উৎসুক: অতনু ভট্টাচার্যের একক প্রদর্শনীর চিত্রকর্ম। —নিজস্ব চিত্র।
সৃষ্টি ও নৈঃশব্দ্য একে অপরের দোসর। নিস্তব্ধতার মাঝে জেগে ওঠে সৃষ্টিতরঙ্গের ঝঙ্কার। কারণ, শিল্পীমনের নিশ্চুপ একাগ্রতাই গড়ে তোলে সৃষ্টিসুখের আনন্দ ও উপস্থাপন। সম্প্রতি কলকাতার বি আর পানেসর গ্যালারিতে সোসাইটি অব কনটেম্পোরারি আর্টিস্টসের উদ্যোগে প্রদর্শিত হল শিল্পী অতনু ভট্টাচার্যের তেমনই একক প্রদর্শনী। অবসর, নৈঃশব্দ্য ও সৃষ্টির এক নিবিড় মিলনাত্মক রূপ দেখা গেল এই প্রদর্শনীটিতে, যার নাম যথার্থ ভাবেই রাখা হয়েছে— ‘সলিচিউড’। জানা গেল, পারিবারিক কারণে একটানা বেশ কয়েক মাস ইংল্যান্ডের নিশ্চুপ, জনসমাগম বর্জিত এলাকায়, একান্তে কাটিয়েছিলেন শিল্পী অতনু। সেই একান্তে কাটানো সময়ের ফলস্বরূপ এই কাজের অর্ঘ্য।
শিল্পী অতনু মূলত ছাপাই ছবির জন্য সুখ্যাত। দীর্ঘ তিন দশক জুড়ে ছাপাই ছবি নিয়ে তাঁর অশ্রান্ত গবেষণা ও মাধ্যমগত বহু পরীক্ষানিরীক্ষা শিল্পপিপাসুদের এ যাবৎ বহু তাৎপর্যপূর্ণ উপহার দিয়েছে। জাতীয় স্তরে বহু প্রদর্শনী ও শিল্প কর্মশালায় যোগদানের
ফলে তাই তিনি শিল্পমহলে বেশ পরিচিত নাম।
তবে এই প্রদর্শনীতে ছাপাই ছবির পরিবর্তে শিল্পী তাঁর একান্তে আঁকা বেশ কিছু কাগজ ও বোর্ডের ছবি পরিবেশন করেছেন। কাজগুলির প্রেক্ষাপট কিঞ্চিৎ অন্য রকম৷ শিল্পী তাঁর প্রদর্শনীর পুস্তিকায় উল্লেখ করেছেন যে, নতুন দেশ, নতুন আবহাওয়া, পরিবেশের বৈচিত্র ও অচেনা প্রকৃতির যে বিস্ময়, সেই দিকগুলি তাঁর এই সিরিজ়টিকে বিশেষ ভাবে প্রভাবিত করেছে। জনবহুল কলকাতার পরে ইংল্যান্ডের নরউইচের মতো এক কিংবদন্তি ও ঐতিহ্যবাহী শহরের পরিচ্ছন্নতা, নান্দনিকতা ও নিস্তব্ধতা তাঁর সৃষ্টিশীল মনকে বিশেষ ভাবে আলোড়িত করে। তারই প্রতিফলনস্বরূপ বিমূর্ত ভাষায় আঁকা তাঁর এই ছবির গুচ্ছ।
ছবিগুলি মূলত গুঁড়ো রঙের সঙ্গে আঠা মিশিয়ে কার্ডবোর্ডের উপরে আঁকা। কখনও আকস্মিক, তো কখনও অতি সুনিশ্চিত রং ও রেখার যে বুনট, তা অতনুর দীর্ঘ শিল্পচর্চার স্বাক্ষর বহন করে। কোনও ছবি দেখে মনে হয়, রোমানেস্ক গির্জার জানালা, আবার কোনও ছবিতে যেন এক মানবী রূপের বিমূর্ত প্রকাশ। কোথাও আবার কাল্পনিক আলো-আঁধারির জমজমাট এক খেলা, ঠিক যেমন গথিক ক্যাথিড্রালের ভিতরে গেলে দেখতে পাওয়া যায়। সুদৃঢ় তির্যক রেখার অগণিত টানে ছবির প্রেক্ষাপটগুলি একেবারে টানটান— যা দর্শককে বিশেষ ভাবে মোহিত করে। বহু ছবিতেই একাধিক রঙের প্রলেপ ও ছবির ঘনত্ব পিকটোরিয়াল এলিমেন্টকে নির্ধারণ করতে সক্ষম হয়েছে। অনায়াস ও প্রাণোচ্ছল এই রং ও রেখার খেলা, ছাপাই ছবির ব্যাকরণগত দিকগুলি থেকে তাই অনেক স্বাধীন। এ জন্য প্রতিটি ছবিই যেন এক গল্পের ইন্ধন জোগায়।
শিল্পীমন যে সদাসর্বদা সৃষ্টির উৎস সন্ধানে সমাহিত থাকে, এই সতেজ ও আবেগময় ছবিগুলি তাঁরই এক সুদৃশ্য পরিচয় বহন করে। ‘সলিচিউড’ নামের এই প্রদর্শনীতে খুঁজে পাওয়া গেল অতনু ভট্টাচার্যের সেই সন্ধানী, উৎসুক শিল্পীমনকেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy