Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Science News

সকালে গাছের ঘুম ভাঙে কখন কী ভাবে, এই প্রথম দেখল নাসার ‘ইকোস্ট্রেস’

মহাকাশ থেকে নাসার ‘ইকোস্ট্রেস’ নজর রেখেছিল আমেরিকা ও কানাডার সীমান্তে একটি সুবিশাল হ্রদ ‘লেক সুপিরিয়র’ আর তার লাগোয়া এলাকায়।

গ্রাফিক: তিয়াসা দাস।

গ্রাফিক: তিয়াসা দাস।

সুজয় চক্রবর্তী
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ১১:৪১
Share: Save:

সারাটা রাত ঝিমিয়ে থাকার পর ভোরের আলো ফুটলে কোথায় দিনের কোন সময় কী ভাবে ঘুম ভাঙে গাছেদের, শুরু করে বেঁচে থাকার লড়াই, রান্নাবান্নার তোড়জোড়, মহাকাশ থেকে এই প্রথম তা দেখল আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে থাকা নাসার ‘ইকোস্ট্রেস’।

দেখল, আমাদের মতো গাছেরাও কেউ কেউ ‘আর্লি রাইজার’। কেউ বা ‘লেটলতিফ’, জীবনসংগ্রামে। ইকোস্ট্রেস এও দেখল, সকালে তারা আগে জেগে উঠবে নাকি পরে, গাছেদের সেই অভ্যাসটা নির্ভর করে তারা কোন এলাকার বাসিন্দা, তার উপর। কোনও একটি এলাকায় গাছেরা সকলেই আর্লি রাইজার। আবার কোনও কোনও এলাকায় তুলনায় দেরিতে ঘুম ভাঙে গাছেদের। আমাদের যা আগে জানা ছিল না। গাছেরও যে প্রাণ আছে, আজ থেকে একশো বছরেরও আগে তা প্রথম পরীক্ষা করে দেখিয়েছিলেন এক বঙ্গসন্তান। আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু।

এর ফলে, বিভিন্ন ধরনের বীজ রোপনের সময় কৃষকদের অনেক আগেভাগে বলে দেওয়া যাবে সেই এলাকার গাছেরা কতটা জল চাইছে। কতটা বিশ্রাম চাইছে গাছেরা। চাইছে কতটা সূর্যের আলো আর কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাস। যার প্রেক্ষিতে ফসল উৎপাদনের পরিমাণ অনেক আগেই হিসাব কষে বলে দেওয়া যাবে। বলে দেওয়া যাবে ফসলের গুণমানও। তাতে লাভবান হবেন কৃষকরাও।

ইকোস্ট্রেস কী কী দেখেছে?

যার চোখে ধরা পড়েছে গাছেদের ঘুম-রহস্য, তার পুরো নাম- ‘ইকোসিস্টেম স্পেসবোর্ন থার্মাল রেডিওমিটার অন স্পেস স্টেশন (ইকোস্ট্রেস)’। নাসা যাকে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে পাঠিয়েছিল ২০১৮-র জুনে। মহাকাশ থেকে ইকোস্ট্রেস নজর রেখেছিল আমেরিকা ও কানাডার সীমান্তে একটি সুবিশাল হ্রদ ‘লেক সুপিরিয়র’ আর তার লাগোয়া এলাকায়।

ইকোস্ট্রেস দেখেছে, লেক সুপিরিয়র আর তার গা ঘেঁষা এলাকাগুলির গাছেদের ঘুম ভাঙে সবার আগে। সকাল ৭টায়। শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা সব ঋতুতেই। নিয়মিত। কোনও দিন কোনও পরিস্থিতিতেই গাছেদের সেই রুটিন বদলায় না। লেক সুপিরিয়র থেকে একটু দূরে থাকা গাছেরা সকালে ঘুম থেকে ওঠে ৮টায়। আর তার চেয়েও দূরে থাকা গাছেদের ঘুম ভাঙে সকাল ৯টায়।

‘আনন্দবাজার ডিজিটাল’কে বুধবার এই খবর দিয়েছেন পাসাডেনায় নাসার জেট প্রোপালসান ল্যাবরেটরির ‘ইকোস্ট্রেস মিশনে’র অন্যতম সদস্য অনাবাসী ভারতীয় উদ্ভিদবিজ্ঞানী অশোক দেবনাথ।

দেখা গিয়েছে, কাছেপিঠে হ্রদ বা জলাশয় থাকলে সকালে তাড়াতাড়ি ঘুম ভেঙে জেগে উঠতে চায় গাছ। নেমে পড়তে চায় বেঁচে থাকার জরুরি লড়াইয়ে। শুরু করে দেয় রান্নাবান্নার তোড়জোড়। জলাশয় ততটা কাছেপিঠে না থাকলে সকালে তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে জেগে উঠতে আগ্রহ দেখা যায় না গাছেদের মধ্যে।

গাছের ভিতরেই থাকে সেই অ্যালার্ম ক্লক!

তবে রাতে আমরা যেমন অনেকেই নাক ডাকিয়ে ঘুমোই, গাছেরা কিন্তু সেই ভাবে ঘুমোয় না। বলা যেতে পারে, রাতে গাছ ঝিমোয়। অনেকটা আমাদের তন্দ্রাচ্ছন্ন ভাব!

যদিও আমার, আপনার শরীরের ভিতরে যেমন একটা ঘড়ি রয়েছে, ঠিক তেমনই একটা ঘড়ি রয়েছে গাছেরও। যাকে বলা হয়, ‘প্ল্যান্ট সারকাডিয়ান রিদম্‌স’। বা উদ্ভিদের দেহের অভ্যন্তরীণ ঘড়ি। যা আদতে একটি কম্পন। তৈরি হয় গাছের ভিতরেই। সেই ঘড়িই গাছকে জানিয়ে দেয়, আশপাশে এখন কোন ঋতু। জানিয়ে দেয়, শাখায় শাখায় ফুল ফোটানো বা ফল ধরানোর সময় এসে গিয়েছে।

আরও পড়ুন- কলকাতার শীত এ বার নোবেলবর্ষী, শহরের লাভ হল কি!​

আরও পড়ুন- বিশ্বকে ঘিরে ফেলেছে অস্ট্রেলিয়ার দাবানলের ধোঁয়া, তীব্র আশঙ্কায় ভারতও​

ঋতু বদলালে, ফুল ফোটানো, মুকুল ধরানোর সময় এলে সেই ঘড়িই হয়ে ওঠে গাছেদের ‘অ্যালার্ম ক্লক’। কাউকে বলে দিতে হয় না, সেই ঘড়ি আপনাআপনিই বেজে উঠে গাছদের বলে দেয়, ‘জেগে ওঠো এ বার। সময় হয়ে গিয়েছে।’ ঘড়িটা যে বেজে উঠেছে, তা বোঝা যায়, ফুল সৌরভ ছড়াতে শুরু করলে, গাছের পাতাগুলি চঞ্চল, চকচকে হয়ে উঠলে। শাখায় শাখায় মুকুল এলে। ফুল ফুটতে শুরু করলে, গাছে ফল ধরলে।

সারকাডিয়ান রিদম্‌সই গাছেদের জানিয়ে দেয়, বেলা পড়ে আসছে বা সন্ধ্যা নেমে এল। জানায় রাত গাঢ় থেকে গাঢ়তর হচ্ছে। বা ভোর হয়ে আসছে অথবা সকাল হয়ে গেল যে!

মহাকাশ থেকে কেন গাছের উপর নজরদারি? দেখুন নাসার ভিডিয়ো

আমাদের অনেকের মতোই গাছও রাতে কিছুটা ঝিমিয়ে পড়ে। অলস হয়ে পড়ে! যেন নেশাগ্রস্ত বা তন্দ্রাচ্ছন্ন!

অশোকের বক্তব্য, ‘সকাল হয়ে গেছে’ বলে যেই না গাছের ভিতরে থাকা সারকাডিয়ান রিদম্‌সের অ্যালার্ম ঘড়িটা বেজে ওঠে, সঙ্গে সঙ্গে তড়াক করে জেগে ওঠে গাছ। খেয়াল ফিরে আসে, আর ঝিমিয়ে থাকলে চলবে না। টিকে থাকার জন্য এ বার জীবনসংগ্রাম শুরু করতে হবে। লড়াই করতে হবে। জল জোগাড় করতে হবে মাটির নীচ থেকে। সূর্যের আলো টানতে হবে। আশপাশের পরিবেশ থেকে টেনে আনতে হবে কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাস। আর সেই সব দিয়ে শুরু করতে হবে রান্নাবান্নার তোড়জোড়। সেই রান্নার জ্বালানি হয় সূর্যের আলো থেকে নেওয়া শক্তি। সৌরশক্তি।

রান্নাবান্না ও গাছের ঘাম!

গাছের রান্নাবান্নাকে বিজ্ঞানের পরিভাষায় বলা হয়, সালোকসংশ্লেষ বা ‘ফোটোসিন্থেসিস’। গাছ সেই প্রক্রিয়ায় সৌরশক্তিকে ব্যবহার করে জল আর কার্বন ডাই-অক্সাইডকে ভেঙে তৈরি করে গ্লুকোজ আর অক্সিজেন। গ্লুকোজ গাছের আনাজপাতি, শাকসব্জি। যা বদল গিয়ে তৈরি হয় ‘অ্যাডিনোসিন ট্রাই ফসফেট (এটিপি)’। গাছের খাবার। তার টিকে থাকার যাবতীয় শক্তি। সঙ্গে তৈরি হয় অক্সিজেনও। সেটা বর্জ্য। লাগে না বলে গাছ সকালে সেটা পরিবেশে ছেড়ে দেয়।

সেই রান্নাবান্নার সময় জলের পরিমাণ বেশি হয়ে গেলেও মুশকিল হয় গাছেদের। তখন তারা ‘ঘামতে’ শুরু করে। আর সেই ভাবেই শরীর থেকে বাড়তি জল বের করে দেয় গাছেরা। পাতায় থাকা অসংখ্য ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ছিদ্র দিয়ে। ঘামলেই শরীর জুড়িয়ে আসে গাছেদের। কিছুটা আরাম হয়! বিজ্ঞানের পরিভাষায় এই প্রক্রিয়াকে বলা হয়, ‘এভাপোট্রান্সপিরেশন’।

মহাকাশ থেকে নজরদারির কী কী সুবিধা পেয়েছে ইকোস্ট্রেস?

অশোক জানাচ্ছেন, মহাকাশ থেকে গাছেদের পর্যবেক্ষণের জন্য আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন খুব সাহায্য করেছে, করে চলেছে ইকোস্ট্রেসকে। কারণ, সারা দিনে বেশ কয়েক বার পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন। তাই তারই মধ্যে থাকা ইকোস্ট্রেস পৃথিবীর একই এলাকার উপর সারা দিন ধরে নজর রাখার সুযোগ পায়। ফলে, ইকোস্ট্রেসের পাঠানো তথ্যাদি বিশ্লেষণ করে দিনভর রাতভর গাছেদের আচার, আচরণ বোঝার কাজটা অনেক সহজ হয়ে গিয়েছে উদ্ভিদবিজ্ঞানীদের। সেই তথ্যাদি থেকেই বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, লেক সুপিরিয়রের লাগোয়া এলাকার গাছেরা অনেক সকালে জেগে ওঠে। স্থানীয় সময় সকাল ৭টায়। কিন্তু লেক সুপিরিয়র থেকে দূরে যত উত্তর-পশ্চিম দিকে এগনো যায়, ততই সেই সব এলাকার গাছেদের ঘুম সকালে ভাঙে কিছুটা দেরিতে। অন্তত এক বা দু’ঘণ্টা পর।

ছবি, গ্রাফিক-তথ্য ও ভিডিয়ো সৌজন্যে: নাসা

গ্রাফিক: তিয়াসা দাস

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy