Advertisement
১৮ নভেম্বর ২০২৪
Science News

‘এই আমাদের আলো, দেখতে পাচ্ছ?’ এ বার ভিনগ্রহীদের লেসার পাঠাবে মানুষ

আমাদের পাঠানো সেই লেসার রশ্মি দেখে এই ব্রহ্মাণ্ডে আমাদের ঠিকানা মিল্কি ওয়ে গ্যালাক্সিতে ২০ হাজার আলোকবর্ষ দূরে থাকা ভিনগ্রহী সভ্যতা জানতে পারবে, তাদের মতো আরও একটি সভ্যতা রয়েছে। যাদের বাড়ি পৃথিবীতে।

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ

সুজয় চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ০৯ নভেম্বর ২০১৮ ১৫:৫৭
Share: Save:

এই আমাদের আলো। তোমাদের জন্যই এই আলো জ্বালিয়ে রেখেছি মহাকাশে। তোমরা কি দেখতে পাচ্ছ?

লেসার রশ্মি পাঠিয়ে এ বার ভিনগ্রহীদের কাছে এই বার্তা পাঠাতে পারবে মানুষ, অনায়াসে। সেই অত্যন্ত শক্তিশালী রশ্মি পাঠানো যাবে বিশ্বের যে কোনও সুউচ্চ পর্বতশৃঙ্গের মাথায় বসানো খুব শক্তিশালী টেলিস্কোপের মাধ্যমে। চাঁদের যে-পিঠ আমরা কোনও দিনও দেখতে পাই না, ভিনগ্রহীদের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য শক্তিশালী লেসার রশ্মি পাঠানো যাবে সেখান থেকেও। আমাদের পাঠানো সেই লেসার রশ্মি দেখে এই ব্রহ্মাণ্ডে আমাদের ঠিকানা মিল্কি ওয়ে গ্যালাক্সিতে ২০ হাজার আলোকবর্ষ দূরে থাকা ভিনগ্রহী সভ্যতা জানতে পারবে, তাদের মতো আরও একটি সভ্যতা রয়েছে। যাদের বাড়ি পৃথিবীতে।

এইটুকু পড়ার পর যদি মনে হয়, চিনের বিশিষ্ট সায়েন্স ফিকশন লেখক সিক্সন লিউ’র উপন্যাস ‘দ্য থ্রি বডি প্রবলেম’ পড়ছেন, তা হলে মস্ত ভুল করবেন। কারণ, এটা কোনও কল্পবিজ্ঞানের গল্প নয়। ম্যাসাচুসেট্‌স ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি (এমআইটি)-র গবেষক জেমস ক্লার্কের একটি গবেষণাপত্র। যা প্রকাশিত হয়েছে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান-জার্নাল ‘দ্য অ্যাস্ট্রোফিজিক্যাল জার্নাল’-এ।

গবেষকরা জানিয়েছেন, এই অসাধ্য সাধন করা সম্ভব লেসার রশ্মি আর টেলিস্কোপকে ব্যবহার করে। তার জন্য যেমন লেসার রশ্মির শক্তির প্রাবল্য বাড়ানো হবে, তেমনই উল্লেখযোগ্য ভাবে বাড়াতে হবে খুব শক্তিশালী টেলিস্কোপের লেন্সের ব্যাসও।

আরও পড়ুন- পৃথিবীর দিকে ধেয়ে আসছে ভিনগ্রহী মহাকাশযান?​

আরও পড়ুন- গ্রহের রং বেছে এ বার প্রাণ খুঁজবেন বিজ্ঞানীরা!

এই দু’টি লক্ষ্যের একটিতে মানুষ পৌঁছে গিয়েছিল আজ থেকে প্রায় ছ’দশক আগেই। আমেরিকা ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে ঠান্ডা যুদ্ধের সময়। সেই সময়েই রুশ হুমকির চাপে এক থেকে দুই মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন লেসার রশ্মি বানিয়ে ফেলেছিল আমেরিকা। রুশ ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংসের লক্ষ্যে।

দুই মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন লেসার রশ্মি

তখন লেসার রশ্মির ব্যবহারের উদ্দেশ্যটা ছিল মূলত শত্রুপক্ষকে ধবংস করা। আর এখন সেই লেসার রশ্মিকে ব্যবহার করা হবে এই ব্রহ্মাণ্ডের কোনও প্রান্তে লুকিয়ে থাকা কোনও উন্নত বা উন্নততর সভ্যতাকে আমাদের অস্তিত্বের কথা জানাতে। আরেকটি অজানা, অচেনা সভ্যতার সঙ্গে সম্পর্ক-সৃষ্টির জন্য। ভাঙার জন্য যার জন্ম, সেই লেসার রশ্মিকে এ বার জোড়ার কাজে লাগাতে চান জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা।

কী করতে চাইছেন গবেষকরা?

আনন্দবাজার ডিজিটালের তরফে ই-মেলে ও টেলিফোনে যোগাযোগ করা হয়েছিল এমআইটি’র মূল গবেষক জেমস ক্লার্কের সঙ্গে। ই-মেলে ক্লার্ক লিখেছেন, ‘‘আমরা বিভিন্ন ক্ষমতার লেসার রশ্মি ও টেলিস্কোপের বিভিন্ন ব্যাসের লেন্স নিয়ে দীর্ঘ দিন ধরে পরীক্ষা চালিয়েছি। দেখেছি, যদি ২ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন লেসার রশ্মিকে লেন্সের ব্যাস ৩০ মিটার, এমন টেলিস্কোপের মাধ্যমে ফোকাস করা যায় মহাকাশে, তা হলে সেই লেসার রশ্মিকে অনায়াসেই দেখতে পাবে আমাদের চেয়ে ৪ আলোকবর্ষ দূরে (আলোর গতিতে ছুটলে যেখানে পৌঁছতে সময় লাগবে মাত্র ৪ বছর) থাকা ভিনগ্রহ ‘প্রক্সিমা সেনটাওরি-বি’-র ভিনগ্রহী সভ্যতা। এটাই আমাদের সবচেয়ে কাছে থাকা নক্ষত্র ‘প্রক্সিমা সেনটাওরি’কে প্রদক্ষিণ করে চলেছে।’’

ক্লার্ক জানিয়েছেন, তাঁরা হিসেব কষে দেখেছেন, একই ভাবে, আমরা যদি ১ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন লেসার রশ্মিকে, যার লেন্সের ব্যাস ৪৫ মিটার, এমন টেলিস্কোপের মাধ্যমে মহাকাশে ফোকাস করি, তা হলে তা অনায়াসে দেখতে পারবে ‘ট্রাপিস্ট’ তারামণ্ডলের সাতটি গ্রহের কোনওটিতে থাকা কোনও ভিনগ্রহী সভ্যতা। ‘ট্রাপিস্ট’ তারামণ্ডল আমাদের চেয়ে রয়েছে ৪০ আলোকবর্ষ দূরে। যেখানে ‘ট্রাপিস্ট’ নক্ষত্রকে প্রদক্ষিণ করে চলেছে সাতটি গ্রহ। যার তিনটিতে জলের অস্তিত্ব ইতিমধ্যেই প্রমাণিত হয়েছে। যাদের অন্তত দু’টিতে রয়েছে অত্যন্ত পুরু বায়ুমণ্ডলও।

হাওয়াই দ্বীপে বসার কথা ৩০ মিটার ব্যাসের লেন্সের যে দানবাকৃতি টেলিস্কোপের

ক্লার্ক ও তাঁর সহযোগীরা লেসার রশ্মির ক্ষমতা ও টেলিস্কোপের লেন্সের ব্যাসের হিসেব কষে দেখেছেন, এই ভাবে আমরা এমন লেসার রশ্মি পাঠাতে পারি, যা আমাদের চেয়ে ২০ হাজার আলোকবর্ষ দূরে থাকা কোনও ভিনগ্রহী সভ্যতার দেখতে কোনও অসুবিধাই হবে না।

এই দূরত্বটা কিন্তু খুব কম নয়। এখানেই এই গবেষণা সকলের নজর কেড়েছে। কারণ, সব গ্যালাক্সির মতো আমাদের ছায়াপথ ‘মিল্কি ওয়ে গ্যালাক্সি’রও ঠিক কেন্দ্রে রয়েছে একটি দানবাকৃতি ব্ল্যাক হোল বা কৃষ্ণগহ্বর। যার নাম- ‘স্যাজিটেরিয়াস এ*’। আমাদের চেয়ে যা রয়েছে ঠিক ৩০ হাজার আলোকবর্ষ দূরে। ক্লার্ক ও তাঁর সহযোগীরা অঙ্ক কষে দেখিয়েছেন, লেসার রশ্মির ক্ষমতা ২ মেগাওয়াট আর টেলিস্কোপের লেন্সের ব্যাস ৩০ থেকে ৪৫ মিটারের মধ্যে হলেই ওই দানবাকৃতি ব্ল্যাক হোলের কাছেপিঠে থাকা ভিনগ্রহী সভ্যতাও দেখতে পারবে আমাদের পাঠানো লেসার রশ্মিকে।

আমাদের গ্যালাক্সির কেন্দ্রে থাকা ব্ল্যাক হোল ‘স্যাজিটেরিয়াস-এ*’। শিল্পীর কল্পনায়

রয়েছে কিছু অসুবিধাও...

ভিনগ্রহীদের সঙ্গে বহু দিন ধরে যোগাযোগের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন যে বিজ্ঞানীরা, তাঁদের অন্যতম হার্ভার্ড স্মিথসোনিয়ান সোসাইটির বিশিষ্ট জ্যোতির্বিজ্ঞানী অভি লোয়েব বস্টন থেকে টেলিফোনে আনন্দবাজার ডিজিটালকে বলেছেন, ‘‘পৃথিবীর কোনও পর্বতশৃঙ্গে টেলিস্কোপ বসিয়ে ওই লেসার রশ্মি পাঠানোর ক্ষেত্রে কিছু সমস্যা দেখা দিতে পারে। লেসার রশ্মির ভেদনক্ষমতা (পেনিট্রেটিভ পাওয়ার) অত্যন্ত তীব্র। তাই পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল ফুঁড়ে মহাকাশে পৌঁছনোর পথে আশপাশের লোকালয়ের পক্ষেও অত্যন্ত ক্ষতিকারক হতে পারে। সেই লেসার রশ্মিকে খোলা চোখে দেখার চেষ্টা করলে, কেউ অন্ধ হয়ে যেতে পারেন। তা ছাড়াও, মহাকাশে রয়েছে হাজার হাজার কৃত্রিম উপগ্রহ। টেলিস্কোপের মাধ্যমে লেসার রশ্মিকে মহাকাশে ফোকাস করতে গিয়ে যদি তা ভুলক্রমে কোনও কৃত্রিম উপগ্রহকে সামান্যও স্পর্শ করে, তা হলে তা ঝলসে যেতে পারে।’’

চাঁদের অন্য পিঠেও বসানো যায় সেই টেলিস্কোপ

কলকাতার ইন্ডিয়ান সেন্টার ফর স্পেস ফিজিক্স (আইসিএসপি)-এর অধিকর্তা, দেশের বিশিষ্ট জ্যোতির্বিজ্ঞানী সন্দীপ চক্রবর্তী বলছেন, ‘‘চাঁদের যে পিঠটা আমরা কোনও দিনই দেখতে পাই না টাইডাল এফেক্টের জন্য, সেই দিকেও আমরা বসাতে পারি সেই টেলিস্কোপ। ওই দিকে আমাদের পাঠানো উপগ্রহের সংখ্যাও কম। ফলে, টেলিস্কোপের মাধ্যমে লেসার রশ্মি পাঠাতে গিয়ে উপগ্রহ ধ্বংসের আশঙ্কাও সে ক্ষেত্রে থাকবে না বললেই চলে।’’

ভিনগ্রহীরা যাতে সেই রশ্মি দেখতে পায়, বাড়াতে হবে তার সম্ভাবনাও

সন্দীপ অবশ্য এও বলেছেন, যখনই টেলিস্কোপের মাধ্যমে লেসার রশ্মি পাঠানো হবে মহাকাশে, তখন সেই রশ্মিকে আদতে একটি বিন্দু বা মহাকাশের একটি অংশে ফোকাস করতে হবে। এখানেই সেই রশ্মি দেখতে পাওয়ার ক্ষেত্রে তৈরি হচ্ছে সীমাবদ্ধতা। ফুল স্কাই ভিউ বা গোটা আকাশ বা মহাকাশে সেই লেসার রশ্মি পাঠাতে পারলে তা ভিনগ্রহী সভ্যতার চোখে পড়ার সম্ভাবনা অনেকটাই বেড়ে যেত।

ভিনগ্রহী। শিল্পীর কল্পনায়

তবে এ ব্যাপারে কিছুটা ভিন্ন মতের পথিক পুণের ইন্টার-ইউনিভার্সিটি সেন্টার ফর অ্যাস্ট্রোনমি অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোফিজিক্স (আয়ুকা)-এর সিনিয়র প্রফেসর, ‘অ্যাস্ট্রোস্যাট’ প্রকল্পের সায়েন্স অপারেশনের প্রধান, বিশিষ্ট জ্যোতির্বিজ্ঞানী দীপঙ্কর ভট্টাচার্য। তাঁর কথায়, ‘‘ইমেজিং ও স্পেকট্রোস্কোপির যে প্রযুক্তি এখন আমাদের হাতে রয়েছে, তা দিয়ে কাছেপিঠের সভ্যতাকে বার্তা পাঠানো যায়। কিন্তু তার চেয়েও বেশি প্রয়োজন মহাকাশের অনেক বেশি অংশকে (ফুল স্কাই ভিউ) সব সময়ের জন্য ফোকাসের মধ্যে নিয়ে আসা। মহাকাশে আরও বেশি দূরে ও আরও বেশি গভীরে পৌঁছনোর ক্ষেত্রে পারদর্শী হয়ে ওঠা। রেডিও লেসার পাঠিয়ে যে কাজটা করা সম্ভব।’’

দীপঙ্কর এও বলেছেন, ‘‘শুধু আমরা লেসার রশ্মি পাঠালেই তো হবে না, সেই লেসার রশ্মি কতটা ভিনগ্রহী সভ্যতার নজরে আসবে সেটাও আমাদের সুনিশ্চিত করতে হবে।’’

সন্দীপের জোর বিশ্বাস, ‘‘উন্নত সভ্যতা অবশ্যই আছে ব্রহ্মাণ্ডে। তবে তার বয়স যদি মানবসভ্যতার সমান হয়, তা হলে আমাদের পাঠানো লেসার রশ্মি দেখে তা বোঝার সম্ভাবনা অনেকটাই বেশি ভিনগ্রহী সভ্যতার। আর সেই সভ্যতা যদি আমাদের চেয়ে অনেক উন্নত হয়ে থাকে, তা হলে সেই সম্ভাবনা অনেকটাই কমে যাবে।’’ তবে ৩০ বা ৪৫ মিটার ব্যাসের লেন্সের টেলিস্কোপ ২০৩০ সালের আগে বসানো সম্ভব হবে কি না, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে সন্দীপের।

ছবি ও আর্টওয়ার্ক সৌজন্যে: ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি (এমআইটি) ও হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy