টিকাকরণ প্রক্রিয়া এখনই শুরু না করতে পারলে বিপদ আরও বাড়বে। ছবি- পিটিআই।
অতিমারির পর কি এ বার একের পর এক মহামারি ফিরে আসছে ভারত-সহ প্রায় গোটা বিশ্বেই? ফিরে আসতে চলেছে পোলিও, হাম, রুবেলা, কলেরা, ডিপথেরিয়া ও ডায়ারিয়ার মতো ভয়ঙ্কর সংক্রামক ব্যাধিগুলি?
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (‘হু’), রাষ্ট্রপুঞ্জের অধীনস্থ ‘ইউনিসেফ’ এবং গরিব দেশগুলিতে টিকাকরণ কর্মসূচির তদারক সংস্থা ‘গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ভ্যাকসিন্স অ্যান্ড ইমিউনাইজেশন (গ্যাভি)’-এর সাম্প্রতিক যৌথ সমীক্ষা এই অশনি সংকেত দিয়েছে। জানিয়েছে, বিশ্ব জুড়ে করোনা সংক্রমণ ও লকডাউনের জেরে টিকাকরণ কর্মসূচি দারুণ ভাবে ব্যাহত হওয়ার ফলে যে সব রোগ হারিয়ে গিয়েছিল, তাদের ফের জোরালো ভাবে ফিরে আসার উপক্রম হয়েছে। বিপন্ন হয়ে পড়েছে অন্তত ৮ কোটি শিশুর জীবন। এশিয়ার যে দেশগুলিতে এই আশঙ্কা বেশি, ভারত তার অন্যতম। রয়েছে পাকিস্তান, নেপাল, বাংলাদেশও। একই আশঙ্কা আফ্রিকায় উগান্ডা, নাইজিরিয়া, চাদ, ইথিওপিয়া, বুরুন্ডি, ক্যামেরুন-সহ বিশ্বের ১২৯টি দরিদ্র ও অল্প আয়ের দেশের শিশুদের ক্ষেত্রে। যে শিশুদের বয়স ১ বছরেরও কম।
হাম, পোলিও, ডিপথেরিয়ার টিকাকরণে যথেষ্টই ব্যাঘাত ঘটেছে ভারতে
লকডাউনের জন্য দেশে দেশে টিকাকরণ কর্মসূচি পুরোপুরি থমকে যাওয়ায় অন্তত ৮ কোটি শিশুর পোলিও, হাম, রুবেলা, কলেরা, ডিপথেরিয়া, ডায়ারিয়া-সহ নানা ধরনের জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা প্রবল হয়ে উঠেছে।
‘ইন্টারন্যাশনাল পিডিয়াট্রিক অ্যাসোসিয়েশন (আইপিএ)’-এর কার্যনির্বাহী অধিকর্তা, শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ নবীন ঠাকার বলছেন, “ভারতের জাতীয় স্বাস্থ্য মিশনের তথ্যই জানাচ্ছে, ২০১৯-এর মার্চের তুলনায় এ বছরের মার্চে হাম, রুবেলা, মাম্পসের টিকাকরণের কাজ ৬৯ শতাংশ কম হয়েছে।’’
হামের টিকা বন্ধ ভারত-সহ ২৭টি দেশে
হু এবং ইউনিসেফ-এর যৌথ সমীক্ষার বক্তব্য, ১২৯টি গরিব ও অল্পবিত্তের দেশের মধ্যে কম করে ৬৮টি দেশে চিকিৎসক বা টিকাকরণ কর্মসূচির মাধ্যমে টিকা দেওয়ার কাজে যথেষ্টই ব্যাঘাত ঘটেছে করোনা সংক্রমণ ও লকডাউনের জেরে।
যাতে হাম না হয়, সে জন্য এক বছরের কমবয়সিদের সার্বিক ভাবে টিকা দেওয়ার কাজ এই সময়ে পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গিয়েছে ২৭টি দেশে। যাদের মধ্যে অন্যতম আফ্রিকার দু’টি দেশ- চাদ ও ইথিওপিয়া।
'বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন'-এর ভ্যাকসিন ডেলিভারি প্রোগ্রামের ডেপুটি ডিরেক্টর রাজ শঙ্কর ঘোষ জানাচ্ছেন, এ ক্ষেত্রে উদ্বেগের কারণ রয়েছে যথেষ্ট। কারণ, দু'বছর আগে টিকাকরণের হার কম হওয়ার ফলে কেরলে ও আরও কিছু রাজ্যে ডিপথেরিয়ার প্রাদুর্ভাব হয়েছিল। এই লকডাউন ঘোষণার পর তো টানা দুই/আড়াই মাস ধরে সারা দেশে টিকাকরণ কর্মসূচি অনেকাংশে বন্ধ হয়ে যায়। তাই টিকার মাধ্য়মে ভারতে যে রোগগুলি নির্মূল করার লক্ষ্যে কিছুটা পদক্ষেপ হয়েছিল, দীর্ঘ দিনের লকডাউনে সেগুলির ফিরে আসার আশঙ্কা আরও প্রবল হয়ে উঠেছে।
রাজ শঙ্করের কথায়, "সঠিক পরিসংখ্যান হাতে না আসলেও বলতে পারি, যথেষ্ট টিকাকরণ হয়নি এই সময়ে। হলেও সেই সব টিকাকরণের কোনও সরকারি তথ্য আমাদের কাছে পৌঁছয়নি। স্বাস্থ্যকর্মী এখন কোভিড রোগীর চিকিৎসায় বেশি ব্যস্ত হয়ে উঠেছেন বলেও সেটা হতে পারে। তবে জন্মের কয়েক দিন বা কয়েক সপ্তাহ পর টিকা দেওয়ানোর জন্য মা, বাবা, অভিভাবকরা যে হাসপাতাল বা স্বাস্থ্য়কেন্দ্রগুলিতে যেতে পারেননি, তা এক রকম নিশ্চিত। সেই টিকা দেওয়ানো হলে যে নথিভুক্তিকরণ হয়, সেটাও এই সময় অনেকটাই কমে গিয়েছে।"
অতিমারির চেয়েও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠবে ওই সব মহামারি!
আর সদ্যোজাতদের পোলিও খাওয়ানোর কাজ বন্ধ হয়ে গিয়েছে ৩৮টি দেশে। যাদের মধ্যে রয়েছে পাকিস্তান ও গণতান্ত্রিক কঙ্গো প্রজাতন্ত্রের মতো দেশগুলি।
বিজ্ঞানী ও টিকা বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, এর ফলে, আগামী দিনে হাম, রুবেলা, কলেরা, ডায়ারিয়া ও ডিপথেরিয়ার মতো বিভিন্ন সংক্রামক রোগে আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা কোভিড-১৯ ভাইরাসের দৌলতে আক্রান্তের সংখ্যাকেও হার মানাবে।
সংক্রামক রোগগুলির মধ্যে প্রথমেই যে নামটি আসে, তা হল, পোলিও। কোটি কোটি শিশুকে টিকাকরণ কর্মসূচির আওতায় আনার ফলে ৭ বছর আগে পোলিও রোগটি ভারত থেকে এক রকম নির্মূলই হয়ে গিয়েছিল। লাগাতার টিকাকরণ কর্মসূচির দৌলতে ২০১৮ এবং ২০১৯-এ ভারতে দ্রুত কমেছিল হাম, রুবেলায় আক্রান্তের সংখ্যাও।
আরও পড়ুন- কোনও অদৃশ্য শক্তি আছে কি ব্রহ্মাণ্ডে? নোবেলজয়ীদের তত্ত্বকে চ্যালেঞ্জ অক্সফোর্ডের বাঙালির
আরও পড়ুন- ফের মিলল বাঙালির পূর্বাভাস, লকডাউনেও সৌরমণ্ডলে ঢুকল ভিন্ মুলুকের ‘রাজহাঁস’
লাভের গুড়ও পিঁপড়েয় খাবে!
'ওয়েস্ট বেঙ্গল অ্যাকাডেমি অফ পিডিয়াট্রিক্স'-এর প্রাক্তন সভাপতি, শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ অরুণ মাঙ্গলিক জানাচ্ছেন, ভারতে প্রতি মাসে গড়ে ২১/২২ লক্ষ শিশুর জন্ম হয়। সেই হিসাবে ১ ফেব্রুয়ারি থেকে এখনও পর্যন্ত ৮০/৮৫ লক্ষ শিশুর জন্ম হয়েছে। করোনা সংক্রমণ ও লকডাউনের জন্য দূরত্ব-বিধি অন্যান্য বিধিনিষেধ মেনে চলতে গিয়ে গোটা বিশ্বের সঙ্গে এ দেশেও টিকাকরণ কর্মসূচি পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এই সদ্যোজাতদের টিকা দেওয়ার কাজ দারুণ ভাবে ব্যাহত হয়েছে।
জন্মের পর ও তার দেড় মাস, আড়াই বা তিন মাস, ছ’মাস, ন’মাস এবং ১৫ মাসে খুব গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি টিকা দিতে হয় শিশুদের। যা ওই সংক্রামক রোগগুলি নির্মূল করার জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। কিন্তু টিকাকরণ কর্মসূচি দীর্ঘ সময় ধরে বন্ধ থাকা আর কবে তা স্বাভাবিক হবে, তা নিয়ে তীব্র অনিশ্চয়তার দরুন নানা ধরনের সংক্রামক রোগে শিশুদের আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা উত্তরোত্তর জোরালো হচ্ছে। শুধু তাই নয়, ৯ মাস আর ১৫ মাসে শিশুদের যে ‘এমআর’ অথবা ‘এমএমআর’ টিকা দেওয়া হয়, লকডাউনের জন্য যদি তা না দেওয়া হয়, তা হলে এত দিনের টিকাকরণের লাভের গুড়ও পিঁপড়েয় খেয়ে যাবে!
হাম, পোলিও ফিরে আসার আশঙ্কা প্রবল: 'গ্যাভি'
পরিস্থিতির গুরুত্ব কতটা, জানতে ‘আনন্দবাজার ডিজিটাল’-এর তরফে যোগাযোগ করা হয়েছিল বিল গেটস ও তাঁর স্ত্রীর মেলিন্দা গেটসের হাতে গড়া সংস্থা ‘গ্যাভি’-র চিফ এগজিকিউটিভ অফিসার সেথ বার্কলের সঙ্গে। ওয়াশিংটন থেকে বার্কলে ই-মেলে লিখেছেন, “অতিমারি শুরু হওয়ার আগে টিকাকরণ কর্মসূচি ব্যাপক ভাবে কার্যকর হওয়ায় উন্নয়নশীল দেশগুলিতে পোলিও, হাম-সহ বহু রোগ নির্মূল করার লক্ষ্যে অনেক দূর পর্যন্ত এগনো সম্ভব হয়েছিল। আগের চেয়ে অনেক বেশি শিশু ও অনেক বেশি দেশে টিকাকরণ কর্মসূচিকে কার্যকর করা সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু অতিমারি আর তা রুখতে বিশ্ব জুড়ে লকডাউন শুরু হওয়ার পর সার্বিক ভাবে টিকা দেওয়ার কাজ দারুণ ভাবে ব্যাহত হয়েছে। হয়ে চলেছে। তাই পোলিও ও হামের মতো বহু রোগের আবার ফিরে আসার আশঙ্কা জোরালো হয়ে উঠেছে। সেটা উত্তরোত্তর জোরালো হয়ে উঠছেও।’’
যদিও লকডাউনের মধ্যেই বন্ধ হয়ে থাকা এই টিকাকরণ কর্মসূচিকে ফের ধাপে ধাপে কার্যকর করার লক্ষ্যে এখনই এগনো উচিত বলে মনে করছেন টিকা বিশেষজ্ঞরা।
অরুণ ও নবীনের কথায়, “টিকাকরণের কাজ ঠিক মতো শুরু হলে শুধুই যে জীবন সংশয়কারী বিভিন্ন রোগের হামলা থেকে শিশুদের বাঁচানো যাবে, তা নয়; কোভিড-১৯-এর টিকাকে বিশ্বের সর্বত্র ছড়িয়ে দিতেও তা সহায়ক হবে।’’
হাম, রুবেলা, পোলিওর ক্ষয়-খতিয়ান
হু, ইউনিসেফ-এর সমীক্ষা রিপোর্ট জানাচ্ছে, গত বছর ভারত-সহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় হু-র সদস্য ১১টি দেশে হামে আক্রান্তের ঘটনার সংখ্যা মোট যত ছিল (১৯ হাজার ৭২৬টি), এ বছরের প্রথম ৪ মাসেই সেই সংখ্যাটা তার সাড়ে তিন ভাগের এক ভাগ হয়েছে।
নবীন ও অরুণ বলছেন, “বছরের আরও ৮ মাস বাকি। করোনার জেরে প্রায় বছরের শুরু থেকেই ভারতে বন্ধ হয়েছে বা ব্যাঘাত ঘটেছে টিকাকরণ কর্মসূচিতে। একই ঘটনা ঘটেছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় হু-র সদস্য আরও ১০টি দেশে। ফলে, এ বার ভারত-সহ ওই ১১টি দেশে হামে আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা বাড়ার আশঙ্কা জোরালো হয়েছে।’’
সমীক্ষা রিপোর্ট এও জানাচ্ছে, গত বছর ওই ১১টি দেশে রুবেলায় আক্রান্ত হওয়ার যতগুলি ঘটনা জানা গিয়েছিল (৪ হাজার ৩৬৩টি), এ বছরের প্রথম ৪ মাসে সেই সংখ্যাটা দৃশ্যত কম (৫১১টি) হলেও জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি ও মার্চে ঘটনার সংখ্যা পৌঁছেছে ৫০৯টিতে।
‘ইন্ডিয়ান অ্যাকাডেমি অফ পিডিয়াট্রিক্স (আইএপি)’-এর সংক্রামক ব্যাধি বিভাগের চেয়ারপার্সন, কলকাতার শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ জয়দীপ চৌধুরীর কথায়, “রুবেলায় আক্রান্ত হন গর্ভবতীরা। তার ফলে, তাঁরা বিকলাঙ্গ শিশুর জন্ম দেন। তাই সঠিক সময়ে রুবেলার টিকা দেওয়া খুব জরুরি। এত দিনের টিকাকরণের পরেও ভারতে রুবেলা নির্মূল করা সম্ভব হয়নি। রোগটিকে নির্মূল করার জন্য দেশের অন্তত ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ শিশুকে রুবেলার টিকা দেওয়ার প্রয়োজন। অথচ, এ বছরে ইতিমধ্যেই প্রায় ৬ মাস ব্যাঘাত ঘটেছে রুবেলার টিকাকরণের কাজে। কত দিনের মধ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে, তা নিয়েও এখনও যথেষ্টই অনিশ্চয়তা রয়েছে। তাই রুবেলা নিয়ে উদ্বেগের কারণ রয়েছে যথেষ্টই।’’
হু এবং ইউনিসেফ-এর যৌথ রিপোর্ট বলছে, এক বছরে প্রতি ১০ লক্ষ জনসংখ্যায় হামে আক্রান্ত হওয়ার ঘটনায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের তালিকায় ভারত রয়েছে ৮ নম্বরে। ঘটনার সংখ্যা ৮ হাজার ১৬৯। তালিকায় শীর্ষে রয়েছে মাদাগাস্কার। সে দেশে হামে আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা ৩৫ হাজার ৬৪৫টি। দ্বিতীয় স্থানে ইউক্রেন। তার পর ব্রাজিল, গণপ্রজাতন্ত্রী কঙ্গো, ফিলিপিন্স, নাইজিরিয়া ও কাজাখস্তানের পরেই রয়েছে ভারত। ভারতের পরেই রয়েছে বাংলাদেশ। ঘটনার সংখ্যায় কম হলেও হারের নিরিখে ভারতের প্রায় সাড়ে ৭ গুণ।
আর ৬ মাসে প্রতি ১০ লক্ষ জনসংখ্যায় হামে আক্রান্ত হওয়ার ঘটনায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের তালিকায় ভারত রয়েছে ২ নম্বরে। যে সব সংক্রামক রোগের টিকা বাজারে চালু রয়েছে, ভারতে তাদের মধ্যে হামেই আক্রান্ত হওয়া ও মৃত্যুর ঘটনা ঘটে সবচেয়ে বেশি।
২০১৪ সালে ভারতে হামে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৭৫ হাজার ৮১৩। ব্যাপক ভাবে টিকা দেওয়ার ফলে চার বছরের মধ্যে ২০১৮-য় সেই সংখ্যা কমে গিয়ে হয় ১৭ হাজার ১৫৬। অর্থাৎ, ২০১৪ সালে সংখ্যাটা ছিল প্রায় সাড়ে চার গুণ। গত বছর সেই সংখ্যা আরও কমে হয় ১১ হাজার। আর এ বছরের মার্চ পর্যন্ত (প্রথম ত্রৈমাসিক) ভারতে হামে আক্রান্ত হয়েছেন ২ হাজার ৪৬০ জন।
অরুণ বলছেন, “এই সাফল্য সম্ভব হয়েছে টিকাকরণ কর্মসূচির ব্যাপক রূপায়ণের ফলে। কিন্তু হামকে নির্মূল করার বিষয়টি সুনিশ্চিত করার জন্য হু ৯৫ শতাংশ শিশুকে টিকা দিতে বলেছে। সেই লক্ষ্য থেকে আমরা অনেকটাই দূরে রয়েছি। লকডাউনের পর টিকা দেওয়ার কাজ পুরোদস্তুর শুরু না হলে আমরা এই লড়াইয়ে আরও পিছিয়ে পড়ব। লক্ষ্য থেকে আরও দূরে চলে যাব।’’
রুবেলায় আক্রান্ত হওয়ার ঘটনায় অনেক দেশকেই পিছনে ফেলে দিয়েছে ভারত। তালিকায় চিনের পরেই রয়েছে দ্বিতীয় স্থানে। এক বছরে প্রতি ১০ লক্ষ জনসংখ্যায় রুবেলায় আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা ভারতে ঘটেছে ১ হাজার ৯৮৯টি। চিনে সংখ্যাটা ২৮ হাজার ৭৩৬। রয়েছে বাংলাদেশ, তাইল্যান্ড, মলদ্বীপ, নেপাল ও মায়ানমারও।
জয়দীপ ও অরুণ জানাচ্ছেন, শিশুদের জন্মের ৯ এবং ১৫ মাস পর যে এমআর অথবা এমএমআর টিকা দেওয়া হয়, লকডাউনের জেরে সেই কাজেও দারুণ ভাবে ব্যাঘাত ঘটেছে। তার ফলে, এই দু’টি টিকা দেওয়ায় আগে যে সুফল মিলেছিল, সেটাও আমরা কাজে লাগাতে পারব না। শিশুমৃত্যুর আরও একটি বড় কারণ হয়ে দাঁড়ায় পার্টুসিস রোগ। ২০১৫ সালে এই রোগে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৩১ হাজার ৪৮২। এই রোগ দূর করতে শিশুদের জন্মের পর ষষ্ঠ ও দশম সপ্তাহে টিকা দিতে হয়। এটা বাধ্যতামূলক।
“কিন্তু হাসপাতালে তো অত দিন শিশু ও তার মাকে রাখা সম্ভব নয়। সে ক্ষেত্রে শিশুকে ওই দু’টি টিকা দেওয়ানোর জন্য হাসপাতাল বা চিকিৎসকের চেম্বারে নিয়ে যেতে হয় মা, বাবা অথবা অভিভাবকদের। লকডাউনে যানবাহন বন্ধ থাকায় সেটা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সম্ভব হয়নি। ফলে, এই রোগে সদ্যোজাতদের আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা যে অনেক গুণ বেড়ে গিয়েছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না’’, বলছেন অরুণ।
কোভিড-১৯ ভাইরাসে আক্রান্তদের চিকিৎসা ও সেবায় রয়েছেন যাঁরা, অতিমারির পর সংক্রামক রোগগুলির জন্য একের পর এক মহামারি শুরু হলে, তাঁরা আরও বিপন্ন হয়ে পড়বেন। যে সব পাড়া ও এলাকায় কোভিড-১৯ ভাইরাসে আক্রান্ত ও মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে, সেখানকার অন্য বাসিন্দাদের বিপদ যে আরও বাড়বে, তা নিয়ে অন্তত কোনও সন্দেহ নেই, জানাচ্ছেন জয়দীপ।
একটা দৃষ্টান্ত দেওয়া যাক। ভয়ঙ্কর ইবোলা ভাইরাস যে দেশে সবচেয়ে বেশি সংক্রামক হয়ে উঠেছিল, আফ্রিকার সেই দেশ গণপ্রজাতন্ত্রী কঙ্গোয় গত বছর হামে মৃতের সংখ্যা ছিল ৬ হাজারেরও বেশি।
ভারতে কতটা ক্ষতি হল শিশুদের?
বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশনের ভ্যাকসিন প্রোগ্রামের ডেপুটি ডিরেক্টর রাজ শঙ্কর ঘোষ জানাচ্ছেন, সেটা বুঝে ওঠার জন্য একটা সারভেইল্যান্স ব্যবস্থা রয়েছে। ১৯৯৭ সালে ভারতে যেটা প্রথম চালু করেছিল হু। পোলিও ভাইরাস সংক্রমণ বোঝার জন্যে। সেই ব্যবস্থার মাধ্যমে আর দিনকয়েকের মধ্যেই জানা যাবে লকডাউনের জন্য দেশজুড়ে টিকাকরণ কর্মসূচি দারুণ ভাবে ব্যাহত হওয়ায় ভারতে কত শিশু ক্ষতিগ্রস্ত হল। কোন কোন সংক্রামক ব্যাধি ফিরে আসার আশঙ্কা জোরালো হয়ে উঠল।
তাঁর কথায়, "ক্ষয়ক্ষতি বোঝার এটাই সবচেয়ে ভাল উপায়। তবে টীকাকরণ কর্মসূচী যে এই লকডাঊন বেশ পিছিয়ে গিয়েছে, তা নিয়ে আমার কোনও সংশয় নেই।"
এখন কী করতে হবে?
‘আনন্দবাজার ডিজিটাল’-এর তরফে প্রশ্নমালা পাঠানো হয়েছিল হু-র টিকা উদ্ভাবন ও টিকাকরণ কর্মসূচি বিভাগে। জবাবে হু-র ইমিউনাইজেশন, ভ্যাকসিন্স অ্যান্ড বায়োলজিক্যাল প্রোগ্রাম বিভাগের অধিকর্তা ক্যাথরিন ও’ব্রায়েন লিখেছেন, “কোভিড-১৯-এর টিকার উদ্ভাবন ও যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাকে বাজারে আনার জন্য বিজ্ঞানী ও সহযোগী সবক’টি সংস্থা, সংগঠনের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে হু। তবে তার আগে যেটা প্রয়োজন, তা হল, যে সব রোগের টিকা চালু রয়েছে, সেগুলি যাতে নিয়মিত ভাবে দেওয়া হয় বিশ্ববাসীকে ওই রোগগুলির হাত থেকে বাঁচাতে। আমরা আসলে খুব স্পষ্ট ভাবেই এই বার্তা দিতে চাইছি সবক’টি দেশকে। যত তাড়াতাড়ি ও যে ভাবে সম্ভব টিকাকরণ কর্মসূচি ফের শুরু করা আর তার গতি বাড়ানোর জন্য যা যা করণীয়, জরুরি ভিত্তিতে এখন সেই সবই করা উচিত দেশগুলির। যাতে ওই সব সংক্রামক রোগ না ফিরে আসতে পারে। তাতে বিশ্বের বিপদ যে আরও অনেক গুণ বেড়ে যাবে, তা নিয়ে কোনও সংশয় নেই।’’
সেটা কী ভাবে করা সম্ভব?
জয়দীপ ও নবীন জানাচ্ছেন, এখনই টিকাকরণের ‘ক্যাচ-আপ প্রোগ্রাম’ শুরু করে দেওয়া উচিত। মানে, সংক্রমণ ও লকডাউনের জন্য যে সব শিশুকে জন্মের দেড়, আড়াই, তিন বা ছয় মাস পর টিকা দেওয়ানোর জন্য হাসপাতাল, স্থানীয় স্বাস্থ্যকেন্দ্র বা চিকিৎসকের চেম্বারে নিয়ে যেতে পারেননি মা, বাবা, অভিভাবকেরা, এ বার সেই শিশুরা যাতে হাসপাতালে গিয়ে সেই টিকাগুলি নিয়ে আসতে পারে তার আপৎকালীন ব্যবস্থা করতে হবে। সে ক্ষেত্রে হাসপাতাল, স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যাতে ভিড় না হয় এবং দূরত্ববিধি মেনে শিশুদের টিকা দেওয়ানোর কাজ শুরু করা যায়, সে জন্য অভিনব ব্যবস্থা নিতে হবে।
জয়দীপের কথায়, “এমন ব্যবস্থা চালু করা যেতে পারে যাতে হাসপাতালে সকাল ১০টা থেকে ১টা পর্যন্ত টিকা দেওয়া হবে সেই শিশুদের, যাদের দেড়, আড়াই, তিন মাসের টিকা দেওয়া হয়নি লকডাউনের সময়। আর যে শিশুদের ৬ বা ৯ মাসের টিকা দেওয়ার কথা, তাদের টিকাকরণের কাজ বেলা ৩টা থেকে হতে পারে হাসপাতালে। প্রয়োজনে চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের আরও বেশি সময় দিতে হবে হাসপাতালে টিকাকরণের বকেয়া কাজ দ্রুত শুরু করা আর তা যতটা সম্ভব করে ফেলা যায়, তার জন্য।’’
নবীন ও জয়দীপ জানাচ্ছেন, এলাকায় এলাকায় ক্যাম্প করেও এই ক্যাচ আপ প্রোগ্রাম শুরু করা যায়। করা যায় বিভিন্ন স্কুলে, যেহেতু অচিরেই স্কুলগুলি খুলে যাওয়ার ইঙ্গিত মিলেছে সরকারের তরফে।
আরও পড়ুন- নিজের ছোড়া ‘বাণ’ থেকে আমাদের বাঁচায় সূর্যই! দেখালেন মেদিনীপুরের সঞ্চিতা
আরও পড়ুন- সংক্রমণের পাঁচ মাস পরে করোনা নিয়ে কী কী জানলাম আমরা
কলকাতা, হাওড়ায় সমস্যা রয়েছে, মেটানোর প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে
“তবে এ ব্যাপারে কিছু সমস্যাও থাকছে বিভিন্ন এলাকার কন্টেনমেন্ট ও বাফার জোনগুলি নিয়ে। যে সব জেলা বা কলকাতা ও হাওড়ার মতো যে শহরগুলিতে কনটেনমেন্ট ও বাফার জোনের সংখ্যা ও পরিধি অনেক বেশি, সেখানে টিকাকরণের কাজ ব্যাহত হচ্ছে’’, বলছেন ইউনিসেফ-এর পশ্চিমবঙ্গ শাখার স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ কনীনিকা মিত্র।
‘আনন্দবাজার ডিজিটাল’কে তিনি এও জানিয়েছেন, কলকাতার মতো যে সব জেলায় কনটেনমেন্ট জোন রয়েছে প্রচুর পরিমাণে (কলকাতায় ২৮৮টি), সেখানে নিয়মিত ভাবে টিকাকরণের কাজ ব্যাহত হয়েছে। তবে রাজ্যের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ দফতর এ ব্যাপারে ওয়াকিবহাল। হু এবং আমাদের প্রতিনিধিদলের সঙ্গে মে মাসে দু’দফায় বৈঠকও হয়েছে রাজ্য সরকারের। দূরত্ব-বিধি মেনে, কোভিড-রোগী, চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের নিরাপত্তা অটুট রেখে কলকাতা ও হাওড়ার মতো শহরগুলিতে এই টিকাকরণ কর্মসূচিকে স্বাভাবিক করে তোলার প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গিয়েছে। তবে এপ্রিলে টিকাকরণ কর্মসূচিতে ছেদ ঘটায় কত শিশু বিপন্ন হয়েছে, এখনও সেই পরিসংখ্যান মেলেনি।
কনীনিকা জানাচ্ছেন, এই পরিস্থিতিতে যাতে দেশের সর্বত্র টিকাকরণ কর্মসূচি ফের চালু করা আর তাকে জরুরি ভিত্তিতে অগ্রাধিকার দিয়ে দ্রুত এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়, সে জন্য রাজ্যগুলির দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে ইউনিসেফ। মা, সদ্যোজাত ও আসন্নপ্রসবাদের যে যে টিকা দেওয়া জরুরি, সেগুলির ক্ষেত্রে যাতে কোনও ব্যাঘাত না ঘটে, ইউনিসেফ-এর তরফে সে ব্যাপারেও বিভিন্ন দেশকে জানানো হয়েছে।
অতিমারির পর একের পর এক মহামারি ঠেকানোর প্রস্তুতি এখনই শুরু হোক জোর কদমে, বলছেন বিশেষজ্ঞরা।
গ্রাফিক: তিয়াসা দাস।
গ্রাফিক-তথ্য: হু, ইউনিসেফ-এর রিপোর্ট, মে, ২০২০
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy