Advertisement
২৫ নভেম্বর ২০২৪
Jim Peebles

‘আমার তত্ত্বের ফাঁকফোকর খুঁজছি, তোমরাও খুঁজে দেখ’, এখনও বলেন জিম পিবল্‌স

পিবল্‌স বললেন, আমাদের চেনা, জানার জগতটা খুব ছোট্ট। আমরা জানি সামান্য কয়েকটা কণাকে। যাদের ‘ব্যারিয়ন’ বলা হয়। তাদের বাইরেও রয়েছে অসংখ্য অগণ্য কণা, যাদের খোঁজ এখনও মেলেনি।

বাঁ দিকে জিম পিবলস, ডান দিকে লেখক। গ্রাফিক: তিয়াসা দাস।

বাঁ দিকে জিম পিবলস, ডান দিকে লেখক। গ্রাফিক: তিয়াসা দাস।

তরুণ সৌরদীপ
পুণে শেষ আপডেট: ১৪ অক্টোবর ২০১৯ ০৮:০০
Share: Save:

জিম পিবল্‌স এখনও বলেন, ‘‘আমার ‘স্ট্যান্ডার্ড মডেল অফ কসমোলজি’তে কিছু ফাঁকফোকর রয়েছে কি না তোমরা খুঁজে দেখ। আমিও দেখছি।’’ কথাটা যে একান্তে বলেন, তা নয়। সাংবাদিক সম্মেলনেও বলেছেন। আগামী ডিসেম্বরে পদার্থবিজ্ঞানের নোবেল পুরস্কার নিতে মঞ্চে উঠেও পিবল্‌স সেই কথাটাই আবার বলেন কি না, তা শোনার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকব।

পিবলস বিগ ব্যাং থিয়োরি নিয়ে কাজ করছেন সাতের দশক থেকে। ‘হট বিগ ব্যাং মডেল’ বলছে, ব্রহ্মাণ্ডের জন্ম হয়েছিল প্রচণ্ড বিস্ফোরণ দিয়ে। প্রথমে সেখানে বিশাল ঘনত্বের পদার্থ ছিল। তখন ব্রহ্মাণ্ডের তাপমাত্রাও ছিল কল্পনাতীত ভাবে বেশি। বিস্ফোরণ হওয়ার পর প্রতি মুহূর্তে ফুলে ফেঁপে দ্রুত হারে চার দিকে ছড়িয়ে পড়েছে এই ব্রহ্মাণ্ড। সেটা এখনও হয়ে চলেছে। এটাকেই বলা হয় ‘হট বিগ ব্যাং’ মডেল।

এই মডেলের উপর নির্ভর করেই সাতের দশক থেকে পিবল্‌সের বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে। পিবল্‌স তাঁর গবেষণাপত্রে এক সম্পূর্ণ অজানা অচেনা জগতের দরজাটা হাট করে খুলে দিয়েছিলেন। সেই জগতটা হল অদৃশ্য কণা বা ‘ডার্ক ম্যাটারে’র দুনিয়া। আমাদের চেনা, জানা কণাদের দিয়ে তৈরি যে সব পদার্থকে সচরাচর দেখি তাদের বলা হয় ‘ব্যারিয়নিক ম্যাটার’। ইলেকট্রন, প্রোটন ও নিউট্রনের মতো কণা বা কণিকাগুলি আদতে ‘ব্যারিয়ন’। এই ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির পর থেকেই এই ধরনের কণাদের অস্তিত্বের কথা আমরা জানি। এদের আমরা চিনি।

কিন্তু পিবল্‌স বললেন, আমাদের চেনা, জানার জগতটা খুব ছোট্ট। আমরা জানি সামান্য কয়েকটা কণাকে। যাদের ‘ব্যারিয়ন’ বলা হয়। তাদের বাইরেও রয়েছে অসংখ্য অগণ্য কণা, যাদের খোঁজ এখনও মেলেনি।

কথাটা কী ভাবে বললেন পিবল্‌স?

পিবল্‌স দেখালেন, আমাদের জানা কণাদের মোট ওজন যোগ করলে যা হয়, এই ব্রহ্মাণ্ডের ভর তার বহু বহু গুণ বেশি। তা হলে ব্রহ্মাণ্ডের সেই বাড়তি ভরটা আসছে কোথা থেকে?

আরও পড়ুন- বিশ্বতত্ত্বের ‘ঠাকুরদা’ বললেন, ‘খুঁজলে, বিগ ব্যাংয়ের আঁচ এখনও মিলবে’​

আরও পড়ুন- সৃষ্টির তত্ত্ব আর ভিন্-তারার গ্রহ খুঁজে নোবেল​

পিবল্‌স পরে জানালেন, রয়েছে ডার্ক এনার্জিও

পিবলস বললেন, সেই বাড়তি ভরের কারণ ডার্ক ম্যাটার। তার দু’-তিন বছর পর পিবল্‌স এও জানালেন, ব্রহ্মাণ্ডের এতটা ভরের কারণ শুধু ডার্ক ম্যাটারই নয়। রয়েছে অদৃশ্য শক্তি বা ‘ডার্ক এনার্জি’ও। এই ডার্ক এনার্জি ব্রহ্মাণ্ডকে দ্রুত ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে দিচ্ছে, চার দিকে। যার ফলে, প্রতি মুহূর্তে একটি গ্যালাক্সি অনেক দূরে চলে যাচ্ছে অন্য গ্যালাক্সি থেকে। যেমন, বেলুন ফোলালে তার গায়ের উপর দু’টি বিন্দুর মধ্যে দূরত্ব বেড়ে যায়।

২০১১ সালে গোয়ায় আইসিজিসি-তে নক্ষত্র সমাবেশ

সেই ডার্ক ম্যাটারের জাতপাত নিয়ে অবশ্য অনেক বিতর্ক ও গবেষণা এখনও চলছে বিজ্ঞানী মহলে। যদিও ‘কোল্ড ডার্ক ম্যাটারে’র অস্তিত্বের প্রমাণ আগেই দিয়েছিলেন বিজ্ঞানীরা। কোল্ড ডার্ক ম্যাটার তড়িৎ-চুম্বকীয় ক্ষেত্র আর আলোর দ্বারা প্রভাবিত হয় না। সেগুলি আলোকে বাধা দেয় না, শুষে নেয় না, প্রতিফলিতও করে না। তাই কোল্ড ডার্ক ম্যাটার কোনও ভাবেই দেখতে পাওয়া যায় না।

ব্রহ্মাণ্ডের বিপুল ভরের ব্যাখ্যা মিলল কোন্ড ডার্ক ম্যাটারের অস্তিত্বে

পরে গবেষণায় দেখা গিয়েছে, পিবল্‌সের ‘স্ট্য়ান্ডার্ড মডেল অফ কসমোলজি’র সঙ্গে খাপ খাচ্ছে কোল্ড ডার্ক ম্যাটার থিয়োরিই। এও দেখা গিয়েছে, সেই কোল্ড ডার্ক ম্যাটারের মোট ভর আমাদের চেনা জানা ব্যারিয়নিক ম্যাটারের ৬ গুণ। ফলে, আমাদের চেনা-জানা কণার মোট ভরের চেয়ে কেন ব্রহ্মাণ্ডের ভর এতটা বেশি, তার একটা গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা পাওয়া গেল।

কসমিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড (সিএমবি)

তবে পিবল্‌সের গবেষণায় গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল- ‘কসমিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড’ (সিএমবি)-এর ‘ফ্লাকচুয়েশন’ বা ওঠা-নামা। তিনি বিভিন্ন পরীক্ষানিরীক্ষার মাধ্য়মে দেখালেন, ব্রহ্মাণ্ড যদি শুধুই ব্যারিয়নিক ম্যাটার দিয়েই গড়া হত, তা হলে সিএমবি-র ফ্লাকচুয়েশনটা চালু তাত্ত্বিক মডেলগুলির পূর্বাভাসের ১০ গুণ বেশি হয়। তখনই পিবল্‌স বললেন, তা হলে নিশ্চয়ই ব্যারিয়নিক ম্যাটারের বাইরেও পদার্থের একটা অজানা, অচেনা জগৎ রয়েছে। আরে সেই অজানা, অচেনা কণা ও তাদের দিয়ে গড়া অচেনা পদার্থ ব্রহ্মাণ্ডে থাকলেই সিএমবি-র ওঠা-নামার পরিমাণটাকে সঠিক ভাবে মেপে ওঠা সম্ভব হচ্ছে। সেটাই ‘কোল্ড ডার্ক ম্যাটারের ব্রহ্মাণ্ড ‘।

বিগ ব্যাংয়ের পর ব্রহ্মাণ্ড যখন প্রচণ্ড উত্তপ্ত অবস্থায় ছিল, তখন তার মধ্যে থেকে বিকিরণও (রেডিয়েশন) হত। যেমনটা হয় যে কোনও উত্তপ্ত পদার্থ থেকেই। সেই বিকিরণই ব্রহ্মাণ্ডে ছড়িয়ে পড়েছিল তড়িৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গের মাধ্যমে। ফলে, সেই তরঙ্গের মধ্যেই এই ব্রহ্মাণ্ডের অতীতের ইতিহাস লুকিয়ে রয়েছে বলে বিজ্ঞানীদের জোরালো বিশ্বাস। তাঁরা মনে করেন, সেই তরঙ্গ বিশ্লেষণ করেই ব্রহ্মাণ্ডের অনেক তথ্য পাওয়া যায় এবং যাবে। বিগ ব্যাংয়ের পর বেরিয়ে আসা সেই বিকিরণ ব্রহ্মাণ্ডে ছড়িয়ে রয়েছে কসমিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ডে। আগে টেলিভিশনে সম্প্রচার হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেলে স্ক্রিনে যে ঝিরঝিরে ছবি ভেসে আসত, তারই একটি অংশ এই কসমিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড বা, সিএমবি।

পিবল্‌সের মডেল নিয়ে গবেষণা চালায় ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির ‘প্ল্যাঙ্ক’ স্পেস অবজারভেটরি’। বিজ্ঞানী ম্যাক্স প্ল্যাঙ্কের নামে রয়েছে যে অবজারভেটরি। সেই গবেষণার ফল প্রকাশিত হয় ২০১৩ সালে। ২০১৮ সালে প্ল্যাঙ্ক স্পেস অবজারভেটরির সবক’টি গবেষণাপত্রই প্রকাশিত হয়। তার পর বিভিন্ন পর্যবেক্ষণে পিবল্‌সের ‘স্ট্যান্ডার্ড মডেল অব কসমোলজি’ দৃঢ় ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। তারই স্বীকৃতি হিসাবে ২০১৯-এ পদার্থবিজ্ঞানে নোবেলের জন্য জিম পিবল্‌সের নাম ঘোষণা করা হয়েছে।

২০১১ গোয়ায় এসে কী বলেছিলেন পিবলস, দেখুন ভিডিয়ো

নোবেল পুরস্কারের মঞ্চে কী বলবেন ‘গ্র্যান্ড ড্যাডি’?

নিজের কাজ নিয়ে বার বার পর্যালোচনা করেছেন পিবল্‌স। আমার মনে হয়, এ বার নোবেল পুরস্কার ঘোষণার পর তিনি হয়তো স্বীকার করবেন, তাঁর তত্ত্ব মহাকাশবিজ্ঞান গবেষণায় সত্যিই পথপ্রদর্শক তত্ত্ব। তাঁকে আধুনিক মহাকাশবিজ্ঞানের ‘গ্র্যান্ড ড্যাডি’ বলা হয়।

তবে আমি নিশ্চিত, এর পরেও তিনি সেই কথাই আবার বলবেন, যে কথা তিনি আগেও বহু বার আউড়েছেন। বলেছেন, “আগেও অনেক ভাল ভাল তত্ত্ব বা ধারণা সামনে এসেছে। সেগুলি যদি তখন ভাল হয়, তা হলে এখন নয় কেন?” আমরা সবাই ডিসেম্বরে নোবেল পুরস্কারের মঞ্চে পিবল্‌সের বক্তব্য শোনার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকব।

ভারতের মহাকাশ গবেষণা কত দূর এগিয়েছে, আলোচনায় বার বার আমার কাছে তা জানতে চেয়েছেন পিবল্‌স। সে দিন টের পেয়েছিলাম ভারতের বিজ্ঞান গবেষণা সম্পর্কে পিবল্‌সের গভীর আগ্রহের কথা।

দুই বিশিষ্ট মহাকাশবিজ্ঞানী জিম পিবল্‌স (বাঁ দিকের পিছনে) ও ডিক বন্ড (ডান দিকের পিছনে)। ছবি তুলছেন লেখক। প্যারিসে, ২০০৪-এ।

কাছ থেকে দুই ‘মহাসাগর’কে দেখেছি, দেখে চলেছি...

একটা ঘটনার কথা মনে পড়ছে। সেটা ২০০৪ সাল। প্যারিসে মুখোমুখি দেখা হয়ে গেল পিবল্‌সের সঙ্গে। আমার মহাকাশ গবেষণা কেমন এগচ্ছে, জানতে চাইলেন। উনি জানতেন আমি ভারতে জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চার অগ্রদূত বিজ্ঞানী জয়ন্ত বিষ্ণু নারলিকারের ছাত্র। তখন আমি নারলিকারের হাতে গড়া পুণের ‘ইন্টার-ইউনিভার্সিটি সেন্টার ফর অ্যাস্ট্রোনমি অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোফিজিক্স (আয়ুকা)’-এর অধ্যাপকও। কথায় কথায় জানতে চাইলেন, ‘‘নারলিকার এখনও কেন হট বিগ ব্যাং মডেল মেনে নিতে চাইছেন না?’’ আমি তাঁকে আমার বক্তব্য জানিয়েছিলাম, বিজ্ঞানীর দৃষ্টিকোণ থেকেই।

সেটা শুনে পিবল্‌স অবাক হয়ে গিয়েছিলেন আমার স্যর নারলিকারের উদারতায়। খুব কাছের ছাত্র হয়েও আমি নারলিকারের তত্ত্বের (স্টেডি স্টেট থিয়োরি) পাল্টা তত্ত্ব নিয়ে গবেষণা চালাচ্ছি আর তাতে আমাকে উৎসাহ জুগিয়ে যাচ্ছেন নারলিকারই, সেটা শুনে অবাক হয়ে গিয়েছিলেন পিবল্‌স।

দুই ‘মহাসাগর’কেই আমি দেখেছি খুব কাছ থেকে। দীূর্ঘ দিন ধরে। দেখে চলেছি। পিবল্‌স ও নারলিকার। যাঁরা একে অন্যে তো ঘনিষ্ঠ ভাবে চেনেনই, বন্ধুও। এক জন তাঁর পাল্টা তত্ত্ব নিয়ে গবেষণার জন্য অবিরাম উৎসাহ জুগিয়ে যান তাঁরই ছাত্রকে। অন্য জন নিজের মডেলের ফাঁকফোকর খুঁজে বের করার জন্য অন্যদের উৎসাহ যোগান। পরামর্শ দেন। বলেন, ‘‘ফাঁক-টাক খুঁজে দেখো, আমিও খুঁজে বেড়াচ্ছি।’’

লেখক পুণের ‘ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট ফর সায়েন্স এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চে’র চেয়ার প্রফেসর, 'লাইগো ইন্ডিয়া' প্রকল্পের মুখপাত্র|
ছবি, ডায়াগ্রাম ও ভিডিয়ো সৌজন্যে: অধ্যাপক তরুণ সৌরদীপ

গ্রাফিক: তিয়াসা দাস

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy