Advertisement
১৮ নভেম্বর ২০২৪

অভিনয়ের ‘দাদা’, স্বভাব তাঁর ‘মণি’

৬১ বছর চুটিয়ে অভিনয় করেছেন তিনি। হাসিঠাট্টায়, ভালবাসায় চলচ্চিত্র শিল্পকে ভরিয়ে দিয়েছেন অশোককুমার। তার চেয়েও আশ্চর্য, মৃত্যুর ১৮ বছর পরে আজও বলিউডে কাজ করেই চলেছেন দাদামণি। লিখছেন চিরশ্রী মজুমদার৬১ বছর চুটিয়ে অভিনয় করেছেন তিনি। হাসিঠাট্টায়, ভালবাসায় চলচ্চিত্র শিল্পকে ভরিয়ে দিয়েছেন অশোককুমার। তার চেয়েও আশ্চর্য, মৃত্যুর ১৮ বছর পরে আজও বলিউডে কাজ করেই চলেছেন দাদামণি।

শেষ আপডেট: ২০ এপ্রিল ২০১৯ ০০:২৬
Share: Save:

আশির দশক। রাজ কপূর ও শাম্মি কপূর বম্বে এয়ারপোর্টে এসেছেন বিমান ধরতে। দুই ভাইকে দেখে জনতা উদ্বেল। কান ফাটানো চিৎকার। রাজ যেন একটু বেশিই চুপ। শাম্মিও লক্ষ করেছিলেন। প্লেন উড়তে শুরু করতেই প্রশ্নটা করলেন তিনি— ‘কিসি বাত সে পড়েশান হো আপ?’ রাজ ধীরে ধীরে বললেন, ‘কত কিছু শেখালাম তোমাকে। সোনার মতো কেরিয়ার পেলে তুমি! ‘তুমসা নহি দেখা’, ‘জংলি’, ‘কাশ্মীর কী কলি’, ‘ব্রহ্মচারী’… আর আজ দেখি লোকে তোমাকে দেখে ‘ইয়াহু’র বদলে ‘পান...’, ‘পান...’ বলে ডাকছে! ওই পান মশলার বিজ্ঞাপনটা কি না করলেই চলছিল না তোমার?’ শাম্মি টকটকে লাল মুখ করে বললেন, ‘একবার দাদামণির সঙ্গে স্ক্রিন শেয়ার করতে চেয়েছিলাম আমি। কবে থেকে ইচ্ছে আমার! কিন্তু কেউ কোনও দিন একটা ছবিতেও আমাকে ওঁর সঙ্গে কাজ করার সুযোগ দিল না। তার পর এই অ্যাডের অফারটা এল। কীসের বিজ্ঞাপন, কত দক্ষিণা কিচ্ছু না জেনে, শুধু দাদামণির সঙ্গে একটু অভিনয় করতে পারব শুনেই হ্যাঁ করে দিয়েছি।’ উত্তর শুনে রাজ আরও হতভম্ব হয়ে গেলেন। ঠিক এমনই হতভম্ব তিনি হয়েছিলেন চল্লিশ বছর আগে। সে দিন ছিল তাঁর বিয়ে। ঘোমটা ঢাকা সলাজ নববধূকে সঙ্গে নিয়ে স্টেজে দাঁড়িয়ে ইন্ডাস্ট্রির গণ্যমান্যদের আশীর্বাদ নিচ্ছিলেন। তার পরে পৃথ্বীরাজ কপূরের বড় ছেলের বিয়েতে ঢুকলেন বম্বে টকিজ়ের এক নম্বর স্টার অশোককুমার। তাঁকে দেখামাত্র নতুন বউ কৃষ্ণা রাজ কপূর ঘোমটা সরিয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘‘আরে, অশোককুমার!’’ তার পরে রাজ্যের অপরিচিত অভ্যাগত, রাজনীতির সব কেষ্টবিষ্টুদের দিকে তাকিয়ে ভারী উত্তেজিত ভাবে বলতে থাকলেন, ‘‘আমি ‘কিসমত’ তিন বার দেখেছি। আর ‘অচ্ছুৎ কন্যা’ আমার দেখা প্রথম ফিল্ম।’’ অশোককুমার তখন হোহো করে হাসছেন। পৃথ্বীরাজ কপূর কী ভাবে বরকর্তাসুলভ গাম্ভীর্য ধরে রাখবেন, ভেবে পাচ্ছেন না। তরুণ রাজ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দেখছেন, শান্ত বলে পরিচিত ছোট ভাই শশী কেমন টেবিলে প্লেট, কাঁটা চামচ নিয়ে বসা হাই প্রোফাইল অতিথিদের হার্ডল জ্ঞানে টপকাতে টপকাতে ছুটে আসছে আর কচি গলায় রিনরিন করছে— ‘দাদামণি ম্যায় ইধার।’ সে যে ফিল্মে অশোককুমারের ছোটবেলার পার্ট করে! তাই দু’জনের খুব দোস্তি। এই অদ্ভুত কাণ্ডের সাক্ষী রাজের বিয়ের অ্যালবাম। বাবা গম্ভীর, ভাইয়েরা স্টেজের উপরে কুস্তি করছে, নতুন বউ কান এঁটো করে হাসছে, রাজের বেচারা মুখ আর মধ্যমণি দাদামণি। রাজ কপূরের রিসেপশন প্রায় লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে কৌতুকে চোখ পাকাচ্ছেন রঘু ডাকাতের বংশধর।

পুরো বাঙালি সমাজে যে ক’টি এলেমদার রাজবংশ আছে, যেখানে বিধাতাপুরুষ সকাল-বিকেল রূপ, জ্ঞান, বহুমুখী প্রতিভার হরির লুট ছোড়েন, সেই ভাগ্যবানদের অন্যতম হল ভাগলপুরের গঙ্গোপাধ্যায়রা! অশোককুমার মা-বাবা দু’দিক দিয়ে নীল রক্তের অধিকারী। তিনি সত্যি সত্যিই খোদ রঘু ডাকাতের নাতির নাতি। রবিনহুড ধাঁচে জমিদারি সামলানোর পাশাপাশি বংশ পরম্পরায় আইন পড়েছেন তাঁরা। তাঁর মায়ের দিকের দাদু হলেন শিবচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি ছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সহপাঠী, দু’জনে একসঙ্গে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের স্নাতকোত্তর পরীক্ষায় প্রথম হয়েছিলেন। বঙ্কিম ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের চাকরিটা নিলেন, তবে শিবচন্দ্রের রকমসকম অন্য ছিল কিনা, তাই তিনি সে দিকে গেলেন না। লোকাল বারে প্র্যাকটিস করে কোটিপতি হলেন। সেই টাকায় ভাগলপুরে ঘাট বসিয়ে, মন্দির গড়ে, স্কুল বানিয়ে মানুষের লোকের মনমুকুরে প্রায় আকবর বাদশা হয়ে উঠলেন। বাদ সাধল ইংরেজ। তারা তাঁকে রাজবাড়ি গড়ে দিয়ে, ‘রাজবাহাদুর’ খেতাব দিল এক শর্তে— আইন প্র্যাকটিস করা যাবে না। শিবচন্দ্র সে কথা মানতে রটে গেল বঙ্গ জুড়ে, মাথায় তাঁর দোষ আছে। লোকে তাঁকে নিয়ে গান বাধল, ‘অংরেজি বাজা/ রাজ না পাট/শিবচন্দ্র রাজা।’

যতই লোকে ‘পাগলা রাজা’ বলুন, শিবচন্দ্রের কিন্তু মেজাজ ছিল দরিয়া। বাড়িতে নাটক গান সংস্কৃতি চর্চার আবহ ছিল বেশ। ছোটবেলায় এই মামাবাড়িতেই থাকতেন অশোক। তখন তাঁর নাম কুমুদ। সে বাড়িতে তখন নিত্য আনাগোনা করতেন ঔপন্যাসিক উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়, নাট্যকার দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, বনফুল, হেমেন রায়রা। শিবচন্দ্র তাঁদের সঙ্গে কুমুদের আলাপ করিয়ে বলতেন, ‘‘আচ্ছা, খোকা ওই গল্পটা বলো তো দেখি, যেখানে তোমার কাঁধে ডানা গজাল।’’ খোকা বলতে শুরু করলে কেউ ফুট কাটলেন, ‘‘তা, ডানা গজিয়ে দেখাও তো।’’ খোকা চটাং জবাব দিল, ‘‘তুমি বাঘ হয়ে দেখাও তো, তবেই আমি ডানা বার করব।’’ রাজা শিবচন্দ্র তার পিঠ চাপড়ে দিয়ে এক শ্যামবর্ণ তরুণের সামনে দাঁড় করিয়ে বললেন, ‘‘তুমি কী লিখবে হে, আমার এই প্রপৌত্রটি তোমার চাইতেও সরেস গল্প বলে। শুনিয়ে দাও তো খোকা।’’ সে তরুণ ছিল উপেন্দ্রনাথের ভাগ্নে, সবে লেখালেখি শুরু করেছে।

খোকা ফিচেল হেসে বলল, ‘‘তুমি কখনও রুপোর ভাত খেয়েছ? তার সঙ্গে রুপোর পটোল ভাজা?’’ খোকার গল্প আরও এগোত, কিন্তু সে সময়েই অন্দরমহল থেকে এসে তার কান পাকড়ে নিয়ে গেলেন তার মা গৌরীরানি। এ বার শাস্ত্রগানের তালিম নেবে সে মায়ের কাছে। সে দিকেও তার খুব মন। সঙ্গে শুধু হাত খুলে তবলা বাজাতে দিতে হয়। বাবার টাকে! নইলে ছন্দটা ধরতে তার সমস্যা হয়।

বাড়িতে হালকা মেজাজে

বহু বছর বাদে সেই যুবকের সঙ্গে খোকার আবার দেখা হয়েছিল নিউ থিয়েটার্স স্টুডিয়োয়। বীরেন্দ্র সরকারের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন নায়ক অশোককুমার। অফিসঘরে গিয়ে দেখেন, শ্যামবর্ণ সৌম্যদর্শন এক প্রৌঢ় বসে। সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে দেখে নায়ক অশোককুমার একটু জড়সড় হয়ে পড়লেন। কথাসাহিত্যিক তাঁকে দেখেই উদাস ভাবে বললেন, ‘‘রুপোর ভাত আর রুপোর পটোল আজও পেলাম না। জানো তো!’’ এ বার অশোককুমার পালাতে পথ পান না। শরৎচন্দ্র তখন স্নেহের স্বরে তাঁকে বললেন, ‘‘তোমার ফিল্মের স্টোরি ডেভেলপিংয়ের সময় তুমি থেকো কিন্তু। তাতে সকলের উপকার হবে।’’ তাঁর পরামর্শ সে দিন অভিনেতা অশোককুমার শুনেছিলেন বলেই আজও ইন্ডাস্ট্রির এত রমরমা। কী ভাবে? সে প্রসঙ্গ পরে। তবে আরও এক ডাকসাইটে বাঙালি লেখক স্বয়ং শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ও তাঁকে একই কথা বলেছিলেন। কিন্তু সে সব কথার আগে বম্বে টকিজ় আর হিমাংশু রায়।

কুমুদলালের পরের বোন সতীর বিয়ে ঠিক হওয়ার সময়ে ভগ্নীপতি শশধর মুখোপাধ্যায় বিশেষ কিছু করতেন না। তার পরেই মেঘনাদ সাহার এই গুণী ছাত্রটি হিমাংশু রায়ের বম্বে টকিজ়ে সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ারের চাকরি পেলেন। সবচেয়ে খুশি সতীর ‘দাদামণি’ কুমুদ। তিনি তখন কলকাতায় আইন পড়েন আর নাটক-সিনেমার খুব ভক্ত হয়েছেন। দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, দানিবাবুদের খুঁটিয়ে দেখেন। তবে শিশির ভাদুড়ী আর তারাসুন্দরীকে মঞ্চে ঘনিষ্ঠ হতে দেখলে তাঁর কান গরম হয়ে যায়। বরং বায়োস্কোপের তাঁবুতে এডি পোলো, উইলিয়াম ম্যাকেস্টির অ্যাকশন দেখতে মজা পান। ‘লাইট অফ এশিয়া’, ‘থ্রো অব ডাইস’ দেখে কুমুদ ভাবছেন, এই হিমাংশু রায় তো দেখি হলিউডের মতো ছবি তোলেন! শশধর তাঁর সংস্থায় চাকরি পেয়েছেন শুনে তিনি তো ছটফট করে উঠলেন, ‘‘আচ্ছা, ও রকম কাজ শিখতে পারলে হয় না?’’ নিজে পরে বলেছেন, ‘‘হতচ্ছাড়া আইনের ক্লাসের থেকে ওটায় বেশি ইন্টারেস্ট হতে লাগল। ল-এর সেকেন্ড ইয়ারের এগজ়ামের ফি-র টাকায় বম্বের ট্রেনের টিকিট কিনে সোজা শশধরের বাড়িতে। সে বম্বে টকিজ়ে আমার জন্য ল্যাব অ্যাসিস্ট্যান্টের চাকরিও দেখে রেখেছিল।’’

অশোককুমারের আঁকা ছবি

কুমুদকে দেখামাত্র হিমাংশু রায় অভিনেতা করাতে চাইলেন। বেঁকে বসলেন বম্বে টকিজ়ের জার্মান ডিরেক্টর ফ্রান্জ় অস্টেন। এর চিবুকে এতটুকু কাটা কাটা ভাব নেই। জঘন্য দেখাবে ক্যামেরায়। সাফ কথা তাঁর। কুমুদও চটে লাল— কে চেয়েছে অভিনয় করতে! সামলে দিলেন হিমাংশু। তিনি বোঝালেন, তুমি ডিরেক্টর হতে চাও তো? তবে সব শিখতে হবে। চিত্রনাট্য লেখা, ফিল্ম ল্যাবের কাজ, মেকআপ, অ্যাক্টিংও।

তখন বম্বে টকিজ়ের হিরো সাজছিলেন নাজমুল হাসান আর হিরোইন হতেন হিমাংশুর তরুণী ভার্যা দেবিকা রানি। ‘জীবন নইয়া’র শুটিং শুরু হতেই হিমাংশু রায়ের জীবনের নৌকা ডুবিয়ে তাঁর স্ত্রী নাজমুলের হাত ধরে কলকাতা পালিয়ে গিয়েছিলেন। বহু কষ্টেসৃষ্টে তাঁকে ফেরত আনা হল। তবে এর পর তো আর নাজমুলকে বম্বে টকিজ়ে ঢুকতে দেওয়া যায় না। কুমুদকেই ‘সেফ’ মনে হল হিমাংশুর। সারল্য ভরা ছেলেমানুষ মুখ, চেহারায় আলগা শ্রী। আর অ্যাডোনিসের মতো হিরোয় তাঁর দরকার নেই। শশধরের শালাবাবুতেই চলবে!

সে দিনের কথা উঠলেই হাঁ হাঁ করে উঠতেন অশোককুমার। ‘‘আরে না না, হিরোটা দেবিকা রানিকে নিয়ে পালায়নি। তার শক্ত অসুখ হয়েছিল।’’ বলে মুখটা কুঁচকে রাখতেন, অথচ তাঁর সারা শরীর চাপা হাসিতে কাঁপত। তিনি বলতেন, ‘‘আমাকে হিমাংশু রায় হিরো করে দিল, পটলবাবুর মেয়ের সঙ্গে আমার বিয়েটা ভেঙে গেল। বাড়িতে সবাই বলল আমি বখে গেছি, আমাকে এ বার পরিতে ধরে নিয়ে যাবে। বাবা বম্বে ছুটে এলেন। শশধর তাঁকে বোঝাতে না পেরে হিমাংশু রায়ের সঙ্গে দেখা করিয়ে দিলেন।’’ বাবা দুটো মুখবন্ধ খাম নিয়ে রায়সাহেবের ঘরে ঢুকলেন। তাঁর মধ্যে একটায় ছিল তাঁর হস্টেলের বন্ধু, পরে ভারতের রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্রপ্রসাদের চিঠি। মিটিং শেষে বাবা ঘর থেকে বেরিয়ে বললেন, ‘‘মন দিয়ে অভিনয় করো। তবে তাঁর অনুরোধেই আমার নাম বদলে অশোককুমার করে দেওয়া হয়েছিল।’’

সেই ‘জীবন নইয়া’তে অশোক যা অভিনয় করলেন, ভোলার নয়। সে প্রসঙ্গ উঠলে হাত দিয়ে নাক চাপতেন। বলতেন, ‘‘পচা, পাঁকে ঠাসা নর্দমা, আবর্জনা। শুটিংয়ের সময় কত বার বললাম এ আমি পারব না। তা, এক দিন আবার আমাকে দেবিকা রানির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ দৃশ্যে অভিনয় করতে হবে। একে তিনি আমার বসের স্ত্রী, তার ওপর ওপাশে সোফায় আমার মা বসে আছেন। আমি ঘেমেনেয়ে একশা। হিরোইনকে একটা হার পরানোর কথা ছিল। সেটা আমি তার চুলে গেঁথে বসলাম। সেটা ছাড়াতে গিয়ে দেবিকা রানির বেশ কয়েক গাছি চুল উঠেই গেল। আমি নিশ্চিন্ত হলাম, আর পরদিন থেকে যেতে হবে না। কিন্তু ছাড়ল না। তার পর, এক বার আমাকে বলা হল পাঁচিল থেকে লাফিয়ে অ্যাকশন করতে হবে। খুব উৎসাহ নিয়ে লাফ দিলাম। পড়লাম ভিলেনের পিঠে। সে পা ভেঙে হসপিটালে ভর্তি হল। শুটিংও বন্ধ রইল কিছু দিন। এ সবের পরও পরের ছবি ‘অচ্ছুৎ কন্যা’য় আমাকে অভিনয় করানো হল। আমি তো আশাই করিনি। কিন্তু বলা হল, প্রথম সিনেমায় আমার চুল সকলের খুব পছন্দ হয়েছে।’’

‘অচ্ছুৎ কন্যা’র শুটিং শুরুর আগে হিমাংশু রায় অশোককুমারকে বিদেশি সিনেমা দেখার পরামর্শ দিয়েছিলেন। সেই সঙ্গে ফিল্মের খুঁটিনাটি জানতে প্রচুর বইও পড়তে দিয়েছিলেন। সে সব দেখেশুনে অশোক বুঝলেন, তিনি অভিনেতা হিসেবে বড় ম্রিয়মাণ, বড় আড়ষ্ট। বাচিক ও আঙ্গিক দু’রকম প্রকাশভঙ্গিকে আরও তীক্ষ্ণ করার চেষ্টা শুরু করলেন। তাঁর মনে হতে লাগল, এই মাধ্যমটিকে ভালবেসে ফেলছেন তিনি। এর সঙ্গেই পর্দায় তাঁর অভিনয়ে নানা বৈচিত্র দেখা দিতে লাগল। ‘বচন’-এ রাজপুত শৌর্য, ‘ইজ্জত’-এ দেশি রোমিওর ভূমিকায় তাঁর চরিত্রায়ণ সকলের নজর কাড়ল। এরই মাঝে সেই সময়ে ব্যক্তিগত জীবনের সংঘাতে চূড়ান্ত শ্রান্ত হিমাংশু তাঁকে একটি মহামন্ত্র দিলেন, ‘‘এ মায়ানগরী, ইয়ং ম্যান। নতুন বিয়ে করেছ, নাম করছ। কিন্তু কখনও প্রলোভনে পোড়ো না। ছ’টার মধ্যে প্রতি দিন কাজ শেষ করে বাড়ি চলে যাবে। নয়তো সৃষ্টির গরল তোমার জীবনেও প্রবেশ করবে। তা হতে দেবে না। কথা দাও।’’ উঠে দাঁড়িয়ে হ্যান্ড শেক করেছিলেন অশোককুমার।

হিমাংশু তাঁকে কমিক আর ভিলেন, দু’রকম চরিত্র করতেও কড়া নিষেধ করেছিলেন। কিন্তু অশোক বিচিত্রবর্ণের মানুষ, তাঁর সব রকমটাই করতে সাধ হত। হিমাংশুর মৃত্যুর পরে বম্বে টকিজ়ের যখন ঘোর দুর্দিন, তখন শশধর, তাঁর বন্ধু জ্ঞান মুখোপাধ্যায় আর অশোককুমার একসঙ্গে বসলেন। ভেবেচিন্তে ঠিক করলেন, একঘেয়ে প্রেমের পানসে গল্প দিয়ে আর সিনেমা বানানো ঠিক হবে না। চার দিকে যুদ্ধ, দুঃসময়, নৈরাজ্য, দুর্বোধ্য চরিত্রের মানুষকে নিয়েই চিত্রনাট্য লিখতে হবে। পশ্চিমেও এমনটাই হচ্ছে। কয়েকটা বিদেশি ছবির অনুপ্রেরণায় নতুন থিম ভাবলেন তাঁরা। সেই থিমেই ‘কিসমত’ হল। মুখ্য চরিত্র আড়চোখে লোককে দ্যাখে, ঠকায়, দাঁতে সিগার চেপে ধোঁয়া ছাড়ে। দাদামণি দেখলেন, খলচরিত্রে অভিনয়টা তাঁর কিন্তু দিব্যি আসে। ১৯৪৩ সালে মুক্তি পাওয়া এই ছকভাঙা ছবিটি দীর্ঘদিন ভারতের সফলতম ছবি ছিল। পরে সে রেকর্ড ভাঙে ‘শোলে’। ক্রিপ করা ব্যাকব্রাশ চুল, আংরেজ পাতলুন, আঙুলের ফাঁকে সিগারেটে ছেলেদের তখন দাদামণি সাজার কী ধুম! এই লেডিকিলার লুক আর ক্যারেক্টারে পরেও অশোককুমারকে পর্দায় দেখা গিয়েছে। ‘হাওড়া ব্রিজ’, ‘ভাই ভাই’... পুরোদস্তুর ভিলেন হয়ে মাত করেছেন ‘জুয়েল থিফ’-এ।

‘‘তা বলে মানুষটা আমি ভিলেন ছিলাম না, কী বলো। আমাদের সময়ে কেউ কারুর সঙ্গেই ভিলেনি করত না তেমন। কত ছবি হত, কত কাজ। শুধু দেবিকা রানির সঙ্গে আমার একটু তেতো সম্পর্ক হযে গিয়েছিল। তিনি আমার বদলে দিলীপকে কাজ দিতেন। তাতে আমার সঙ্গে তার সম্পর্ক টসকায়নি। আমিও তো নতুন হিরো খুঁজতাম। একদিন একটা বেশ সুন্দর দেখতে ছেলে এসে আমার কাছে কাজ চাইল। আমি তাকে ‘জ়িদ্দি’র নায়কের চরিত্রটায় নামানোর ব্যবস্থা করলাম। সে ছেলে কোত্থেকে যেন দেবানন্দ হয়ে গেল। ওর একটাই দোষ ছিল। একটু বেশি ঘাড় নাড়াত। এখন তো আরও বেশি নাড়ায়। আমিও প্রথম দিকে অমন করতাম। আমাকে দেবিকা রানি শুধরে দিয়েছিলেন,’’ একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন তবস্সুমকে। জানিয়েছিলেন, এক দিন একটা লম্বা মতো ছেলে সেটে বসে কী সব নোট নিচ্ছিল দেখে তিনি তাকে বার করে দিতে গিয়েছিলেন। পরে দেখা গেল, সে ‘পথের পাঁচালি’ বানিয়ে ফেলেছে। যদি জানতেন সে-ই সত্যজিৎ রায়, তবে আরও আদরযত্ন করলে নিজেরই উপকার হত বলে কপট দুঃখ করতেন। উত্তমকুমারকে ‘আনন্দ আশ্রম’ করার সময়ে বললেন, ‘‘অ্যাই এই ডাবল ভার্সন ব্যাপারটা আমাকে ভাল করে শিখিয়ে দেবে।’’ উত্তম বললেন, ‘হাটেবাজারে’, ‘মমতা’ এসব আমার করা সিনেমা তো, তাই আমি আপনাকে শেখাব! উনি বললেন, ‘‘ওই জন্য ‘অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি’তে তুমি ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড পেলে, আর আমার ‘হাটেবাজারে’ ফক্কা পেল!’’ এমন বলেছিলেন বটে, কিন্তু ভাষায় পালিশ দিতে তিনি আটটা ভাষা শিখেছিলেন! হিন্দি, উর্দু, ইংরেজিতে চোস্ত ছিলেন। তাই কত সময়ে নিজের ডায়লগ সেটে গিয়ে নিজেই বানিয়ে বলে দিতেন। ও ভাবেই তাঁর আর প্রাণের অপূর্ব রসায়ন, কমিক টাইমিংয়ের গুণে ‘ভিক্টোরিয়া নম্বর ২০৩’ বাম্পার হিট! সেই সিনেমায় বুঝি প্রথম বার দাদামণির শরীর মোচড়ানো অভিনয় লক্ষ করলেন সবাই। সেই সিনেমায় ছিঁচকে চোর প্রাণ আর অশোক জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার সময়ে জেলারের কাছে ভালমানুষের মতো বাড়ি ফেরার টাকা চাইছে। কত টাকা? প্রাণ বললেন, তুই বল। অশোক ঝুঁকে বাও করে বললেন, ‘স্যর আমি সিঙ্গাপুরে থাকি, দয়া করে পাঁচ হাজার টাকা দেবেন গাড়িভাড়া বাবদ। প্রাণ দেখাদেখি সেলাম ঠুকে বললেন, আর আমি হংকংয়ে থাকি। আমাকে চার হাজার দিলেই হবে। এই পুরো সিনটা দু’জনে মিলে সেটে দাঁড়িয়ে ইম্প্রোভাইজ করেছিলেন!

অশোককুমার চরিত্রাভিনয়ের দিকে সরে আসার পরে আরও ভাল করে তাঁকে ব্যবহার করা গিয়েছে বলে মনে করেন পরিবারবন্ধু ও এক সময়ের শিশু অভিনেত্রী তবস্সুম। বললেন, ‘‘উনি নিজের সিনগুলো বাড়িতে প্র্যাকটিস করতেন কী ভাবে, জানো তো? ‘গুমরাহ’-এ তিনি এক জন কর্তব্যপরায়ণ স্বামীর ভূমিকায় অভিনয় করবেন। ক’দিন রান্নাঘরে, বাগানে শোভা বৌদির পিছন পিছন ঘুরলেন। ‘শোভা, শিগগির চা আনো’, ‘কাগজটা কোথায় রাখলে’... সে কী হাঁকডাক। এ বার ‘গুমরাহ’র প্রিমিয়ারে গিয়ে শোভা বৌদি রেগে কাঁই— ‘‘বাড়িতে যা যা হয়, সব পর্দায় দেখতে পাচ্ছেন।’’ দাদামণি গাল ফোলালেন, তার পরে এক হাত লম্বা জিভ কাটালেন। ‘খুবসুরত’-এ যেখানে তিনি রেখার সঙ্গে রাকেশ রোশনের বিয়ের কথা পাড়ছেন দিনা পাঠকের কাছে, আর ব্যক্তিত্বময়ী স্ত্রী তা নাকচ করে দিচ্ছেন, তখন সেই লাখ টাকার মুখভঙ্গিটি পর্দাতেও দেখিয়েছিলেন তিনি। ‘খুবসুরত’-এ অশোকের পুরো চরিত্রটাই তাঁর নিজের জীবন থেকে অনুপ্রাণিত। এর আগে ‘চলতি কা নাম গাড়ি’তে তিন ভাই নিজেদের ভূমিকাতেই অভিনয় করেছিলেন। ডাকাবুকো দাদামণির কাছ থেকে সত্যিই লুকিয়ে থাকতেন কিশোরকুমার। রুমা গুহঠাকুরতাকে বিয়ে করে কিশোর বলতে গিয়েছিলেন, তাঁরা অন্য বাড়িতে থাকবেন। দাদমণি শুনে হুঙ্কার দিলেন, ‘‘কেন?’’ অমনি কিশোর বললেন, ‘‘আমি তো রেজিস্ট্রি করেছি, বিয়ে করিনি।’’ ‘‘কে সাক্ষী দিয়েছে?’’ ‘‘মেহমুদ।’’ কিশোর সব বলে ফেলেছে জেনে মেহমুদ গাছের ডালে উঠে বসে ছিলেন! কে তাঁকে বলেছিল, দাদামণি পিস্তল হাতে তাঁকে খুঁজছেন। হতেই পারে! বক্সিং জানা লোক।

প্রতিভার দিক দিয়ে তিনি ছিলেন ‘ছোটি সি বাত’-এর কর্নেল জুলিয়াস নগেন্দ্রনাথ উইলফ্রেড সিংহ। দাবা খেলতে জানেন, বক্সিং-ক্রিকেটে চ্যাম্পিয়ন, ননসেন্স রাইম রচয়িতা, ভিন্টেজ গাড়ির শখ, দুর্দান্ত পেন্টার, কথা ফলিয়ে দেওয়া জ্যোতিষী এবং ভারতের অন্যতম সফল হোমিয়োপ্যাথিক চিকিৎসক। রোজ সকাল সাতটা থেকে ন’টা বাড়িতে চেম্বার করতেন। লম্বা লাইন পড়ত।

‘‘আমার শাশুড়ি মায়ের হাঁপের টান ছিল। সেটা আমার মেয়ে পায়েলেরও শিশু বয়সেই দেখা দিল। দাদামণির ধন্বন্তরী ওষুধে সেরে গেল,’’ জানালেন অভিনেত্রী মৌসুমী চট্টোপাধ্যায়। আরও বললেন, ‘‘ওঁর সঙ্গে ‘অনুরাগ’-এ প্রথম কাজ করি। আমার প্রথম হিন্দি সিনেমা। অনেক কিছু শিখিয়ে দিয়েছিলেন আমায়। কান্না আসার আগে গলা কী ভাবে ভাঙতে হয়, উনি আর নূতনজি মিলে আমাকে শেখান। খেতে ও খাওয়াতে খুব ভালবাসতেন। ব্রেক হলেই বলতেন, ‘‘চারটে করে শিঙাড়া আন সবার জন্য।’’ আমাকে বলতেন, ‘‘তোর জিভে কালো দাগ আছে। কাউকে জিভ ভেঙাবি না, কটু কথা বলবি না। সব ফলে যাবে।’’

‘‘ওঁরা, মানে মদন পুরি, ইফতিকার, দাদামণিরা নিজেদের মতো ঠাট্টা-ইয়ার্কি করতেন। কিন্তু আমাদের মতো ছোটদের সামনে একটাও খারাপ কথাও বলেননি। একটা দামি কথা বলেছিলেন, ‘‘আমার কাছে শিখতে চাস? শোন তুই যদি আমার কাছে শিখিস, আমিও তোর কাছে কিছু শিখব,’’ বলছেন মৌসুমী।

শিল্পের জন্য কী না করেছেন তিনি! প্রথমে ‘বন কি চিড়িয়া’, ‘খেত কি মুলি’ শুনে সবাই বলেছিল, মেয়েলি আওয়াজ। সেই থেকে বরফ গিলে গিলে গলা খসখসে করেছেন তিনি! তবলা টেনে বসে চৌখস ভঙ্গিতে গেয়েছেন, ‘বনবাউরি, ম্যায় হারি, যা যা রি।’ তা থেকেই তাঁর হাঁপানির টান, যা তাঁর প্রাণ কাড়বে।

অশোককুমারের থেকে বলিউড আজও শিখেই চলেছে। শিখেছে হিরোদের নামকরণ। দিলীপকুমার, রাজেন্দ্রকুমার হয়ে অক্ষয়কুমার অবধি। কিশোরকুমার শিখেছেন ‘এক চতুর নার’ গানটি। আর তাঁর ম্যানারিজ়মকে পুঁজি করে আজও সংসার চালাচ্ছে কত হাজার মিমিক্রি শিল্পী। তাঁর ভাবা গল্পেরই সুতো ধরে আজও নতুন নতুন হিট সিনেমার ফর্মুলা তৈরি হয়ে চলেছে বলিউডে। ‘মহল’ থেকে ‘করণ অর্জুন’, ‘পাকিজ়া’ থেকে ‘উমরাও জান’, ‘ভিক্টোরিয়া নম্বর ২০৩’ থেকে ‘আন্দাজ় অপনা অপনা’, আবার ‘বন্দিশ’ থেকে ‘হম আপকে হ্যায় কউন’, ‘কুছ কুছ হোতা হ্যায়’... সব হিট ছবির মূল আইডিয়া কিন্তু খোদ দাদামণির। দাদামণিই এই সব কাহিনির সূত্রধর। তাঁর ধরিয়ে দেওয়া গল্পের ব্যাটন হাতেই নতুন নতুন পথে ছুটে চলেছে বলিউড।

আর তালি বাজিয়েই চলেছি আমরা, ‘হমলোগ’।

ঋণ: ‘অশোককুমার: হিজ় লাইফ অ্যান্ড টাইমস’: নবেন্দু ঘোষ ‘চলচ্চিত্র প্রবেশিকা’:

শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়

‘জ়িন্দেগি এক সফর’:

সন্দীপ রায়ের তথ্যচিত্র

অন্য বিষয়গুলি:

Cinema Actor Ashok Kumar
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy