রূপক: ইমামি আর্টে শিল্পী অরিন্দম চট্টোপাধ্যায়ের চিত্রকর্ম। —নিজস্ব চিত্র।
ইমামি আর্টে শিল্পী অরিন্দম চট্টোপাধ্যায়ের একটি প্রদর্শনী আয়োজিত হয়েছিল সম্প্রতি। ২০১৭ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত সময়কালের সৃষ্টি নিয়েই এই প্রদর্শনী।
অরিন্দম চট্টোপাধ্যায় কলকাতা এবং শান্তিনিকেতনে শিল্পকলা নিয়ে পড়াশোনা করেন এবং নিজের শিল্পজীবন শুরু করেন অ্যাবস্ট্রাক্ট শিল্পী হিসেবে। ২০০৬-’০৭ সাল পর্যন্ত তাঁর যে যাত্রা, সেখানে দেখা গিয়েছে অরিন্দম যেন একটা ভাষা খোঁজায় ব্যস্ত ছিলেন। মোটামুটি ভাবে ২০০৭ সালে তিনি এমন একটা জায়গায় ছিলেন, যখন তাঁর ছবিতে খানিকটা বিমূর্ত ভাবই প্রকাশ পেত। অথচ তিনি কখনওই সচেতন ভাবে বিমূর্তকরণের কথা ভাবেননি।
আধুনিক শিল্প ইতিহাসে তিনি এমনই একজন শিল্পী, যিনি নিজের ছবিতে পৃথিবীর সমগ্ৰ হিংস্রতার ইতিহাস নিজস্ব পরীক্ষামূলক অথচ কবিত্বপূর্ণ ভাষায় স্বীকৃত এক আঙ্গিকে ধরে রেখেছেন। ২০০০ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন কোচবিহারে, তারপর ফেরেন কলকাতায়। সেই সময়ে কলকাতাকে এক নতুন রূপে দেখেন। শহর কলকাতা এবং সেখানকার মানুষজন যেন এক অন্য রূপে ধরা দিল তাঁর কাছে। তখন তাঁর যে বিমূর্ত শিল্পভাষা, তার ভিতর দিয়ে সেই রূপ প্রকাশ করা প্রায় অসম্ভব ছিল। তারপর একটা নতুন ভাষার সন্ধানে তিনি ছিলেন। এত বছর পরে তিনি এখন এমন একটা জায়গায় এসে পৌঁছেছেন, যেখানে তাঁর মনের মধ্যকার সব অনুভূতি যেন তিনি উজাড় করে দিয়েছেন এই নতুন, নিজস্ব শিল্পভাষায়।
এখন আর অরিন্দম ক্যানভাসের উপরে ছবি আঁকেন না। কাগজেই আঁকেন। কাগজের সঙ্গে নানা রকম মিশ্র মাধ্যম, যেমন পেন্সিল, টেম্পেরা, ক্রেয়ন, প্যাস্টেল, তেল রং, জলরং ইত্যাদি যখন একত্রে অথবা আলাদা ভাবে ব্যবহার করেন, তাঁর মতে তাদের মধ্যে একটা অদ্ভুত কথোপকথন চলে। তারপর কাগজটি ওই মাধ্যমগুলোর সঙ্গে মিশে এক নতুন মাধ্যমে শিল্পীর হাতে ধরা দেয়। প্রদর্শনীতে এই রকম নতুন মাধ্যমে করা কাজই বেশ কিছু দেখা গেল। অরিন্দমের প্রায় সব ছবিতেই আমরা দেখতে পাই, মানুষকে একটা অন্য সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। সমস্যাবিহীন, লোকদেখানো সমাজ এবং ক্ষমতাশালী মানুষের প্রাধান্য তিনি যেন ছিঁড়েখুঁড়ে একাকার করে, নতুন ভাবে আমাদের সামনে তুলে ধরতে চেয়েছেন। আপাত দৃষ্টিতে ছবিগুলি হতাশার বলে মনে হলেও বোঝা যায় যে, সব হতাশার মধ্যেও তিনি কোথাও একটা পরিবর্তনের আলো ফেলেছেন। পশুজগতের খুব কাছাকাছি দেখিয়েছেন তিনি মানুষকে। আজকের সামাজিক মানুষের অসহায়তা, সমস্ত পৃথিবী জুড়ে মানুষের হিংস্র ব্যবহার এবং সামাজিক সচেতনতার অভাব, সুবিচারের অভাব, মনুষ্যত্ব সেখানে নির্বাক... এই সবই নিজস্ব ভাষায় দর্শকের সামনে তুলে ধরেছেন অরিন্দম।
‘বেয়ার ট্রুথ’ বলে একটি কাগজে তেলরঙের ছবিতে নীচের জমিতে মানুষ এবং পশু একই শরীরে। তার চার-পায়ের শরীর। উপর থেকে কোনও একটা অমানবিক সত্তা যেন তাকে আক্রমণ করছে, থামাতে চাইছে। কিন্তু তার মধ্যে বাঁচার অনবদ্য স্পৃহা। ছবিটি খুব অভাবনীয়। একটি ছবির নাম ‘সো আ সাইলেন্স স্পোক’। কাগজের উপরে জলরঙের ছবি। মোষ জাতীয় এক পশুকে দড়ি দিয়ে বেঁধে নিয়ে চলেছে মানুষ কিন্তু নিদারুণ এক দ্বন্দ্বে সে গতিহীন এবং স্তব্ধ।
দ্বিতীয় ‘সো আ সাইলেন্স স্পোক’-এর অন্য একটি ছবি জলরং ড্রাই প্যাস্টেল এবং কালি দিয়ে কাগজের উপরে করা। একটি অসাধারণ অভিব্যক্তি— কংক্রিটের জঙ্গলে মানুষ গতিহীন অবস্থায় মৃতপ্রায় এবং তার শরীরের উপর বিশাল এক পাখি বসে আছে, কারণ সে-ই অপেক্ষাকৃত স্বাধীন।
এ বারের ছবিটির নাম ‘প্যারাব্লস অব টোয়াইলাইট’। সহজ বাংলায়, গোধূলিতে একটি রূপক-কাহিনি। এটি করা হয়েছে জলরং, চারকোল এবং কালিতে, কাগজের উপরে। সারফেসের বাঁ-দিকে নীচে একটি পাখি ওড়ার অপেক্ষায়, আর ডান দিকে কিছুটা দূরত্বে এক মানুষ। কিন্তু সে বাহুহীন এবং বদ্ধ, কিছুটা পাখিসদৃশ। শিল্পী এখানে পাখির অবয়বের মধ্যেই এক মানুষের ঝুঁকে-থাকা অবয়ব যোগ করে দিয়েছেন কলমে। যেন বলতে চাইছেন, মানুষকেও পাখির মতো নিজের বদ্ধতা থেকে বেরিয়ে মুক্ত হতে হবে।
আর একটি ছবির নাম ‘ফেসেস অব দি আদার’। এই সিরিজ়ে ছ’টি ছবি দেখা গেল। বোর্ডের উপরে তেলরঙে আঁকা ছবি। পটভূমিটি বেশ চমকপ্রদ এবং রঙিন। সেখানে নানা রকম ইমেজ দেখতে পাওয়া যায়। সামনে গাছের গুঁড়ির উপরে এক বিকলাঙ্গ মানুষ আর সামনে একটি মাছ বা অন্য কোনও ভয়াবহ চেহারার প্রাণী, তাকে গিলে খাওয়ার জন্য আসছে। এখানেও যেন অস্তিত্বের সঙ্কটের কথা বলা হয়েছে।
অন্য একটি ছবির নাম ‘আ্যলিগরিজ় অব ভায়োলেন্স’। পৃথিবীর ইতিহাসে যেখানে যত যুদ্ধ এবং হিংস্রতা দেখা গিয়েছে, তারই রূপক। এক বিকৃত রূপ, একটি নারী শরীরে, সে বিব্রত ও লাঞ্ছিত। এটিও একটি সিরিজ়ের অংশগত। হ্যান্ডমেড কাগজের উপর জলরঙে করা কাজ।
অরিন্দম চট্টোপাধ্যায়ের আর একটি ছবির নাম ‘রিব কেজ’। কাগজের উপরে চারকোল ও ড্রাই প্যাস্টেলে করা কাজ। এখানে মানুষ একা, সমাজব্যবস্থার শিকার। শৃঙ্খলিত এবং সেই কারণেই অসহায়।
সমাজসচেতন শিল্পী অরিন্দম তাঁর নতুন শিল্পমাধ্যমে নানা ভাবে দর্শককে নাড়া দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। সেই আঙ্গিকে বীভৎসতার ছোঁয়া থাকলেও তা মানুষকে ভাবায়। তাঁর চিত্রকর্ম মন জয় করে। বারবার দেখার ইচ্ছে জাগায়। স্বপ্ন নয়, শান্তি নয়, ভালবাসা নয়— এটি শিল্পীর প্রিয় কবি জীবনানন্দ দাশের পঙ্ক্তি, যা তাঁর কাজেও প্রতিভাত।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy