পুরস্কারবিজেতা: পিটার ভান নিউয়েনহুইৎঝেন, সের্জিয়ো ফেরারা এবং ড্যানিয়েল জ়িসেল ফ্রিডম্যান।
খবর। এবং বিতর্ক। দুটোই একসঙ্গে শুরু হয়েছে। প্রথমে খবরটা বলে নিই, স্পেশাল ব্রেকথ্রু প্রাইজ় পাচ্ছেন তিন পদার্থবিজ্ঞানী। ড্যানিয়েল জ়িসেল ফ্রিডম্যান (ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি), সের্জিয়ো ফেরারা (সার্ন) এবং পিটার ভান নিউয়েনহুইৎঝেন (স্টোনি ব্রুক ইউনিভার্সিটি)। পুরস্কারের মোট মূল্য ৩০ লক্ষ ডলার।
মানে, তিন বিজ্ঞানী প্রত্যেকে পাচ্ছেন ১০ লক্ষ ডলার।
আর সাফল্য? হ্যাঁ, তা তাঁদের প্রণীত এক থিয়োরি। নাম সুপারগ্র্যাভিটি। যে তত্ত্ব ওঁরা আবিষ্কার করেছিলেন ১৯৭৬ সালে। পদার্থবিদ্যার সেরা জার্নাল ‘ফিজিক্যাল রিভিউ’-তে পাঁচ পৃষ্ঠার এক পেপার ছেপে ওঁরা ব্যাখ্যা করেছিলেন সে থিয়োরি।
স্পেশাল ব্রেকথ্রু প্রাইজ় হল বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ে ব্রেকথ্রু প্রাইজ়-এর অন্তর্গত। এ পুরস্কার দেওয়া শুরু ২০১২ সাল থেকে। রুশ ধনকুবের ইউরি মিলনার প্রথম শুরু করেছিলেন ব্রেকথ্রু প্রাইজ়। ওঁর সঙ্গে যোগ দেন আরও তিন বড়লোক স্বামী-স্ত্রী জুটি। সারগে ব্রিন (গুগল কোম্পানির মালিক) এবং অ্যান ওজসিকি (টোয়েন্টি-থ্রি অ্যান্ড মি কোম্পানি মালকিন); মার্ক জ়াকারবার্গ (ফেসবুক) এবং প্রিসিলা চ্যান; জ্যাক মা (গুগল-এর পাল্টা চিনা কোম্পানির মালিক) এবং ক্যাথি ঝাং। প্রথমে ব্রেকথ্রু প্রাইজ় দেওয়া হত কেবল ফিজিক্সে। ওঁরা এসে তহবিল বাড়ানোয় এখন জীববিজ্ঞান এবং গণিতেও দেওয়া হয় পুরস্কার। ব্রেকথ্রু প্রাইজ় বাৎসরিক। স্পেশাল ব্রেকথ্রু প্রাইজ় প্রতি বছর নিয়ম করে দেওয়া হয় না। কোনও কোনও বছর দেওয়া হয়।
ব্রেকথ্রু ট্রফি
অর্থমূল্যে ব্রেকথ্রু বা স্পেশাল ব্রেকথ্রু প্রাইজ় সবচেয়ে ‘দামি’। প্রত্যেক পুরস্কার ৩০ লক্ষ ডলারের। মানে, আজকের বাজারদরে ২১ কোটি ৪২ লক্ষ টাকা। প্রথম বছর ২০১২ সালে ন’জন পদার্থবিজ্ঞানীর প্রত্যেকে পেয়েছিলেন ৩০ লক্ষ ডলার। পুরস্কারপ্রাপকদের মধ্যে ভারতীয় বিজ্ঞানী ইলাহাবাদে হরিশচন্দ্র রিসার্চ ইনস্টিটিউটের অশোক সেন ছিলেন। অত জন ধনকুবের জড়ো হলে প্রাইজ়ের অর্থমূল্য যে মোটা অঙ্কের হবে, তাতে আর আশ্চর্য কী! অর্থমূল্য আর পুরস্কার দেওয়ার পিছনে কারা আছেন, সে সব বিচারে ব্রেকথ্রু বা স্পেশাল ব্রেকথ্রু প্রাইজ় এখন নজরকাড়া। খ্যাতির বিচারে নোবেল প্রাইজ় এখনও সবার সেরা। সেরার সেরা ওই পুরস্কারের অর্থমূল্য এখন ১২ লক্ষ ডলার। তার আড়াই গুণ বড় ওই ব্রেকথ্রু বা স্পেশাল ব্রেকথ্রু প্রাইজ়। নোবেল পুরস্কার এখন আর এক জনকে দেওয়া হয় না। পান তিন বা দু’জন। মানে, এক জন পান ৪ লক্ষ বা ৬ লক্ষ ডলার। সেখানে এ বার ফ্রিডম্যান, ফেরারা এবং নিউয়েনহুইৎঝেন পাচ্ছেন ১০ লক্ষ ডলার করে। যদি তত্ত্বটা ওঁদের মধ্যে কারও একার আবিষ্কার হত, তা হলে তিনি একাই পেতেন ৩০ লক্ষ ডলার।
বিজ্ঞানীদের জন্য পুরস্কার এখন অনেক। যার প্রায় সব ক’টি হালে চালু। অবশ্য এর কোনওটাই অর্থমূল্যে ব্রেকথ্রু বা স্পেশাল ব্রেকথ্রু প্রাইজ়ের সমকক্ষ নয়। কয়েকটির নাম করছি (কয়েকটা আবার ২০১৩ সাল থেকে চালু; মানে ব্রেকথ্রু প্রাইজ় শুরুর পরের বছর থেকে)। যেমন, তাইওয়ানের প্রোমোটার সামুয়েল ইন-এর শুরু করা তাং প্রাইজ়। অর্থমূল্য ১৬ লক্ষ ৭৫ হাজার ডলার। যা ‘এশিয়ান নোবেল’ নামে খ্যাত। অথবা রুশ অর্থলগ্নিকারী লেন ব্লাভাৎনিক-এর আড়াই লক্ষ ডলারের ব্লাভাৎনিক পুরস্কার। যার ব্যবস্থা শুধু প্রতিশ্রুতিমান তরুণ গবেষকদের জন্য। আলফ্রেড নোবেল গণিতে কোনও নোবেল দিয়ে যাননি। কানাডার গণিত অধ্যাপক জন ফিল্ডস নিজের সামান্য সঞ্চয় থেকে ১৯৩৬ সালে শুরু করেছিলেন ফিল্ডস মেডেল। মাত্র ১৪ হাজার ৭০০ ডলারের পুরস্কার। অবশ্য, গণিতজ্ঞদের জন্য ২০০৩ সাল থেকে নরওয়ে সরকার শুরু করেছে অ্যাবেল প্রাইজ়। মাত্র ২৭ বছর বয়সে প্রয়াত ও দেশের বিখ্যাত গণিতজ্ঞ নিলস হেনরিক অ্যাবেল স্মরণে। পুরস্কারমূল্য ৭ লক্ষ ডলার।
ধারে না হোক, ভারে ও সব পুরস্কারকে টেক্কা দিতে চায় ব্রেকথ্রু প্রাইজ়। এক-একটা পুরস্কারপ্রদান অনুষ্ঠান হয় জাঁকজমকের সঙ্গে। হলিউড অ্যাকট্রেস, পপ গায়িকাদের ভিড়ে ঠাসা। যেন বিজ্ঞান দুনিয়ার অস্কার নাইট! বাজি রেখে বলা যায়, আগামী ৩ নভেম্বর নাসা-র বিশাল হ্যাঙ্গারে যখন ফ্রিডম্যান, ফেরারা এবং নিউয়েনহুইৎঝেন-এর হাতে তুলে দেওয়া হবে ট্রফি এবং চেক, তখন সেই ধামাকাও হোস্ট করবেন রুপোলি পর্দার কোনও লাস্যময়ী।
কোন সাফল্যে এই সম্মান? সুপারগ্র্যাভিটি কী? তা হলে বলতে হয় তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যায় বি-রা-ট এক স্বপ্নের কথা। একদা যে স্বপ্ন দেখেছিলেন স্বয়ং আলবার্ট আইনস্টাইনও। কাগজে আঁকিবুকি থেকে প্রমাণ, যে দিন তিনি মারা যান, সে দিনও সকালে আশায় ছিলেন ওই স্বপ্নপূরণের। আমাদের অশোক সেন শুধু নয়, দুনিয়ার প্রথম সারির পদার্থবিজ্ঞানীদের সাধ আইনস্টাইনের ওই ব্যর্থ আশা পূরণের। কী সেটা?
নিরুৎসাহী: সুপারগ্র্যাভিটি নিয়ে আগ্রহ হারিয়েছিলেন স্টিফেন হকিং
বিশ্বচরাচরে আমরা দেখি ঘটনা। বিজ্ঞানীরা দেখেন ফোর্স, যা ঘটনা ঘটায়। সমস্ত ঘটনার মূলে নাকি মাত্র চারটে ফোর্স। ইলেকট্রোম্যাগনেটিক (যার ক্রিয়ায় ফ্যান ঘোরে বা ওষুধ খেলে রোগ সারে), উইক (যা তেজস্ক্রিয়তা ছড়ায়), স্ট্রং (যা পরমাণুর কেন্দ্রে নিউট্রন ও প্রোটন কণাদের আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখে) আর গ্র্যাভিটি (যার প্রভাবে গাছের আপেল মাটিতে পড়ে, অথবা চাঁদ পৃথিবীকে চক্কর দেয়)। এই চারের মধ্যে প্রথম তিনটে বল ব্যাখ্যা করতে পারে পদার্থবিদ্যার শাখা কোয়ান্টাম মেকানিক্স। যার জারিজুরি কেবল ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণার রাজ্যে। আর প্রকাণ্ডের বেলা? গ্রহ-উপগ্রহ-গ্যালাক্সির দুনিয়ায়? সেখানে কেবলই গ্র্যাভিটির শাসন। কোয়ান্টামের ট্যাঁ-ফো চলে না।
ব্রহ্মাণ্ড কেন দুই রাজ্যে দুই নিয়ম চালু রেখেছে? কেন চারটের বদলে বিশ্বজুড়ে চালু নয় একটাই ফোর্স? কোয়ান্টাম আর গ্র্যাভিটি মিশিয়ে যদি পাওয়া যেত একটা তত্ত্ব, তবে তাকে বলা যেত থিয়োরি অব এভরিথিং। বিশ্বের সব ক্রিয়া ব্যাখ্যার একমেবাদ্বিতীয়ম্ তত্ত্ব। তা পাওয়ার চেষ্টা এখনও পর্যন্ত ব্যর্থ! কোয়ান্টাম আর গ্র্যাভিটি যেন তেল আর জল। একসঙ্গে মেশে না। সুপারগ্র্যাভিটি হল সেই মেশানোর একটা চেষ্টা।
হ্যাঁ, শুধু চেষ্টা। কাগজে-কলমে। দুরূহ গণিতে। তত্ত্বে। বিজ্ঞানে কেবল তত্ত্বের কোনও দাম নেই। তত্ত্ব যা বলছে, তা সবাই সত্যি বলে মেনে নেয়, যখন পরীক্ষা উপহার দেয় তত্ত্ব যা বলছে, তা-ই। তার আগে তত্ত্ব শুধুই বুদ্ধির ব্যায়াম। পরীক্ষাই তত্ত্বের ভাগ্যবিধাতা। নাহ্, এখনও পর্যন্ত কোনও পরীক্ষায় মেলেনি সুপারগ্র্যাভিটির পূর্বাভাস। তা হলে? ঘটা করে কেন পুরস্কার দেওয়া?
১৯৮০ সালে স্টিফেন হকিং যখন কেমব্রিজে লুকাসিয়ান প্রফেসর (যে পদে একদা ছিলেন আইজ়াক নিউটন) হন, তখন পদগ্রহণ উপলক্ষে বক্তৃতায় তিনি বলেছিলেন, সুপারগ্র্যাভিটিই যে কাঙ্ক্ষিত থিয়োরি অব এভরিথিং, তা প্রমাণ হবে ২০০০ সালের মধ্যে। সেটা হয়নি। যদিও সুপারগ্র্যাভিটি তাত্ত্বিক গবেষণাকে অনেকটা সাহায্য করেছে।
তা করুক, তাতে কী আসে-যায়? এক দল বিজ্ঞানী ওই প্রশ্ন তুলেছেন। নিউ ইয়র্কে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পিটার ওইট বলেছেন, ফিজিক্সে তাত্ত্বিক গবেষণার এখন দুঃসময়। দাপিয়ে বেড়াচ্ছে যে সব তত্ত্ব, পরীক্ষায় তাদের সমর্থন মিলছে না। ও দিকে আবার মোটা অর্থের পুরস্কার দিয়ে সেই ব্যর্থ থিয়োরিগুলো সফল প্রমাণের চেষ্টা দেখছি। আরও কড়া মন্তব্য করেছেন ফ্রাঙ্কফুর্টে ইনস্টিটিউট ফর অ্যাডভান্সড স্টাডি-র গবেষিকা স্যাবাইন হসেনফেল্ডার। এই বিজ্ঞানী সম্প্রতি একটি বই লিখেছেন। ‘লস্ট ইন ম্যাথ: হাউ বিউটি লিডস ফিজিক্স অ্যাসট্রে’। ওঁর দাবি, সুন্দর গণিতের সাধনায় পদার্থবিদ্যা ক্রমশই হারিয়ে যাচ্ছে গোলকধাঁধায়। কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। অতীতে একাধিক বিজ্ঞানী এই ধারণার বশবর্তী ছিলেন যে, সুন্দর হলেই তা সত্য হবে। সুব্রহ্মণ্যম চন্দ্রশেখর কিংবা পল অ্যাড্রিয়েন মরিস ডিরাক খুবই বিশ্বাস করতেন ওই মতে। হসেনফেল্ডার মনে করেন, এখন ওই ধারণা পাল্টানোর সময় এসেছে। তিন বিজ্ঞানীকে স্পেশাল ব্রেকথ্রু প্রাইজ়, ওঁর মতে, শুয়োরের ঠোঁটে লিপস্টিক মাখানোর প্রয়াস। ফিজিক্স যেন আর বাস্তবের বর্ণনা নয়, হয়ে দাঁড়িয়েছে গণিত আর দর্শনের জগাখিচুড়ি— এক কল্পনাবিলাস। হসেনফেল্ডার বলেছেন, ফিজিক্সে নয়, তিন বিজ্ঞানীকে প্রাইজ় দেওয়া উচিত ছিল গণিতে। চমৎকার মন্তব্য। পদার্থবিজ্ঞানে গণিত লাগে বটে, তবে শাস্ত্র হিসেবে ও দুটো আলাদা। ফিজিক্স হল বাস্তবের বর্ণনা, আর গণিত হল বিমূর্ত শিল্প, নানা আইডিয়ার মালা গাঁথা, কোনও দায় নেই তার বাস্তবে কী ঘটছে না-ঘটছে, তা দেখার।
ফিজিক্স কি গণিত হয়ে যাচ্ছে?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy