: এটা তো ভারী অদ্ভুত! সন্তান যথেষ্ট সফল না হলে অবসাদ-হতাশা, আবার সফল সন্তানকে ঘিরেও স্বস্তি নেই। এখন কি বাবা-মায়ের যাবতীয় অবসাদের উৎসই সন্তান?

উ: না, অদ্ভুত নয়। বরং একটা বয়সের পরে এখন এটাই খুব চেনা ছবি। বাবা-মায়েরা ইদানীং এতটাই সুরক্ষাবলয়ে ঢেকে রাখতে চান ছেলেমেয়েদের, যে সেটাই তাঁদের কাছে অভ্যাস হয়ে দাঁড়ায়। যখন সন্তান স্বাবলম্বী হয়, নিজের সিদ্ধান্ত নিজেই নিতে শেখে, তখন বাবা-মায়ের সেই অভ্যস্ততায় চিড় খায়। তখন অনেকেই নিজেদের অবহেলিত ভাবতে থাকেন। অভিমানে গুটিয়ে যান। মানসিক সমস্যা আস্তে আস্তে ভিতরে শিকড় চাড়িয়ে যেতে শুরু করে। পরে সন্তান চাকরিসূত্রে দূরে গেলে সেই অবসাদই তাঁদের ঘিরে ফেলে।

প্র: তা হলে উপায়?

উ: অবসাদকে বাড়তে দেবেন না। একটা সময়ে এই সমস্যাটা অচেনা ছিল। এখন তো অনেকেই এ সম্পর্কে সচেতন। তাই কিছুটা সুবিধাও আছে। যদি টের পান, মনে কোনও কিছু জমছে, তা হলে সেটা বার করার চেষ্টা আপনাকেই করতে হবে। রাগকে যেমন বাসি হতে দিতে নেই, অবসাদকেও তেমনই শিকড় গাড়তে দিতে নেই। প্রথমেই উপড়ে ফেলুন।

প্র: কী ভাবে?

উ: উপায় আছে। সাধারণত একই পরিবারে বাবা-মা দুজনেই এই সমস্যায় ভুগছেন, তা হয় না। হয়তো সন্তান দূরে যাওয়ায় তাঁদের একজন অবসাদে ভুগছেন। অভিমানে সরে থাকছেন। অন্যজন কিন্তু পরিবর্তনটা নিজের মতো করে মানিয়ে নিয়েছেন। সে ক্ষেত্রে তাঁরই উচিত অপরজনের হাত ধরে টেনে তোলা। তা ছাড়া, ছেলেমেয়েরাও তো বাবা-মায়ের পরিবর্তনটা টের পায়। সেটা কাটিয়ে ওঠা শেখাতে অনেক আগে থেকেই তাদেরও সক্রিয় থাকা উচিত।

নিজেদের ভালো লাগার কিছু দিককে বাবা-মাও যাতে পরিচর্যা করতে শেখেন, সেটা দেখার দায়িত্ব কিন্তু তাদেরও। কারণ তাদের জগৎটা অনেক বিস্তৃত।

প্র: ধরা যাক, তার পরেও কাজ হল না। সন্তানের নিজস্ব জগৎ গড়ে ওঠার পরে বাবা কিংবা মায়ের, কিংবা দুজনেরই অবসাদ বাড়তেই থাকল। তখন?

উ: সে ক্ষেত্রে অবশ্যই সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে যাওয়া উচিত। চিকিৎসা না করে ফেলে রাখা অবসাদ পরবর্তী সময়ে মারাত্মক হয়ে উঠতে পারে। এমন কী এ থেকে অ্যালজাইমার্সের ঝুঁকিও থাকে। আসল কথা হল, অবসাদ, হতাশা মস্তিষ্কের স্বাভাবিক কাজগুলোকে বাধা দেয়। দিনের পর দিন এটা চলতে থাকলে তার পরিণতি খুবই ক্ষতিকর হতে পারে।

প্র: যাঁরা একটা সময়ে ছেলেমেয়ের জন্য অনেক কিছু ত্যাগ করেছেন, অনেক সময় দেখা যায় বয়স বাড়লে তাঁরাই বেশ স্বার্থপর হয়ে উঠছেন। নিজেকে ছাড়া অন্য কিছু ভাবতে চাইছেন না। এ থেকে সম্পর্কে নানা ভুল বোঝাবুঝি, জটিলতা তৈরি হচ্ছে। এটা কেন?

উ: এরও মূলে কিন্তু ওই একাকীত্ব। আর কিছুটা অভিমান। অনেকেই ভাবতে থাকেন, ‘আমি ছেলেমেয়েকে বড় করে তুলতে গিয়ে নিজেকে সময় দিইনি। এখন ওরা নিজেদের জীবন নিয়ে ব্যস্ত। তাই আমিও আমার যা খুশি সেটাই করব।’ এতে তাঁদের চারিত্রিক গঠনটাই অনেক সময়ে বদলে যায়। পরিচিতরা তাঁদের এই বদলটা সহজে মেনে নিতে পারে না। কিন্তু এঁরা সে সব বিশেষ পাত্তা দেন না। বরং তাঁরা নিজেদের আচরণের সপক্ষে হাজারটা যুক্তি খাড়া করেন। এ ক্ষেত্রে পরিবারের বাকিদের তাঁদের সমস্যাটা বুঝতে চেষ্টা করা উচিত।

প্র: কিন্তু শুধু বুঝলে তো হবে না। সেটা থেকে ওঁদের বার করা হবে কী করে?

উ: সেটা থেকে বার করার জন্য ওঁদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে হবে। সময় দিতে হবে। অভিমানী মানুষগুলোকে বাড়ির বাইরে নিয়ে যেতে হবে। যা তাঁরা ভালবাসেন, সে সব করার সুযোগ দিতে হবে। সে ক্ষেত্রে ছেলেমেয়েকেই ছুটিছাটায় এসে অনেকটা দায়িত্ব নিতে হবে।

প্র: ইদানীং দেখা যাচ্ছে, ছেলেমেয়ে দূরে যাওয়ার পরে স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক সম্পর্কেও নানা পরিবর্তন আসছে। এমনকী বিয়ে ভেঙেও যাচ্ছে!

উ: আসলে বহু বিবাহিত সম্পর্কই টিকে থাকে ছেলেমেয়ের কথা ভেবে। তাদের জন্যই স্বামী বা স্ত্রী নিজেদের নানা অপছন্দ, অতৃপ্তি ঢেকে রাখেন। ছেলেমেয়ে ‘বাফার’ হিসেবে থাকে বলেই অশান্তিও চাপা প়ড়ে থাকে। তারা বাড়ি ছাড়লেই সম্পর্কের কঙ্কালটা সামনে চলে আসে। তখন ‘আমি কী নিয়ে থাকব’ সেই চিন্তাটা বড় হয়ে ওঠে।

একাকীত্ব বেড়ে যায়। আবার অনেক সময় এমনও হয় যে, ছেলেমেয়ে দূরে গেলে তাঁদের সম্পর্কের আসল চেহারাটা নিজেদের কাছেই বেআব্রু হয়ে পড়বে সেটা ভেবে বহু বৃদ্ধ দম্পতি আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। এঁদের কাউন্সেলিং দরকার হয়।

অনেক সময়ে ছেলেমেয়েরাই আমাদের চেম্বারে বাবা-মাকে নিয়ে আসে। কারণ দূরে থাকে বলে তাদের চিন্তাও বাড়ে। তাই কী ভাবে বাবা-মায়ের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান সম্ভব সেই চেষ্টাটা সন্তানদেরই চালাতে হয়।

প্র: এই জটিলতাকে এড়িয়ে ভালভাবে বাঁচার রাস্তাটা তা কী?

উ: যেটা আমি আগেও বলেছি, সেটাই আবারও বলব। ভাল থাকার প্রথম শর্তই হল, শরীরটাকে ভাল রাখা। আমাদের কাছে এমন অনেকে আসেন যাঁরা হাঁটুর ব্যথায় হাঁটতে পারেন না, কিংবা চোখের সমস্যা রয়েছে অথবা কানে কম শোনেন। এতে আত্মবিশ্বাসটা কমে যায়।

অন্যের সঙ্গে ‘কমিউনিকেট’ করতে পারেন না। বাড়িতে একা থাকেন, অথচ বাইরে বেরনোরও উপায় নেই। আমার পরামর্শ, এই সমস্যার কথা আগাম ভেবে রেখেই নিজের শরীরটাকে ঠিক রাখুন।

ওজন বাড়তে দেবেন না। ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া করুন। ব্যায়াম করুন। চোখ-কান-দাঁতের ডাক্তারের সাহায্য নিন। ৪০ পেরোলে ছেলেমেয়েকে সময় দেওয়া যতটা জরুরি, নিজেকে সময় দেওয়াও ততটাই জরুরি।

আর একটা কথা খেয়াল রাখবেন, এটাই কিন্তু আদর্শ সময় নিজের সত্তাকে ছড়িয়ে দেওয়ার। আমরা যেটাকে বলতে পারি ‘এক্সটেন্ডেড ফ্যামিলি’। প্রতিবেশীদের সঙ্গে ভাল সম্পর্ক বজায় রাখুন। প্রয়োজনে পরস্পরের পাশে থাকুন।

বাড়িতে কাজের লোক যাঁরা রয়েছেন, তাঁদেরও পাশে থাকুন নানাভাবে। তাঁদের বাচ্চাকে পড়ানো থেকে শুরু করে অসুস্থতায় ডাক্তারের ব্যবস্থা করা, অনেক কিছুই করতে পারেন আপনি।

উন্নাসিকতা ঝেড়ে ফেলতে পারলে দেখবেন, এই মানসিক আদানপ্রদানই আপনাকে একা হতে দিচ্ছে না। নানাভাবে আপনি এতটাই ব্যস্ত থাকছেন যে তার ফাঁক গলে অবসাদ উঁকিঝুঁকি মারার সাহসটুকুও পাচ্ছে না।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy