ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র: বাপ্পা ভৌমিকের প্রদর্শনী ‘পোকা’র চিত্রকর্ম। —নিজস্ব চিত্র।
শিল্পী বাপ্পা ভৌমিকের ছবির একক প্রদর্শনী সম্প্রতি হয়ে গেল চারুবাসনার সুনয়নী চিত্রশালায়। প্রদর্শনীর নাম রেখেছিলেন ‘পোকা’। পোকামাকড় নিয়ে বাপ্পার এক অদ্ভুত পরীক্ষানিরীক্ষা চলতেই থাকে। এখন পোকামাকড়, মাছিমশার রেখাচিত্র আঁকায় তিনি মোটামুটি সিদ্ধহস্ত বলা চলে।
বিষয় হিসেবে পোকা-ই কেন বেছে নিলেন জানতে চাওয়ায় শিল্পী পোকামাকড়ের দুনিয়া নিয়ে তাঁর ভাবনার কথা বললেন। পৃথিবীময় অসংখ্য কীটপতঙ্গ, যাদের আমরা কখনও দেখতে পাই, আবার কখনও তারা আমাদের দৃষ্টিতে ধরা দেয় না। বাপ্পা মনে করেন যে, এই সব পোকামাকড় যদি পৃথিবীতে না থাকত, তাহলে আমাদের জীবনটাই হয়তো অন্য রকম হত। কারণ ফুল ফোটার জন্য পরাগরেণু বয়ে নিয়ে যায় কীটপতঙ্গরাই। যাবতীয় সৃষ্টি তার পরেই হয়। পৃথিবী যদি পোকামুক্ত হয়, তাহলে বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্যই নষ্ট হয়ে যাবে। মানব সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য পোকামাকড়ের অবদান অপরিসীম। তাই শিল্পীর কাছে এরা বিষয় হয়ে উঠেছে, ধরা দিয়েছে অন্য আঙ্গিকে।
এইসব কীট পতঙ্গের নানা রূপ অনবদ্য রেখায় ফুটিয়ে তুলেছেন বাপ্পা। আরশোলা, পিঁপড়ে, মৌমাছি, ঝিঁঝিঁপোকা, বোলতা, শুঁয়োপোকা ইত্যাদি তাঁর ড্রয়িংয়ের গুণে প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে। কোথাও কোথাও সোনালি রঙের ব্যবহার আরও উজ্জ্বল করেছে সেই পোকাদের। বাপ্পা ভৌমিকের প্রত্যেকটি কাজেই তাঁর রৈখিক বৈশিষ্ট্য চোখে পড়ার মতো।
কিছু ছবিতে আমরা সাদা কাগজের উপরে সরু পেন দিয়ে খোলা হাতের ড্রয়িং দেখতে পাই। খুব সূক্ষ্ম কাজে পোকার অবয়ব এবং তাদের অনুভূতিগুলো সুন্দর ফুটিয়েছেন শিল্পী। একটি ছবিতে সূক্ষ্ম রেখায় ফুটে ওঠে, পোকাটি যেন অবাক চোখে এই পৃথিবীকে দেখছে। এ অনুভূতির প্রকাশ যেন মানুষের অভিব্যক্তিকে মনে করায়। তবে বেশির ভাগ পোকা যেন ক্রুদ্ধ। মানুষের স্বার্থপরতা, অবহেলা, হিংস্রতার প্রতিবাদরত বলে মনে হয় তাদের।
আরও কিছু ছবি দেখা গেল যেগুলি কালো কাগজের উপরে সোনালি কলম দিয়ে আঁকা। সামান্য অন্য রংও ব্যবহার করা হয়েছে এতে। এগুলির নান্দনিক রসগ্রহণে দর্শক সক্ষম হয়েছেন বলেই মনে হয়।
এই প্রদর্শনীতে দর্শক দেখতে পেলেন কালো কাগজের উপরে সাদা বা রুপোলি কলম দিয়ে আঁকা আরও কিছু পোকার ছবি। সাদাকালোর বৈপরীত্যে এগুলির মধ্যে নাটকীয়তা বেশি অনুভব করা গেল। এই পোকাগুলি যেন বেদনায় আচ্ছন্ন। প্রবল যন্ত্রণায় আর্তনাদ করছে, বিকৃত মুখভঙ্গি করে। এই কাজগুলি থেকে যেন চোখ ফেরানো যায় না।
প্রদর্শনীতে সবচেয়ে আকর্ষক কাজ একটি বড় আয়তনের অ্যাক্রিলিক অন ক্যানভাসের ছবি। এখানে প্রাণিজগতের রূপকে মানুষের সামাজিক কথোপকথনের রূপটি যেন প্রকৃষ্ট রূপে উপলব্ধি করা যায়। অসামান্য পরিপক্বতার স্বাক্ষরবাহী একটি ছবি, যার আকাশ বা প্রেক্ষাপট লাল। সেই পটভূমিতে দু’টি বিশাল আয়তনের পোকা একত্রে যেন মনুষ্যসমাজকে পর্যবেক্ষণ করছে। নীচে বহুতলের জঙ্গলে মানুষের অসহায়তা লক্ষণীয়। এখানে রাজনীতির ছোঁয়া দিয়েছেন বাপ্পা। ওই দু’টি বিশাল পোকার একটি যেন এক রাজনৈতিক দলনেতা এবং অপরটি প্রোমোটার। এরা মোটামুটি একই সূত্রে বাঁধা। মধ্যবিত্ত মানুষের শান্তিপূর্ণ, সুস্থ জীবনযাত্রাকে যেন বিপন্ন করে তুলেছে ওরা। নিজস্ব বাড়িগুলি কিনে নিয়ে, ভেঙে তার জায়গায় বহুতল তুলে ফেলে খুপরি খুপরি ফ্ল্যাটে পাঠিয়ে দিচ্ছেন তাদের। এগুলিকে বাপ্পা বলছেন, ধনী মানুষের বস্তি। আর এ ভাবেই নিজেদের পুরনো আভিজাত্য হারিয়ে ফেলছে সাধারণ মধ্যবিত্ত।
শিল্পী বাপ্পা ভৌমিক বয়সে নবীন হলেও তাঁর মানসিকতা সুপরিণত। নিজের ব্যতিক্রমী ভাবনাচিন্তার সচিত্রকরণে অনেকাংশেই সক্ষম হয়েছেন এই শিল্পী। ভবিষ্যতে দর্শক এবং শিল্পরসিকরা তাঁর আরও ভাল ভাল কাজ দেখতে পাবেন বলেই আশা করা যায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy