গান পরিবেশনে শিল্পীরা। —নিজস্ব চিত্র।
উনিশ শতকের শেষ ভাগে ইন্দিরা দেবী চৌধুরানীর জন্ম। তাঁর কর্মময় ও বর্ণময় জীবনের কথার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি ভাবে জড়িয়ে আছে বাঙালির শিক্ষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি। ব্যক্তিস্বাধীনতায় বিশ্বাসী, আত্মশক্তিতে ভরপুর, আত্মমর্যাদায় গরীয়সী ইন্দিরা ছিলেন সমকালের এক অদ্বিতীয় বাঙালিনি। তাঁর ব্যক্তিত্ব এমনই ছিল যে তাঁকে দেখলে, তাঁর সান্নিধ্যে গেলে, তাঁর মুখের কথা শুনলে সকলেই কেমন মুগ্ধ হয়ে যেতেন। শৈশবকাল থেকেই উনি পিয়ানো, বেহালা প্রভৃতি যন্ত্রসঙ্গীতে দক্ষ ছিলেন। কেবল মাত্র পারিবারিক সঙ্গীত সংরক্ষণেই তাঁর চর্চা সীমাবদ্ধ ছিল না, তিনি নিজেও বেশ কিছু সঙ্গীত রচনা করেছেন।
ইন্দিরা দেবী চৌধুরানীর জন্মের সার্ধশতবর্ষে অবনমহল মঞ্চে গত ১০ ডিসেম্বর ‘ইন্দিরা’ নিবেদন করল একটি ব্যতিক্রমী অনুষ্ঠান ‘ছন্দে বর্ণে গানে’— যা আজকের দিনে খুব একটা শোনা যায় না। নতুন প্রজন্মকে দিয়ে এই ধরনের গান গাওয়ানোর প্রচেষ্টা সত্যিই প্রশংসনীয়। যাঁরা সঙ্গীত পরিবেশন করলেন, তাঁরা সকলেই অনলাইনে শিক্ষা গ্রহণ করেন।
অনুষ্ঠানের শুরুতে ‘ইন্দিরা’ শিক্ষায়তনের আদ্য বিভাগের শিক্ষার্থীরা সমবেত কণ্ঠে শোনালেন ‘আমরা সবাই রাজা’, ‘আয় তবে সহচরী’ ও ‘সব কাজে হাত লাগাই মোরা, সব কাজে’। সুন্দর পরিবেশনা। এর পর ‘সুপূর্ণা স্মৃতি’ শিক্ষাক্রমের শিক্ষার্থী আরিফা মল্লিক পরিবেশন করলেন ‘কেন তোমরা আমায় ডাকো’ ও সমর্থা মণ্ডল শোনালেন ‘সব দিবি কে’। দু’টি গানই সুগীত।
এর পর ‘ঠাকুরবাড়ির গান’ পরিবেশন করলেন দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষাক্রমের শিক্ষার্থীরা। গানগুলি ছিল যথাক্রমে সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘প্রেমমুখ দেখো রে’, ইন্দিরা দেবী রচিত ‘আমি সকলি দিনু তোমারে’ এবং জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘জানি তুমি মঙ্গলময়’। বৈশাখী মজুমদারের কণ্ঠে ‘জানি তুমি মঙ্গলময়’ উল্লেখযোগ্য।
ঠাকুরবাড়ির গানে স্পেশাল ক্লাসের শিক্ষার্থীরা পরিবেশন করলেন হেমেন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘নাথ, তুমি ব্রহ্ম’, ইন্দিরা দেবী রচিত ‘তাঁরে রেখো তব পায়ে’। এই দু’টি গানই ছিল সম্মেলক। অন্বেষা সেনগুপ্তের কণ্ঠে দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘তারে কেমনে ধরিব হায়’ এবং শ্রুতি গোস্বামীর কণ্ঠে সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘ক্লান্ত আমি আভরণের ভারে’ গান দু’টি শ্রুতিমধুর। বিদিশা নন্দী শোনালেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘তুমি হে ভরসা মম’।
অনুষ্ঠানের একটি উজ্জ্বল অধ্যায় ছিল ‘দোলনা ডে স্কুল’-এর শিক্ষার্থীদের পরিবেশনা। প্রথমে তাঁরা পরিবেশন করলেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘দীনহীন ভকতে নাথ করো দয়া’ এবং ‘লক্ষ ভয়ে দাঁড়ের টানে ভাসল রণতরী’। দু’টি গানই সুগীত। ভাল লাগল দেখে যে, এঁরা কেউ কাগজ দেখে গান করলেন না। যা সচরাচর দেখা যায় না।
অনুষ্ঠানের শেষ পর্যায়ে ছিল দোলনা ডে স্কুল-এর শিক্ষার্থীদের বিশেষ নিবেদন ‘ইংরেজি মূল গান ও রবীন্দ্রসঙ্গীত (ভাঙা গান)। রবীন্দ্রনাথ স্কটিশ, আইরিশ ও ইংরেজি গানের অনুসরণে বেশ কিছু গান রচনা করেছিলেন। এই গানগুলির মধ্য থেকে পরিবেশিত হল ‘গো হোয়্যার গ্লোরি ওয়েটস দি’ (আইরিশ ফোক সং), যেটির আধারে রচিত হয়েছিল ‘আহা আজি এ বসন্তে’। গানটি ‘মায়ার খেলা’য় সখীদের গান হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল। পরের গানটি স্কটিশ গান ‘ই ব্যাঙ্কস অ্যান্ড ব্রেস ও’বনি ডুন’-এর অনুসরণে তৈরি হয়েছিল ‘ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে’। এই গানটি ‘কালমৃগয়া’ নৃত্যনাট্যে ব্যবহৃত হয়েছিল। ‘কালমৃগয়া’ থেকে আর একটি গান পরিবেশিত হল, যার মূল গানটি ছিল ‘রবিন আডেয়ার’। এই গানটির সুর ব্যবহৃত হল ‘সকলই ফুরালো স্বপন প্রায়’ গানটিতে। অনুষ্ঠানের শেষে ইংরেজি গানের অনুসরণে রচিত গান ‘তবে আয় সবে আয়, তবে ঢাল সুরা’ পরিবেশিত হল। এই গানটি রবীন্দ্রনাথ ‘বাল্মীকি প্রতিভা’ নৃত্যনাট্যে ব্যবহার করেছিলেন।
প্রত্যেকটি গানই চমৎকার ভাবে পরিবেশিত হল, শুধু মাত্র একটি কি বোর্ডের সাহায্য নিয়ে। ‘ইন্দিরা’কে ধন্যবাদ জানাই অনামী শিল্পীদের দিয়ে এমন পরিচ্ছন্ন মনোগ্রাহী অনুষ্ঠান উপহার দেওয়ার জন্য। এই অনুষ্ঠানে যন্ত্রসঙ্গীতে সহযোগিতা করেছেন দেবাশিস সাহা, দেবাশিস হালদার, গৌতম রায় ও সঞ্জীবন ভট্টাচার্য।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy