ছোট ছোট রংবেরঙের কাপড় জুড়ে কাঁথা-আসন তৈরি কিংবা পুরনো শাড়ির পাড় নিয়ে বাড়ির খুদে সদস্যের জামায় নকশা করে দেওয়া... বাঙালি বাড়িতে মা-দিদিমাদের হাতের কাজের এমন উদাহরণ বিস্তর। টুকরো টুকরো কাপড় দিয়ে নতুন কিছু বানিয়ে নেওয়ার কায়দা এখন ফ্যাশন দুনিয়ায় সামনের সারিতে, যাকে আধুনিক পরিভাষায় প্যাচওয়ার্ক বলা হয়। বাংলার সংস্কৃতিতে এই প্যাচওয়ার্ক কিন্তু আদি ও অকৃত্রিম। বাউল-ফকিরদের কথা মনে করুন, পোশাকের ফুটোফাটা ঢাকতেই নকশাদার কাপড় দিয়ে তাপ্পি দিতেন তাঁরা। এই তাপ্পির স্টাইলই পরবর্তীকালে বিশ্বের তাবড় ফ্যাশন ডিজ়াইনাররা আপন করে নিয়েছেন।
কাউবয়দের পোশাকেও প্যাচওয়ার্কের কনসেপ্ট ছিল। তবে মেনস্ট্রিম ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি এই স্টাইলকে মর্যাদা দিয়েছে অনেক পরে। ১৯৬০ সাল নাগাদ, হাই-এন্ড ফ্যাশনে জায়গা করে নিয়েছিল এই আর্টফর্ম। বলা যায় হিপি মুভমেন্ট প্যাচওয়ার্ককে জনপ্রিয় করার কাজটা তরান্বিত করেছিল।
সাসটেনেবল ফ্যাশন
সাম্প্রতিক সময়ে প্যাচওয়ার্ক এতটা জনপ্রিয় হওয়ার কারণ কী? অতিমারি-ধ্বস্ত পৃথিবী সাসটেনেবল ফ্যাশনের মর্ম বুঝেছে। সারা বিশ্বের ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি থেকে রোজ কয়েক মেট্রিক টন বর্জ্য ফেলা যেত। বাতিল হয়ে যাওয়া কাপড়ের টুকরো রিসাইকল করে তৈরি হচ্ছে নতুন পোশাক, স্কার্ফ, ব্যাগ, জুতো, টেবিল ম্যাট থেকে বিছানার চাদর, কুইল্ট। প্যাচওয়ার্ক যে সব সময়েই সুতি, সিল্ক মেটিরিয়ালেরই হবে এমন নয়। পশমিনা, ভেলভেট, জুট, লেদার যে কোনও কিছুর হতে পারে। ফ্যাশন ডিজ়াইনার অভিষেক রায় নিজে প্যাচওয়ার্ক নিয়ে কাজ করেছেন। বলছিলেন, ‘‘পুরনো শাড়ির পাড় দিয়ে পোশাকে ডিজ়াইন করেছি। এমন অনেক শাড়ি হয়, যার ভিতরের অংশটা হয়তো নষ্ট হয়ে গিয়েছে কিন্তু পাড় খুব ভাল রয়েছে। সেখানে ওই পাড় নিয়ে জ্যাকেট, ড্রেস, টপ অনেক কিছুতেই বসিয়েছি।’’ অভিষেকের কথা মনে করিয়ে দেয়, কী ভাবে দিদিমা-ঠাকুমারা শাড়ির পাড় থেকে সুতো খুলে নিয়ে কাঁথা সেলাই করতেন বা গোটা পাড়টাই বসিয়ে দিতেন আসনে, চাদরে।
হাই এন্ড ফ্যাশনে প্যাচওয়ার্ক
ফ্যাশনের কুলীন গোষ্ঠীতে ঠাঁই করে নিতে প্যাচওয়ার্কের সময় লেগেছিল ঠিকই, কিন্তু জায়গা করে নেওয়ার পরে এই আর্টফর্ম এখনও আধিপত্য বিস্তার করে রেখেছে। অন্য কাপড়ের অংশ বসিয়ে, তার সঙ্গে এমব্রয়ডারি কারুকাজ বা স্টোন এমবেলিশ করে যে জমকালো পোশাক তৈরি করা যায়, এই ধারণা পোক্ত হওয়ার পর থেকেই ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি প্যাচওয়ার্ককে আপন করে নেয়। হিপি আন্দোলন এই স্টাইলকে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দেয়। আর আগে তুরস্ক, মরক্কোর মতো মধ্য ইউরোপীয় দেশে কাফতান বা লং জ্যাকেটে এই স্টাইলের প্রচলন ছিল। আশির দশক থেকে নামী ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলো এই আর্টফর্ম ব্যবহার করতে শুরু করে।
আমজনতার ফ্যাশন
ডেনিম, জ্যাকেট, ড্রেস থেকে শাড়ি, ব্লাউজ়, কুর্তি... সবেতেই এই কনসেপ্ট গ্রহণযোগ্য। পুরনো ডেনিমকে চটকদার করতে আলমারিতে বন্দি হয়ে থাকা গুজরাতি কাজের দোপাট্টার খানিকটা অংশ কেটে ডেনিমের পকেটের কাছটায় বসিয়ে নিতে পারেন। চাইলে পাশ দিয়ে এমব্রয়ডারিও করিয়ে নিতে পারেন। পুরনো কোনও পোশাকের একটি মোটিফ হয়তো আপনার পছন্দের। সেই মোটিফ কেটে নিয়ে শার্ট, গেঞ্জিতে বসাতে পারেন। এ ভাবে সিল্ক, সুতি, ভেলভেটের বাতিল পোশাক থেকে অংশ কেটে নিয়ে জ্যাকেট, টপ, ড্রেস সব কিছুই ডিজ়াইন করা যায়। সলিড, টেক্সচার, প্রিন্ট সব রকম মিলিয়ে মিশিয়েই পোশাক ডিজ়াইন করা হয় প্যাচওয়ার্কে। এই কাজে দু’ধরনের টোন থাকে। কখনও ভিন্টেজ, অ্যান্টিক ফিনিশ দেওয়া হয়, আবার জমকালো বা বোহেমিয়ান স্টাইলও অনুসরণ করা হয়।
ডিজ়াইনার অভিষেক রায় তাঁর তৈরি পোশাকে বাঙালি ঘরানা বজায় রেখেছেন। লাল পাড় শাড়ির অংশ নিয়ে বা ঢাকাই জামদানি থেকে টুকরো বেছে নিয়ে পোশাকে প্যাচওয়ার্ক করেছেন। শাড়িতেও প্যাচওয়ার্কের কাজ অনেক দিন ধরেই জনপ্রিয়। ব্লাউজ়েও এই কারুকাজ দেখতে বেশ লাগে। কুর্তি এবং শাড়িতে প্যাচওয়ার্কের কাজ করেন ডিজ়াইনার ভাস্বতী মুখোপাধ্যায়। তিনি বলছিলেন, ‘‘কুর্তি আমাদের রোজকার সঙ্গী। সেখানে নানা রকম বৈচিত্র আনাটাই চ্যালেঞ্জ। আমি প্যাচ বসিয়ে তার সঙ্গে পাশ দিয়ে গুজরাতি, কাথিয়াওয়াড়ি কাজ করে থাকি পোশাকে। প্যাচের সঙ্গে লম্বানি ওয়ার্কও করি। এতে রিসাইকল করাও হয়, আবার সৌন্দর্যও বজায় থাকে।’’
পুরুষদের ফ্যাশনেও প্যাচওয়ার্ক জনপ্রিয়। এই কাজের শার্ট, জ্যাকেট একঘেয়ে পোশাকে বৈচিত্র আনবে। ক্যারি করতে পারলে প্যাচওয়ার্ক প্যান্টসও পরা যায়। হ্যারি স্টাইলস, জ়ায়ান মালিকের মতো তারকারা এই ফ্যাশনকে জনপ্রিয় করেছেন।
কী ভাবে সাজবেন
জমকালো প্যাচওয়ার্ক করা কোনও ড্রেস যদি পরেন, তা হলে বাকি সাজ ছিমছাম হলেই ভাল। সলিড রঙের পোশাকের সঙ্গে এই স্টাইলের শর্ট, লং যে কোনও জ্যাকেট পরতে পারেন। সে ক্ষেত্রে জুতোয় প্যাচওয়ার্ক করা থাকলে মন্দ লাগবে না। প্যাচওয়ার্ক স্কার্টের সঙ্গে সলিড কালারের টপ বেছে নিলে ভাল দেখাবে। ডেনিমে প্যাচওয়ার্ক এখন ট্রেন্ডিং। সাজে বোহেমিয়ান ফিল আনতে ডেনিমের সঙ্গে একই কাজের শ্রাগ পরতে পারেন। শাড়িতে ভারী প্যাচওয়ার্ক থাকলে ব্লাউজ় ছিমছাম হওয়াই বাঞ্ছনীয়। যদি ব্লাউজ়ের হাতা, পিঠের অংশে প্যাচওয়ার্ক থাকে, তা হলে শাড়ির জমিতে যেন ভারী কাজ না থাকে।
মডেল: জয়া আহসান, দিতিপ্রিয়া রায়, দিতি সাহা, শ্রীময়ী ঘোয
ছবি: দেবর্ষি সরকার
হেয়ার ও মেকআপ:
ডন হাসিয়ো (দিতি)
পোশাক: শূন্য- শর্বরী দত্ত (জয়া), অভিষেক দত্ত (দিতিপ্রিয়া),
অভিষেক রায় (দিতি),
নকশা- ঋজুলা দত্তরায় (শ্রীময়ী)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy