ছাপচিত্র: শিল্পী শুভাপ্রসন্নর একক প্রদর্শনীর চিত্রকর্ম
দক্ষিণ কলকাতার ‘ছবি ও ঘর’ গ্যালারিতে সম্প্রতি পরিবেশিত হল বর্ষীয়ান শিল্পী শুভাপ্রসন্নের বেশ কিছু চমৎকার ছাপাই ছবি। শিল্পীর চিত্রকলা দর্শকদের কাছে সুপরিচিত হলেও তাঁর ছাপাই ছবির সম্ভার দেখার সুযোগ তুলনায় কম ঘটে। সুতরাং বহুমুখী এই শিল্পীর কয়েক দশকের বাছাই করা কিছু ছাপাই ছবি দিয়ে এই প্রদর্শনী আয়োজন করার জন্য সিওজি ইন্ডিয়া আর্ট ফাউন্ডেশন এবং গ্যালারির তরুণ কর্মকর্তাদ্বয় অঙ্কিতা ও সৈকত মণ্ডল বিশেষ প্রশংসার দাবি রাখেন।
ছাপাই ছবি এক অতীব প্রাচীন মাধ্যম। সেই প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে মানুষ তার নিজের হাতের ছাপ দিয়ে হয়তো বা এই যাত্রার সূচনা করেছিল। পরে বহু রকমের পরীক্ষানিরীক্ষার মাধ্যমে প্রিন্টমেকিং বিষয়টি এক গুরুত্বপূর্ণ মাত্রা পায় ও নানা শাখাপ্রশাখায় বিস্তার লাভ করে— যেমন উডকাট, এনগ্রেভিং, লিথোগ্রাফি, এচিং, ইন্টাগ্লিয়ো, ড্রাই পয়েন্ট, লিনোকাট ইত্যাদি। সনাতনী এই সব মাধ্যমের সঙ্গে আধুনিক প্রযুক্তিকরণের সংমিশ্রণে জন্ম নেয় স্ক্রিনপ্রিন্টিং, শিনকোল ইত্যাদি। তবে এই প্রদর্শনীতে মূলত ইন্টাগ্লিয়ো মাধ্যমের কাজই বেশি দেখা যায়। আলোচনার সুবিধার্থে সংক্ষেপে জেনে নেওয়া যাক যে, রিলিফ প্রিন্টমেকিং ও ইন্টাগ্লিয়ো প্রিন্টমেকিংয়ের মধ্যে পার্থক্য ঠিক কী রকম। রিলিফ প্রিন্টের ধাতুর পাতটি খোদাই করা হয় এবং ইন্টাগ্লিয়ো প্রিন্টে আগে ধাতুর পাতে রেখাগুলি চেরা বা কাটা হয়, পরে কালির প্রলেপ লাগিয়ে সেই ইঙ্কড ইমেজটি কাগজে স্থানান্তরিত করা হয়। আধুনিক কালে ব্যাঙ্ক নোট, পোস্টেজ স্ট্যাম্প, পাসপোর্ট ইত্যাদির ক্ষেত্রে এই মাধ্যমব্যবহার করা হয়। এই মাধ্যমে কাজ করার জন্য ব্যুরিন অথবা গ্রেভার ব্যবহার করা হয়। সুতরাং শিল্পীকে অত্যন্ত নিশ্চিত ও সুদৃঢ় ভাবে ধাতুপাতের উপরে রেখাগুলির বিন্যাস ঘটাতে হয়।
শিল্পী শুভাপ্রসন্ন প্রিন্টমেকিংয়ের এই সব প্রকরণগত দক্ষতা আয়ত্ত করেই সৃষ্টি করেছেন তাঁর এই অনবদ্য সম্ভার। প্রাণিজগতের বিষয় অবলম্বনে কাজের সংখ্যাই বেশি লক্ষণীয়— যেমন কাক, পেঁচা, ছাগল, শূকর, গাধা ইত্যাদির রূপই বারে বারে ফিরে এসেছে৷ আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় ‘কাক’ নিত্যসঙ্গী। কিন্তু শিল্পীর নজরে এই কাক রূপান্তরিত হয়ে ওঠে এক ছন্দোময় আখ্যানে। কাকের চোখ, তার ঠোঁট, অন্য কাকের সঙ্গে তার আলাপচারিতা ইত্যাদির রূপগুলি যেন একশৈল্পিক রসে জারিত হয়েইদৃশ্যময় হয়ে উঠেছে। বিষয় যত সাধারণই হোক না কেন— শিল্পীর দেখা, তাঁর ভাবনা ও কল্পনারমধ্য দিয়ে রূপগুলি পেয়েছে এক অনন্য মাত্রা।
প্রাণিজগতের এই সব পাখি ও পশুর বাহ্যিক আকারগুলি শিল্পী নিজের মতো করে কখনও স্ফীত তো কখনও সঙ্কুচিত করে কাগজের মাঝে যে ভাবে উপস্থাপন করেছেন, তাতে সেগুলি ইমারতি গুণসম্পন্ন (আর্কিটেক্টনিক) চরিত্র পেয়েছে। দীর্ঘ শিল্পচর্চা ও গভীর চিন্তনের মাধ্যমেই রূপের এই খেলা সম্ভবপর হয়ে ওঠে। সেই সঙ্গে রেখার দৃঢ়তা, বুনটের ঘনত্ব, আকারের পরিমিতি ও ছাপাইয়ের পরিচ্ছন্ন প্রতিলিপি কাজগুলিকে এক অসাধারণ মাত্রা প্রদান করেছে। প্রায় চার দশকের পরিধির মধ্যে ব্যপ্ত শিল্পীর এই সম্ভার দর্শকের সঙ্গে তাঁর বহুমাত্রিক শিল্পসাধনার পরিচয় ঘটায়। সেই সঙ্গে বেশ কিছু বইয়ের প্রকাশনা, তাঁর আত্মকথা ইত্যাদি এই দীর্ঘ শিল্পজীবনের নানা উল্লেখযোগ্য অধ্যায়কে জানতে ও বুঝতে সাহায্য করে। শিল্পী শুভাপ্রসন্ন সাধারণ মানুষকে শিল্পবোধে জাগরিত করতে যে প্রয়াসে উদ্যমী, তা অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy