ছবি- শাটারস্টকের সৌজন্যে।
সান্তা ক্লজ ফিবছরেই আসেন। রাতে চুপি চুপি এসে বিছানায় শিশুদের মাথার কাছে রেখে যান হরেক রঙের উপহার। বড়দিনে সান্তা বরাবরই হিরো। শুধু বড়দিনই বা বলছি কেন, ক্রিসমাস ইভ থেকে শুরু করে সান্তা ‘সুপার ডুপার’ হিরো থেকে যান নিউ ইয়ার্স ইভ পর্যন্ত।
‘সুয্যিমামা’র যশোভাগ্য কিন্তু ‘সান্তা দাদু’র মতো নয়। রোজই সে আমাদের চোখে ধরা দেয়। কিন্তু এই ভাবে হিরো হয়ে ওঠে দেড় বছরে (১৮ মাস) এক বার। যখন তার মুখ পুরোপুরি ঢাকা পড়ে যায় চাঁদের ছায়ায়। আমরা বলি পূর্ণগ্রাস। বিজ্ঞানের পরিভাষায়, ‘টোটাল সোলার একলিপ্স’। একে ‘ওকাল্টেশন’ও বলা হয়। সাধারণত, সূর্যের পূর্ণগ্রাস পৃথিবী থেকে সর্বাধিক যতটা জায়গা জুড়ে দেখা যেতে পারে, চওড়ায় তা হয় ১৬০ কিলোমিটার। ভূপৃষ্ঠে সেই এলাকাটা লম্বায় হয় প্রায় ১০ হাজার কিলোমিটার।
তবে সূর্যের পূর্ণগ্রাস মেরেকেটে হতে পারে ৬ কি সাড়ে ৬ মিনিটের জন্য। খুব বেশি হলে যা হতেও পারে বড়জোর সাড়ে ৭ মিনিট। আর তখনই সূর্য হয়ে যায় ৬ থেকে ৭ মিনিটের ‘সুপার ডুপার’ হিরো!
আমাদের চোখে তো বটেই। বিশ্বের সব প্রান্তের সব সূর্যসন্ধানীর চোখেই। যাঁদের মধ্যে পড়েন সৌরপদার্থবিজ্ঞানীরাও।
হরেক রকমের সূর্যগ্রহণ
বড়দিনে সান্তা নিয়ে মাতোয়ারা সবাই। তবু এই কলকাতায় পার্ক স্ট্রিটে সান্তার দাপট যতটা, কুলতলিতে ততটা নয়। ৬ থেকে ৭ মিনিটের জন্য হলে হবে কি, সূর্য যখন হিরো হয়ে ওঠে পূর্ণগ্রাসের কল্যাণে, তখন কিন্তু তা নিয়ে সাড়া পড়ে যায় বিশ্বের প্রায় সর্বত্রই। কারণ, সূর্যকে দেখার, গভীর ভাবে জানার সুযোগটা যে আমাদের ধরাছোঁয়ার মধ্যে এনে দেয় সূর্যের পূর্ণগ্রাসই। যা আর অন্য কোনও উপায়ে অতটা নিখুঁত ভাবে দেখা যায় না। জানা যায় না সূর্যের মনের গভীরে লুকিয়ে থাকা গোপন কথাও।
বড়দিনের সময়ে সান্তাকে যেমন কলকাতার অন্য সব জায়গার তুলনায় পার্ক স্ট্রিটেই দেখা যায় সবচেয়ে বেশি, তেমনই সূর্যের পূর্ণগ্রাসও কোনও নির্দিষ্ট দিনে পৃথিবী জুড়ে হয় না।
কোথাও যদি সেটা পুরোপুরি হয়, তা হলে অন্য কোথাও হবে সূর্যের আংশিক গ্রহণ। বা, খণ্ডগ্রাস। যেখানে পৃথিবীর সামনে এসে চাঁদ পুরোপুরি ঢেকে দিতে পারে না সূর্যকে। বিজ্ঞানের পরিভাষায় যাকে বলা হয়, ‘পার্শিয়াল সোলার একলিপ্স’।
চাঁদের ছায়ার দু’টি অংশ থাকে। একটি ঘন কালো। তাকে বলা হয়, ‘আমব্রা’। সূর্যগ্রহণের সময় পৃথিবীর যে যে এলাকা ‘আমব্রা’র মধ্যে পড়ে, সেখান থেকে সূর্যের পূর্ণগ্রাস দেখা যায়।
সূর্যের পূর্ণগ্রাস। ছবি- শাটারস্টকের সৌজন্যে।
ছায়ার আর একটি অংশের নাম ‘পেনাম্ব্রা’। ঘন কালো ‘আমব্রা’র পাশেই। সেই অংশটি ততটা কালো নয়। আমব্রা’। সূর্যগ্রহণের সময় পৃথিবীর যে যে এলাকা ‘পেনাম্ব্রা’র মধ্যে পড়ে, সেখান থেকে সূর্যের আংশিক গ্রহণ দেখা যায়।
আরও এক ধরনের গ্রাসে পড়তে হয় সূর্যকে। তার নাম বলয়গ্রাস। বিজ্ঞানের পরিভাষায় যার নাম ‘অ্যানুলার সোলার একলিপ্স’। কক্ষপথে প্রদক্ষিণের সময় চাঁদ যখন এমন একটা দূরত্বে চলে যায়, যাতে তার ছায়া সূর্যকে ঢেকে দিতে পারে না পুরোপুরি, তখনই হয় সূর্যের বলয়গ্রাস। যখন চাঁদ সূর্যের মাঝখানটাকে চাকতির মতো ঢেকে দেয় বটে। কিন্তু তার পরেও সেই চাকতির চার পাশ থেকে বেরিয়ে আসতে দেখা যায় সূর্যের আলো। অনেকটা আংটির মতো। ‘অ্যানুলার’ শব্দটি এসেছে লাতিন শব্দ ‘অ্যানুলাস’ থেকে। যার অর্থ ‘আংটি’। বলয়গ্রাসের স্থায়িত্ব হয় বড়জোর ১২ মিনিট।
মাসে একটা করে সূর্যের পূর্ণগ্রাস দেখা যেত!
সূর্যের পূর্ণগ্রাসের জন্য এমন হাপিত্যেশ প্রতীক্ষায় আমাদের বসে থাকতে হত না যদি চাঁদের কক্ষপথ উপবৃত্তাকার (এলিপ্টিকাল) না হয়ে পুরোপুরি বৃত্তাকার (সার্কুলার) হত। চাঁদ যদি আমাদের আরও কাছে থাকত। আর পৃথিবীর কক্ষপথের সঙ্গে যদি একই তলে (প্লেন) থাকত চাঁদের কক্ষপথ। সে ক্ষেত্রে আমরা প্রতি মাসেই একটা করে সূর্যের পূর্ণগ্রাস দেখতে পেতাম।
কিন্তু চাঁদ পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করছে উপবৃত্তাকার কক্ষপথে। পৃথিবীর দিকে ৫ ডিগ্রি কোণে হেলে থেকে। তাই পূর্ণগ্রাস, আংশিক গ্রাস ও বলয়গ্রাস মিলিয়ে বছরে ৫টির বেশি সূর্যগ্রহণ হওয়া সম্ভব নয়।
সত্যজিতের ‘আগন্তুক’ এবং সূর্যগ্রহণ
সত্যজিত রায়ের সেই বিখ্যাত ‘আগন্তুক’ ছবির কথা নিশ্চয়ই মনে আছে আপনাদের। সেখানে একটি চরিত্রকে দিয়ে এই গ্রহণ সম্পর্কে বলাতে গিয়ে সম্ভবত অসতর্ক হয়েই কিছুটা ভুল করে ফেলেছিলেন ফিল্মের স্ক্রিপ্ট রাইটার পরিচালক সত্যজিত। বলেছিলেন, ‘‘চাঁদ, পৃথিবী আর সূর্য একটা ইউনিক অবস্থানে আছে বলেই এই গ্রহণ হয়। চাঁদ দূরে বা কাছে চলে এলে যেটা হবে না।’’
ঘটনাটা ঠিক তা নয় কিন্তু। চাঁদ আমাদের আরও কাছে থাকলে বরং ঘনঘন সূর্যগ্রহণের সম্ভাবনা বাড়ত। তবে এটা ঠিকই, চাঁদ দূরে চলে গেলে পূর্ণগ্রাস দেখার সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিতই হব আমরা।
সূর্যের খণ্ডগ্রাস। ছবি- শাটারস্টকের সৌজন্যে।
আর কয়েকশো কোটি বছর পর সেই দিনটা তো আসছেই আসছে পৃথিবীতে। যে দিন পৃথিবী থেকে সূর্যের পূর্ণগ্রাস দেখা আর সম্ভব হবে না। কারণ, চাঁদ আমাদের ছেড়ে একটু একটু করে দূরে চলে যাচ্ছে। তার ফলে, কয়েকশো কোটি বছর চাঁদ আর সূর্যের মুখ পুরোপুরি ঢেকে দিতে পারবে না। তখন আংশিক গ্রহণ বা বলয়গ্রাস দেখেই ‘দুধের স্বাদ ঘোলে’ মেটাতে হবে পৃথিবীকে।
সূর্যগ্রহণ কেন এত ছোটায় বিজ্ঞানীদের?
কেন সূর্যগ্রহণ হলেই বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে সৌরপদার্থবিজ্ঞানীরা ছুটে যান ‘স্পটে’, যাবতীয় ভৌগোলিক বাধা ডিঙিয়েও, এ বার সেই প্রসঙ্গে আসা যাক। ঘেঁটে দেখা যাক ইতিহাস।
সূর্যগ্রহণ দেখেই চাঁদ আর পৃথিবীর ব্যাস নিখুঁত ভাবে মাপা সম্ভব হয়েছিল। সূর্যগ্রহণের সময় মাপা হয়েছিল চাঁদের ব্যাস। আর চন্দ্রগ্রহণের সময় পৃথিবীর ব্যাস মাপা হয়েছিল।
পৃথিবীর আকার গোল নাকি চৌকো বা চ্যাপ্টা সেটাও প্রথম জানা সম্ভব হয়েছিল সূর্যগ্রহণের দৌলতেই।
আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ (‘থিয়োরি অফ জেনারেল রিলেটিভিটি’)-ও প্রথম উতরে গিয়েছিল সূর্যগ্রহণের সময়ের একটি পরীক্ষাতেই। ১৯১৯ সালে। বিজ্ঞানী আর্থার এডিংটনের পরীক্ষায়। আপেক্ষিকতাবাদ বলেছিল, অভিকর্য বলের জন্য এই ব্রহ্মাণ্ডের স্থান-কাল (স্পেস-টাইম) একেবারে বেঁকেচুরে দুমড়ে মুচড়ে রয়েছে। ব্রহ্মাণ্ডের সেই দোমড়ানো মোচড়ানো অবস্থাটা সেখানেই বেশি, যেখানে কোনও ভারী মহাজাগতিক বস্তু থাকে। যেখানে তুলনায় হাল্কা মহাজাগতিক বস্তু থাকে, সেখানে ব্রহ্মাণ্ডের স্থান-কাল অতটা দুমড়ে মুচড়ে নেই।
সূর্যের পূর্ণগ্রাসের সময়েই প্রথম দেখা গিয়েছিল ‘করোনাল মাস ইজেকশান (সিএমই)’-র মতো ঘটনা। ১৮৬০ সালে। যা মহাকাশের আবহাওয়ার (‘স্পেস ওয়েদার’) পক্ষে অত্যন্ত ক্ষতিকারক। এমন ঘটনা যে ঘটে সূর্যে আগে তা কারও জানাই ছিল না। অনেক পরে উপগ্রহের ‘চোখে’ও ধরা পড়ে সেই ঘটনা।
সূর্যের বলয়গ্রাস। ছবি- শাটারস্টকের সৌজন্যে।
ফলে, আলোকে সেই পথে যেতে হলে তার গতিপথও বেঁকে যাবে। তা সরলরেখায় যেতে পারবে না। ফলে, ওই সময় বুধ গ্রহকে যেখানে দেখতে পাওয়ার আশা করা হয়েছিল, সূর্যের সবচেয়ে কাছে থাকা গ্রহটিকে সেখান থেকে কিছুটা সরে গিয়ে অন্যত্র দেখা গিয়েছিল। সূর্যগ্রহণের সময় আলোর ওই আঁকাবাঁকা গতিপথ দেখেই আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদকে পরীক্ষায় উতরে দিতে পেরেছিলেন এডিংটন।
সূর্যের রহস্যটা কোথায়?
সূর্যের একেবারে অন্দরে যেখানে পরমাণু চুল্লিটা আছে, সেখানকার তাপমাত্রা প্রায় দেড় কোটি ডিগ্রি কেলভিন। সেখান থেকে সূর্যের পিঠ বা ফোটোস্ফিয়ারের দূরত্বটা ৭ লক্ষ কিলোমিটার। যেখানকার তাপমাত্রা ৫ হাজার ৭০০ থেকে ৬ হাজার ডিগ্রি কেলভিন বড়জোর।
কিন্তু তার পরেই যেন হঠাৎ ক্ষেপে উঠল সূর্য! পিঠ থেকে ২ হাজার কিলোমিটার উপরে থাকা তার বায়ুমণ্ডলের সবচেয়ে নীচের স্তরটিকে তাতিয়ে তুলল রীতিমতো গনগনে ১০ হাজার বা তারও কিছু বেশি ডিগ্রি কেলভিন তাপমাত্রায়। ওই স্তরের নাম ‘ক্রোমোস্ফিয়ার’।
চমকের শেষ নয় এখানেই। ক্রোমোস্ফিয়ার থেকে শুরু হল সূর্যের বায়ুমণ্ডল। বিজ্ঞানের পরিভাষায় যার নাম ‘করোনা’। ফোটোস্ফিয়ার থেকে যে করোনার শেষ প্রান্তটার দূরত্ব প্রায় ৭০ লক্ষ কিলোমিটার।
সূর্যের পূর্ণগ্রাসের সময়কার আকাশ। ছবি সৌজন্যে: নাসা
রহস্যের জন্ম হল। সূর্যের অন্দরে থাকা পরমাণু চুল্লির তুলনামূলক ভাবে কাছে থাকা সত্ত্বেও ফোটোস্ফিয়ারের তাপমাত্রা যেখানে মাত্র ৬ হাজার ডিগ্রি কেলভিন, সেখানে পরমাণু চুল্লি থেকে তার প্রায় ১০ গুণ দূরত্বে থাকা করোনার তাপমাত্রা কী ভাবে একলাফে বেড়ে হয়ে যায় ১০ লক্ষ ডিগ্রি কেলভিন?
সেই রহস্যের জট খুলতেই সূর্যকে আমাদের আরও গভীর ভাবে চেনা, জানার প্রয়োজন হয়। কয়েক শতাব্দী ধরে এর উত্তর খুঁজতে গিয়ে বিভিন্ন তত্ত্বের জন্ম হয়েছে।
করোনায় সূর্যের বিপরীতধর্মী (ধনাত্মক ও ঋণাত্মক) দু’ধরনের চৌম্বক ক্ষেত্রগুলি এক অন্যের কাছে এসে নিজেদের ধ্বংস করে ফেললে বিপুল পরিমাণে চৌম্বক শক্তি জন্ম হয়। যা পরিবর্তিত হয় তাপশক্তি ও গতিশক্তিতে। করোনার প্রচণ্ড তাপমাত্রার অন্যতম কারণ এটি, মনে করেন বিজ্ঞানীদের একাংশ।
আবার বিজ্ঞানীদের কেউ কেউ মনে করেন, সূর্যের পিঠ বা ফোটোস্ফিয়ারে যেখানে চৌম্বক ক্ষেত্রগুলি রয়েছে, সেখান থেকে এক ধরনের তরঙ্গ (অ্যালফ্ভেন ওয়েভ) বেরিয়ে আসে। ওই তরঙ্গের জন্ম হয় ফোটোস্ফিয়ারের নীচে ঢুকে যাওয়া চৌম্বক ক্ষেত্রগুলির নীচের অংশগুলির মধ্যে সব সময় কাঁপাকাঁপি চলে বলে। একটা তারকে এক জনের হাতে ধরিয়ে তারের অন্য প্রান্তটি আপনার হাতে নিয়ে ঝাঁকালে যেমন তরঙ্গের জন্ম হয়, ঠিক তেমনই। ওই তরঙ্গ করোনায় পৌঁছে তার তাপমাত্রা কয়েক লক্ষ গুণ বাড়িয়ে দেয়। সেই তরঙ্গগুলি যদি লম্বায় খুব বড় হয়, তা হলে তা সূর্যের বায়ুমণ্ডল ছাড়িয়ে বাইরের মহাকাশেও ছড়িয়ে পড়ে। তরঙ্গ খুব শক্তিশালী হলে তা সৌরবায়ুর (সোলার উইন্ড) গতিবেগ অসম্ভব বাড়িয়ে দিতে পারে।
রয়েছে আরও তত্ত্ব। ‘নানা মত নানা মুনি’র। যদিও রহস্যের জট পুরোপুরি খোলেনি এখনও পর্যন্ত। বোঝা যায়নি করোনায় কী ভাবে তার ‘খেলাধুলো’ চালিয়ে যাচ্ছে সূর্যের চৌম্বক ক্ষেত্রগুলি।
সূর্যের বলয়গ্রাস আর পূর্ণগ্রাসের মধ্যে ফারাকটা কোথায়? দেখুন ভিডিয়ো
করোনাকে দেখার প্রয়োজন হয় কেন?
সেই জট খুলতেই সূর্যের করোনাকে দেখতে হয়। কিন্তু সূর্যের করোনাকে কোনও দিনই খালি চোখে দেখা সম্ভব নয়। তার ঘনত্ব খুব কম, ফলে আলোর বিচ্ছুরণও (স্ক্যাটারিং) কমই ঘটে। তুলনায় ফোটোস্ফিয়ার অনেক বেশি ঘন। তার থেকে বিচ্ছুরণ বেশি।ফলে উজ্জ্বলতাও বেশি। সেই ঔজ্জ্বল্যেই ঢেকে যায় করোনা। আমরা সব সময়েই সূর্যের ফোটোস্ফিয়ারকে দেখি। দুই মেরুতে বিভিন্ন ‘অরোরা’ বা মেরুজ্যোতি দেখার সময়েই আমরা করোনার কিছুটা প্রভাব দেখতে পাই।
আর দেখা যায় সূর্যের পূর্ণগ্রাস হলে। সেই সময় চাঁদ যেহেতু সূর্যের ফোটোস্ফিয়ারকে পুরোপুরি ঢেকে দেয়, তাই করোনা ধরা দেয় আমাদের চোখে। করোনা নিয়ে তাঁদের যাবতীয় পরীক্ষা করে নেওয়ার জন্যে বিজ্ঞানীরা যে কারণে মুখিয়ে বসে থাকেন পূর্ন গ্রাসের অপেক্ষায়। কিন্তু গবেষণার জন্য তো আর প্রকৃতির উপর ভরসা রেখে বসে থাকলে হবে না। কবে একটা সূর্যগ্রহণ হবে, তার অপেক্ষায় থাকতে হলে তো সৌরপদার্থবিজ্ঞানীদের খুব মুশকিল।
তাই বানানো হয়েছে ‘করোনাগ্রাফ’। পূর্ণ-গ্রাসের সময় চাঁদ যে ভাবে সূর্যের মাঝখানটাকে ঢেকে দেয়, অনেকটা সেই কৌশলেই কাজ করে করোনাগ্রাফ। তার ফলে, সূর্যগ্রহণ না হলেও করোনাগ্রাফ দিয়ে সূর্যের ফোটোস্ফিয়ারকে ঢেকে তার করোনার মন বোঝার চেষ্টা করেন বিজ্ঞানীরা।
তবু প্রকৃতিকে টেক্কা দিতে পারে না করোনাগ্রাফ
এ বার ভাবা যাক বলয়গ্রাসের কথা। তখন ফোটোস্ফিয়ার পুরোপুরি ঢাকা পড়ে না। তার ৯৯ শতাংশ ঢাকা পড়ে। এবং তখনও করোনার চেয়ে সূর্যের ফোটোস্ফিয়ারের ঔজ্জ্বল্য অন্তত ১০ হাজার গুণ বেশি হয়। যদিও দেখা গিয়েছে, করোনাগ্রাফ ও বলয়গ্রাসের সমন্বয়ে করোনা থেকে যে তথ্য পাওয়া সম্ভব, শুধু করোনাগ্রাফ দিয়ে তত ভালো না-ও পাওয়া যেতে পারে। এ ছাড়াও, পূর্ণগ্রাসের সময় ব্যবহার করা হবে এমন বেশ কিছু যন্ত্র পরীক্ষা করে নেওয়া হয় বলয়গ্রাসের সময়। তাই সৌরপদার্থবিজ্ঞানীদের কাছে এর গুরুত্ব অপরিসীম।
‘করোনাগ্রাফ’ দিয়ে যে ভাবে ঢেকে দেওয়া হয় সূর্যের মুখ। ছবি সৌজন্যে: নাসা
আরও কিছু দেখা যায় পূর্ণগ্রাসে...
পূর্ণগ্রাসে আরও দু’টি ঘটনা ঘটে।
চাঁদ সূর্যকে পুরোপুরি ঢেকে দিলে (পূর্ণগ্রাস) ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রাও ঝপ্ করে নেমে যায় ৭ থেকে ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এই পর্যবেক্ষণ আগামী দিনে আমাদের উষ্ণায়ন কমাতে কোনও প্রযুক্তিগত ব্যবস্থা নেওয়ার হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে।
এ ছাড়াও সূর্য থেকে পৃথিবী-সহ গোটা সৌরমণ্ডলে প্রতি মুহূর্তে ছিটকে আসছে, ছড়িয়ে পড়েছে অসম্ভব শক্তিশালী ও ক্ষতিকারক কণা। সেই কণাগুলি সূর্য থেকে ছিটকে বেরিয়ে এসে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের যে স্তরটিকে প্রথম আঘাত করে তার নাম ‘আয়নোস্ফিয়ার’। কণাগুলি কী ভাবে কী পরিমাণে আছড়ে পড়ছে আয়নোস্ফিয়ারে, আমাদের উপগ্রহ ও যোগাযোগব্যবস্থার নিরাপত্তার জন্যই তা জানা ও বোঝার প্রয়োজন বিজ্ঞানীদের। সূর্যগ্রহণ সেই সুযোগটাও এনে দেয় সৌরপদার্থবিজ্ঞানীদের সামনে।
বৃহস্পতিবার সূর্যকে নামানো হচ্ছে নেট প্র্যাকটিসে!
সূর্য আমাদের প্রাণ দেয়। তবে তাকে চিনতে গেলে কিন্তু প্রয়োজন তার অনুপস্থিতি। অর্থাৎ, গ্রহণ। বলয়গ্রাস তাই বিজ্ঞানীদের কাছে অনেকটা নেট-প্র্যাকটিসের মতো। আসল খেলার (পূর্ণগ্রাস) আগে।
লেখক মোহনপুরের ‘ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ (আইসার- কলকাতা)’-এর পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক
অনুলিখন: সুজয় চক্রবর্তী
গ্রাফিক: তিয়াসা দাস, শৌভিক দেবনাথ
ভিডিয়ো সৌজন্যে: নাসা
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy