ছবি- শাটারস্টকের সৌজন্যে।
রক্ত দিতে হবে না। আপনার স্মার্টফোনে থুতু ফেললেই জেনে যাবেন ম্যালেরিয়া হয়েছে কি না। জানতে পারবেন, কতটা আক্রান্ত হয়েছেন ম্যালেরিয়ায়। কম না বেশি?
আর ক’টা দিন পর হয়তো আপনার স্মার্টফোনে ফেলা থুতুই জানিয়ে দিতে পারবে আপনি ঠিক কতটা অবসাদে ডুবে রয়েছেন বা উদ্বেগে রয়েছেন কতটা? বলে দিতে পারবে কোনও একটি মুহূর্তে ঠিক কতটা মানসিক চাপে আপনি বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছেন। নাকি যতটা বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছেন মনে করছেন, ততটা হননি। জেনে ফেলা যাবে হার্টের সমস্যায় কতটা ভুগছি আমি, আপনি?
চিকিৎসক বা প্যাথলজিক্যাল ল্যাবরেটরিতে ছুটোছুটি না করে আমাদের হাতে প্রায় সব সময় থাকা মোবাইল ফোনে ঝট্ করে এই সব জেনে নেওয়ার নতুন পথ দেখালেন বেহালার বেচারাম চ্যাটার্জি রোডের বাসিন্দা স্থিতধী। স্মার্টফোনের সঙ্গে খুব পাতলা আর ছোট্ট একটা ‘চিপ’ জুড়ে। যা আদতে একটি ‘পোর্টেবল ল্যাবরেটরি’। বা ‘ল্যাব-অন-চিপ’।
অধুনা আমেরিকার সিনসিনাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক স্থিতধী ঘোষ ও তাঁর সহযোগীদের সাম্প্রতিক গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছে ‘নেচার’ গ্রুপের আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান-জার্নাল ‘মাইক্রোসিস্টেমস অ্যান্ড ন্যানোইঞ্জিনিয়ারিং’-এ। জানুয়ারি সংখ্যায়। যে গবেষকদলে রয়েছেন স্থিতধীর রিসার্চ গাইড, সিনসিনাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক চোঙ আনও।
বিভিন্ন রোগের ইঙ্গিত মিলবে কী ভাবে?
আমাদের রক্ত বা নানা ধরনের দেহরস (‘বডি ফ্লুইড’) অথবা থুতুতে (‘স্যালাইভা’) মিশে থাকে নানা ধরনের হরমোন ও প্রোটিন। বিজ্ঞানের পরিভাষায় যাদের বলা হয়, ‘বায়ো-মার্কার্স’। তাদের মধ্যে অন্যতম- ‘কর্টিসল’, ‘আলফা অ্যামাইলেজ’ ও ‘প্যারা-থাইরয়েড হরমোন (পিটিএইচ)। যেগুলি নানা ধরনের সংক্রমণের সঙ্গে জড়িত। বিভিন্ন সংক্রমণের সঙ্গে সঙ্গে রক্ত, নানা ধরনের দেহরস ও থুতুতে এদের পরিমাণের তারতম্য ঘটে। সেই তারতম্য হয়েছে কি না বা হলে কতটা হয়েছে, তা থুতু-পরীক্ষার পর আমরা এ বার নিজেদের স্মার্টফোন থেকেই জেনে নিতে পারব। স্মার্টফোনের সঙ্গে জোড়া খুব পাতলা আর ছোট্ট একটা চিপে থুতু ফেলে। আর স্মার্টফোনে বিশেষ একটি অ্যাপ ডাউনলোড করে।
সেই গবেষণাপত্র। ইনসেটে, স্থিতধী ঘোষ ও তাঁর রিসার্চ গাইড অধ্যাপক চোঙ আন।
চালু পদ্ধতির সীমাবদ্ধতা
এই পদ্ধতিতে বিভিন্ন দেশে ডায়াবিটিস ও মাতৃত্বের প্রাথমিক পরীক্ষা চালু হয়েছে বেশ কিছু দিন। কিন্তু ম্যালেরিয়া বা মানসিক অবসাদের মাত্রা বোঝার ক্ষেত্রে এটা এখনও চালু হয়নি।
আরও পড়ুন- ঘন ঘন ভয়ঙ্কর ভূমিধসের আশঙ্কা নেপাল-তিব্বত হিমালয়ে, জানাল নাসা
আরও পড়ুন- লাগবে না বডি স্ক্যানার, চালের দানার মতো রাডার বানালেন বঙ্গসন্তান
এখনকার পদ্ধতির আরও একটা সীমাবদ্ধতা রয়েছে। শুধুই ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ বলা যায়। বলা যায়, কেউ মা হতে চলেছেন কি না অথবা কারও ডায়াবিটিস হয়েছে কি হয়নি। তার বেশি নিখুঁত ভাবে কিছু বলা সম্ভব হয় না।
কিন্তু ম্যালেরিয়ার সংক্রমণ বুঝতে হলে তার মাত্রাটা বোঝা জরুরি। জানা দরকার, রক্তে ম্যালেরিয়ার বাহক পরজীবী ‘প্লাসমোডিয়াম ফ্যালসিপেরাম’ কী পরিমাণে ঢুকেছে?
স্থিতধীর কথায়, ‘‘এই পরজীবী ঢুকলেই রক্তে এক ধরনের প্রোটিনের পরিমাণ স্বাভাবিকের ৩/৪ গুণ হয়ে যায়। প্রোটিনটির নাম- ‘হিস্টাডাইন রিচ প্রোটিন (এইচআরপি-২)’। তখন প্রতি মিলিলিটার রক্তে এইচআরপি-২ থাকে অন্তত ৮ ন্যানোগ্রাম করে।’’
স্মার্টফোনের সঙ্গে যে ভাবে জোড়া থাকবে সেই চিপ। এক হাতে ধরা সেই চিপ।
স্মার্টফোনে রক্তপরীক্ষার চালু পদ্ধতিতে নিখুঁত ভাবে সেই পরিমাণটা মাপা অসম্ভবই। ফলে, রক্তপরীক্ষা করানোর জন্য আমাদের যেতেই হচ্ছে প্যাথলজিক্যাল ল্যাবরেটরিতে। সেখানে যাবেন কি না জানতে যেতে হচ্ছে চিকিৎসকের কাছে। তার মানে, শুধু ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়েছি কি না জানতে, বুঝতেই চিকিৎসক লাগছে, প্যাথলজিক্যাল ল্যাবরেটরিতে প্রশিক্ষিত কর্মী নিয়োগ করতে হচ্ছে।
স্থিতধীর পদ্ধতির অভিনবত্ব কোথায়?
স্থিতধীর উদ্ভাবিত পদ্ধতিতে সে সবের প্রয়োজনই হবে না। কেন? গবেষকরা তার জন্য একটি চিপ বানিয়েছেন। লম্বা ও চওড়ায় যা ৩ সেন্টিমিটার করে। মাত্র ১ মিলিমিটার পুরু। সেই চিপেই থাকবে প্লাস্টিকের একটি কুয়ো বা গর্ত। যা ভরা থাকবে বিশেষ একটি অ্যান্টিবডিতে। রক্ত বা থুতু চিপে ফেললে তাতে মিশে থাকা প্রোটিন বা হরমোনকে (অ্যান্টিজেন) গায়ে সাঁটিয়ে নিতে বা বেঁধে ফেলতে পারবে সেই অ্যান্টিবডি। তাই এই অ্যান্টিবডিগুলিকে বলা হয়, ‘ক্যাপচার অ্যান্টিবডি’। চিপে আরও এক ধরনের অ্যান্টিবডি রেখেছেন স্থিতধীরা। তার নাম- ‘ডিটেকশন অ্যান্টিবডি’। রক্ত বা থুতু থেকে আসা হরমোন বা প্রোটিনের একটা দিক ক্যাপচার অ্যান্টিবডি ধরে থাকে, অন্য দিকটি ধরা থাকে ‘ডিটেকশন অ্যান্টিবডি’-র সঙ্গে। ডিটেকশন অ্যান্টিবডিগুলির সঙ্গে থাকে উৎসেচকও।
ডিটেকশন অ্যান্টিবডিগুলিই বলে দিতে পারে, সংক্রমণ বা কোনও রোগের ফলে রক্তে ঠিক কতটা বেড়েছে কোনও বিশেষ হরমোন বা প্রোটিনের পরিমাণ। যার থেকে হিসাব কষে বলে দেওয়া যায়, ম্যালেরিয়ার পরজীবীরা কী পরিমাণে রক্তে ঢুকে ও ছড়িয়ে পড়েছে।
দেহে হরমোন-প্রোটিনের কমা-বাড়া কী ভাবে বুঝতে পারব?
স্থিতধী জানিয়েছেন, চিপে একটি কেমোলুমিনোসেন্ট পাউডার রাখা আছে। দু’ধরনের অ্যান্টিবডির সঙ্গে রক্ত বা থুতু থেকে এসে মিশছে যে হরমোন বা প্রোটিন, তাদের বিক্রিয়ায় ওই পাউডারের জন্যই আলো বেরিয়ে আসবে। সেই আলো দেখেই বোঝা যাবে সংক্রমণ হয়েছে কি না। এই আলোটা পাওয়ার জন্য বাইরে থেকে আলো ফেলতে হচ্ছে না। আলোর জন্ম হচ্ছে বিক্রিয়াজাত শক্তি থেকেই। সেই আলোর উজ্জ্বলতার বাড়া-কমা মেপে আমার, আপনার স্মার্টফোনে ডাউনলোড করা একটি অ্যাপ জানিয়ে দেবে, সংক্রমণের মাত্রা কতটা? আর সেটা করা সম্ভব হবে খুব সামান্য বিদ্যুৎশক্তিতেই।
এই পদ্ধতির সুবিধা কী কী?
স্থিতধী জানাচ্ছেন, ডায়াবিটিস, মাতৃত্বের পরীক্ষার জন্য চালু পদ্ধতিতে যেখানে প্রয়োজন অন্তত ১৫০ মাইক্রো-লিটার রক্ত, সেখানে এই পদ্ধতিতে রক্ত লাগবে মাত্র ২০ মাইক্রো-লিটার। আর মাত্র ৩০ মাইক্রো-লিটার থুতু চিপে ফেলতে পারলেই তাতে মিশে থাকা কর্টিসল হরমোনের পরিমাণ বেড়েছে কি না বা কতটা বেড়েছে, তা জেনে নেওয়া সম্ভব হবে আমাদের। অবসাদ (ডিপ্রেশন), চাপ (স্ট্রেস) ও উদ্বেগে (অ্যাংজাইটি)-র মতো মানসিক রোগে আমরা ভুগছি কি না, তা জানার জন্য স্মার্টফোনে হেল্থ-অ্যাপ চালু হয়েছে কিছু দিন ধরে। কিন্তু কতটা অবসাদ বা মানসিক চাপে অথবা উদ্বেগে ভুগছি আমরা, তার সঠিক পরিমাপ করা এখনও সম্ভব নয় এই অ্যাপগুলির মাধ্যমে।
স্থিতধীরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন, এ বার যাতে সেই সমস্যারও সুরাহা হয়।
ছবি ও ডায়াগ্রাম সৌজন্যে: সিনসিনাটি বিশ্ববিদ্যালয়, আমেরিকা
গ্রাফিক-তথ্য: স্থিতধী ঘোষ, সিনসিনাটি বিশ্ববিদ্যালয়
গ্রাফিক: তিয়াসা দাস
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy