ঐশ্বরিক: যোগেন চৌধুরীর প্রদর্শনীর চিত্রকর্ম। —ফাইল চিত্র।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে আগামী বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এক বছর ধরে প্রত্যেক মাসেই শিল্পী যোগেন চৌধুরীর নতুন এক শিল্পসম্ভারকে সমাদৃত করে চলেছে দেবভাষা গ্যালারি। গত ১১ নভেম্বর শিল্পীর চিত্রপ্রদর্শনীর মধ্য দিয়ে তাদের বিজয়া অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। প্রদর্শনীর নাম, ‘বিজয়া চিত্র প্রদর্শনী’, যার বিষয়বস্তু ছিল ‘গড অ্যান্ড গডেস’। এই প্রদর্শনীতে দর্শক শিল্পীর আঁকা নতুন দশটি ছবি দেখতে পেলেন। এ ছাড়াও গ্যালারির পক্ষ থেকে একটি স্কেচ খাতা বার করা হয়েছে। অসংখ্য স্কেচ ছাড়াও সেখানে লিপিবদ্ধ করা আছে যোগেন চৌধুরীর সেই সময়কার শিল্পচিন্তা। তাঁর অত্যন্ত আধুনিক এবং নিজস্ব চিন্তাধারা হয়তো নতুন প্রজন্মের অনেক শিল্পীকেই শিল্পের চিরাচরিত বেড়াজাল থেকে বার করে এনে মুক্তির পথ দেখাতে পারে।
বাংলাদেশের ফরিদপুরের জমিদার বাড়িতে পুজোর সময়ে মূর্তি গড়তে যখন লোক আসত, সেই সময় খড় বাঁধা থেকে শেষ পর্যন্ত কিশোর যোগেন চৌধুরী দেখেছেন। রঙের সঙ্গে তাঁর পরিচয় সেই বাল্যবয়স থেকেই। ‘সাক্ষাৎকার’ বইয়ে শিল্পী বলছেন যে, ‘মূর্তি গড়া দেখতে দেখতে আমার হাতও মূর্তি গড়তে চাইতো।... সম্ভবত ওখানে না থাকলে কোনও ভাবেই শিল্পকে এত নিবিড় ভাবে দেখার অভ্যাস আমার তৈরি হত না।’
যোগেন চৌধুরী ঈশ্বরের অস্তিত্ব বিষয়ক ভাবনা নিয়ে ভেবেছেন যথেষ্ট। মূলত প্রকৃতির মধ্যকার বিস্ময়কর রহস্যময়তাই তাঁর ঈশ্বর সম্পর্কে বিশ্বাসের মূল কারণ। অসীম শূন্যতার মধ্যে বস্তু কোথা থেকে এল, তাই নিয়ে ভেবেছেন নিরন্তর। প্রাণিজগতে এত যে বৈচিত্র, পাখির পালকের রং, ফুলের বিচিত্র সব গড়ন এবং বর্ণ— এ সব কে স্থির করল? কার ইচ্ছেয় প্রকৃতি চলে? সৃষ্টির এই বিশাল কর্মকাণ্ডের পিছনে কার হাত? তাঁর ধারণা উচ্চতম বুদ্ধিসম্পন্ন জীব মানুষই, রহস্যের মূল খুঁজতে গিয়ে এক কাল্পনিক ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস করেছে। আর ‘ধর্মভিত্তিক ঈশ্বর’-এর উপর তাঁর যথেষ্ট সন্দেহ আছে। যোগেন চৌধুরীর একেবারে অন্তরের বিশ্বাস, যে ভাবে বিবেকানন্দ বলেছেন সে ভাবে ঈশ্বরকে আমরা প্রত্যেক দিনই দেখি। কারণ সব মানুষের মধ্যেই তার বাস— ‘বহুরূপে সম্মুখে তোমার, ছাড়ি কোথা খুঁজিছ ঈশ্বর’।
খুব সম্ভবত এই দর্শনে বিশ্বাস রেখেই শিল্পী ছবিগুলি এঁকেছেন। সমস্ত ছবিতেই রেখার জোর অসামান্য। রঙের ব্যবহার সামান্য হলেও গুরুত্বপূর্ণ। আর দেবদেবীর অলঙ্করণেও প্রচুর নতুনত্ব দেখা গেল। এ ছাড়াও এঁদের মুখের ভাব বা অভিব্যক্তি বড় সুন্দর। কিন্তু তাঁর ওই বিশ্বাসের কারণেই হয়তো মানুষের এই কাল্পনিক ঈশ্বরে স্বর্গীয় ভাবের একটু অভাব তিনি ইচ্ছাকৃত ভাবে রেখে দিয়েছেন।
প্রদর্শনীতে যে সব ছবি দেখা গেল, সেখানে গণেশের দু’টি প্রতিকৃতি আছে। কাগজের উপরে মিশ্র মাধ্যমে করা। দু’টি ছবিতেই গণেশকে ঠিক দেবতা হিসেবে দেখানো হয়নি। সাধারণ মানুষের মতো বসে আছেন। প্রথমটিতে মানুষ যে রকম কিছু না মনে পড়লে দুই হাত দিয়ে মাথা চুলকান, সে রকম ভাবে গণেশ বসে আছেন। তাঁর দুই হাত মাথার উপরে, আর অন্যটিতে দুই হাত উপর দিকে ঠেলে যেন খানিকটা আড়মোড়া ভাঙার মতো ভঙ্গি। এ ভঙ্গিমা মানুষেরই, দেবতার নয়। ঠিক দেবতা হিসেবে গণেশকে দেখানোর চেষ্টা করেননি শিল্পী।
দু’-তিনটি দেবী মূর্তির ছবিও দেখা গেল। একটি কালী মূর্তি চিত্রাঙ্কিত করা হয়েছে। এটিতে তৃতীয় নয়ন এবং বাইরে জিহ্বা দেখে কালী বলে বোঝা যায়, কিন্তু ভয়ঙ্কর ভাব চোখেমুখে দেখা গেল না। খুব শান্ত, ঘরোয়া এক মহিলার মুখাকৃতি।
এ ছাড়া আরও দু’টি দেবী মূর্তির ছবি ছিল প্রদর্শনীতে। শিল্পী যোগেন চৌধুরী এখানেও অলঙ্করণের আতিশয্য এবং ওই মূর্তিযুগলের বিস্ফারিত নয়ন ছাড়া আর কোনও ভাব জাগানোর চেষ্টা হয়তো করেননি। এই সব কাজই কাগজের উপরে মিশ্র মাধ্যমে করা হয়েছে।
এ বারে যে ছবিটির কথা বলা দরকার, সেখানে একটি দেবী মূর্তি দেখা যায়। তার উন্মুক্ত কেশ, বক্ষযুগল উন্মোচিত, চোখে কীসের যেন অজানা আশঙ্কা। এই মূর্তিকে কিন্তু যোগেন চৌধুরী দেবীর আসন থেকে নামিয়ে মানবীর আসনেই বসিয়েছেন। এ নারীমূর্তি পৃথিবীর, ধরাছোঁয়ারই পাত্রী।
এ বার দেখা গেল একটি পুরুষের মুখ। মুখটি একটু ফেরানো। মাথায় মুকুট, গলায় কণ্ঠহার, কপালে তৃতীয় নয়ন এবং বিস্ফারিত চোখ। মুখের অভিব্যক্তি কোনও এক বিশিষ্ট মানুষের, সে অধিকর্তা, রাজা বা বাদশা— এই ধরনের কোনও মানুষ।
যে শিল্পী মূর্তির মধ্যে ঈশ্বর সেই ভাবে দেখেন না, মূর্তি তো তাঁর কাছে তাঁর মনের মাধুরী মেশানো শিল্পকর্ম মাত্র। সেই শিল্পকর্মে প্রাণপ্রতিষ্ঠা নাই বা করলেন শিল্পী। যোগেন চৌধুরীর এই প্রদর্শনী নতুন শিল্পীদের কাছে অনেক পথ খুলে দিতে পারে।
শমিতা বসু
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy