আসনখানি: শিল্পী সুশান্ত চক্রবর্তীর প্রদর্শনী চিত্রকর্ম। —ফাইল চিত্র।
সম্প্রতি অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টসে শিল্পী সুশান্ত চক্রবর্তীর একটি প্রদর্শনী হয়ে গেল। এখানে তাঁর ছাপাই ছবি ছিল না। সেই জায়গায় তিনি তেলরং এবং অ্যাক্রিলিকে করা বেশ বড় বড় কিছু ক্যানভাস দর্শককে উপহার দিলেন এই প্রদর্শনীতে।
সুশান্ত চক্রবর্তী ১৯৭৭ সালে বিজ্ঞানের স্নাতক হওয়ার পরে ভারতীয় আর্ট কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন। মাস্টার প্রিন্টমেকার হরেন দাসের কাছে ১৯৮১ থেকে ’৮৫ পর্যন্ত শিক্ষাগ্রহণ করেন। এ ছাড়াও সনৎ কর, লালুপ্রসাদ সাউ, অমিতাভ বন্দ্যোপাধ্যায়, শ্যামল দত্ত রায়ের সান্নিধ্যে শিক্ষালাভ করেছেন বিভিন্ন সময়ে। সুশান্ত তাঁদেরই উত্তরসূরি।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে বাবা-মায়ের সঙ্গে অধুনা বাংলাদেশ থেকে হাওড়া অঞ্চলে চলে এসেছিলেন সুশান্ত। অনেক কষ্টের মধ্য দিয়ে মানুষ হয়েছেন বলে পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি তাঁকে বেশ কিছুটা সমাজ সচেতন করে তুলেছে। তবে এই সচেতনতা সুশান্ত চক্রবর্তীর শিল্পে কোনও তিক্ততা সৃষ্টি করেনি, বরং অনেকটাই গভীরতা এনে দিয়েছে।
এই প্রদর্শনীতে কয়েকটি কাজ বাদে, বড় বড় ক্যানভাসের সব ক’টি শিল্পকর্মই গত এক বছরে আঁকা। এত কাজ এত অল্প সময়ে সুশান্ত চক্রবর্তী কী করে সম্পন্ন করলেন, ভাবলে অবাক হতে হয়। ১৯৬৪ সালে প্রতিষ্ঠিত ‘ক্যালকাটা পেন্টার্স’ গ্ৰুপের সদস্য তিনি। প্রিন্টমেকিংয়ে তাঁর দক্ষতা সর্বজনবিদিত।
প্রদর্শনীর মূল ভাবনাটি চেয়ার-কেন্দ্রিক। চেয়ার এখানে প্রধানত ক্ষমতার প্রতীক। অতি সাধারণ, নিত্য-ব্যবহৃত এই চেয়ারের প্রতি মানুষের লোভ, আসক্তি, আকাঙ্ক্ষা, লালসা ইত্যাদি ফুটিয়ে তুলেছেন শিল্পী, গভীর এক ইঙ্গিতপূর্ণ ভঙ্গিতে। কিছু ছবিতে ভাঙা চেয়ারও দেখিয়েছেন। সেখানে হয়তো তিনি বোঝাতে চেয়েছেন যে, ক্ষমতার আসনটি যখন ততটা প্রভাবশালী থাকে না, তখনও মানুষের ওই চেয়ারে বসার আকাঙ্ক্ষা মরে না। সামাজিক চেতনায় ঋদ্ধ চেয়ার সম্পর্কিত এই চিত্রমালা মুগ্ধ করে।
যেমন একটি ছবির শিরোনাম, ‘দ্য থ্রোন’। এখানে মহাভারতের অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রের কথাই যেন বলতে চেয়েছেন সুশান্ত। ক্ষমতার চেয়ারে আসীন রাজা যদি অন্ধ হয় তার পারিপার্শ্বিকের প্রতি, তা হলে তার রাজত্বে শান্তি কোনও দিনই আসতে পারে না। সে শাসক কোনও ভাবেই তার আসনের মর্যাদা রাখতে পারে না। বক্তব্য যথেষ্ট অভিনব এবং জোরালো। রঙের ব্যবহারও অতুলনীয়।
অপর একটি ছবির নাম ‘দ্য স্টেজ’। এখানে শিল্পী দেখিয়েছেন, চেয়ারের আশপাশে বহু আস্তরণে নানা জিনিস অভিনীত হয়ে চলেছে। কিন্তু যে মানুষটি চেয়ারে উপবিষ্ট, তার যেন সে দিকে কোনও মনোযোগ নেই। সে অনড়, অটল হয়ে বসে আছে। এই ছবিতে রংয়ের ব্যবহার কিছুটা শিল্পীর ছাপাই ছবিকে মনে করায়। যদিও কোনও ছবিতেই উনি চেয়ারের উপরে সরাসরি বসে থাকতে দেখাননি কাউকে। সব চেয়ারই শূন্য।
একটি ছবির নাম শিল্পী রেখেছেন ‘দ্য চেয়ার’। এই ছবিটিতে টুকরো টুকরো ব্রাশওয়ার্কে হলুদ, অল্প চাপা লাল এবং পরিমিত সাদা রঙে বহু মানুষ এবং জীবনের নানা ঘটনা দেখিয়েছেন। ছবিটি বড়ই সুন্দর। তেল রঙের ব্যবহার অনবদ্য। রচনাশৈলী বা কম্পোজ়িশন শিল্পীর দক্ষতার পরিচয় বহন করে।
সাধারণ একটা চেয়ার দিয়ে যে জীবনের কত কথা বলা যায়! যেখানে আছে ক্ষমতার অপব্যবহার, আছে প্রতিষ্ঠিত মানুষের ঔদাসীন্য। আরও আছে সাধারণ মানুষের লোভ এবং বাসনা, ওই চেয়ারটিতে বসার জন্য। এই সমস্তই দেখিয়েছেন শিল্পী সুশান্ত চক্রবর্তী, তাঁর বহু ক্যানভাসে, নানা রঙে সমৃদ্ধ এই প্রদর্শনীটিতে। এ ছাড়াও কিছু ছোট ছোট কাপের ছবি উনি রেখেছিলেন প্রদর্শনীতে, যেগুলি খুবই আকর্ষক। সেগুলির উপরে প্রধানত লাইন ড্রয়িংয়ে আঁকা। প্রদর্শনীটি নবীন শিল্পীদের জন্যও খুবই উপভোগ্য।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy