Advertisement
২৩ নভেম্বর ২০২৪
Science News

‘পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনা’ চাঁদ না থাকলে প্রাণই আসত না পৃথিবীতে!

এই সৌরমণ্ডলে যখন গ্রহগুলি তৈরি হচ্ছিল, সেই সময়েই জন্ম হয়েছিল তাদের উপগ্রহ বা চাঁদগুলির। গ্রহগুলির জন্মের পর পড়ে থাকা গ্যাস আর ধূলিকণা থেকে।

তুমি শশী হে...! -ফাইল ছবি।

তুমি শশী হে...! -ফাইল ছবি।

সুজন সেনগুপ্ত
বেঙ্গালুরু শেষ আপডেট: ১৪ জুলাই ২০১৯ ০৮:২৫
Share: Save:

কী খেয়াল ভাবুন প্রকৃতির! কাউকে তিনি দেন হাত ভরে। যা দেন, তার সৌন্দর্য দেখার জন্য কেউ নেই! আর কাউকে দেন ‘পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনা’ একটা কিছু। যেন ‘ফাউ’! যা দেখে আশ মেটে না কয়েকশো কোটি প্রাণীর।

তাঁর অজানা খেয়ালে প্রকৃতি আমাদের এই বাসযোগ্য গ্রহকে দিয়েছেন মাত্র একটি চাঁদ। অথচ, বৃহস্পতিকে দিয়েছেন ৬৭টি আর শনি গ্রহকে দিয়েছেন ৬২টি চাঁদ। আবার এই সৌরমণ্ডলের কোনও কোনও গ্রহকে একটিও চাঁদ দেননি তিনি। বুধ এবং শুক্র।

আমরা পেলাম ‘পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনা’ চাঁদ!

যখন পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনার মতো একটিই চাঁদ জুটল পৃথিবীর কপালে, তখন অন্তত চেহারায় তা একটু বড়সড় হতে পারত। কিন্তু সেখানেও ঠকে গিয়েছে পৃথিবী। এই সৌরমণ্ডলের সবচেয়ে বড় চাঁদটি আদতে বৃহস্পতির সম্পত্তি! ‘গ্যানিমিড’। এই সৌরমণ্ডলের চাঁদগুলির মধ্যে চেহারার বিচারে আমাদের চাঁদ রয়েছে পঞ্চম স্থানে।

বৃহস্পতির কয়েকটা চাঁদের নাম তো আমাদের মুখে মুখে ঘোরে। ‘গ্যানিমিড’, ‘ইউরোপা’, ‘ক্যালিস্টো’। শনির চাঁদ ‘টাইটান’-এর নামও অনেকেই জানেন।

আকারে কে কতটা দড়? চাঁদ নানা গ্রহে, নানা চেহারায়, নানা রূপে

এই সৌরমণ্ডলে যখন গ্রহগুলি তৈরি হচ্ছিল, সেই সময়েই জন্ম হয়েছিল তাদের উপগ্রহ বা চাঁদগুলির। গ্রহগুলির জন্মের পর পড়ে থাকা গ্যাস আর ধূলিকণা থেকে।

মঙ্গল চাঁদ পেল গ্রহাণু থেকে...

যেখানে যেতে আমাদের এত আগ্রহ, সেই ‘লাল গ্রহ’ মঙ্গলের উপগ্রহ বা চাঁদগুলি চেহারায় বড্ডই ছোট। তাদের নাম- ‘ডিমোস’ আর ‘ফোবস’। বিজ্ঞানীদের ধারণা, এরা আদতে দু’টি বড় গ্রহাণু বা অ্যাস্টারয়েড। মঙ্গলের অভিকর্ষ বলের টানেই তারা বাঁধা পড়েছে মঙ্গলের ‘মায়া’য়! হয়ে গিয়েছে মঙ্গলের দু’টি চাঁদ।

মঙ্গল আর বৃহস্পতির মধ্যেই রয়েছে ঝাঁক ঝাঁক গ্রহাণু। যে জায়গাটার নাম- গ্রহাণুপুঞ্জ বা ‘অ্যাস্টারয়েড বেল্ট’। তাই সেই মুলুক থেকে ছিটকে এসে মঙ্গলের অভিকর্ষ বলের টানে লাল গ্রহের চাঁদ হয়ে যেতেই পারে ‘ডিমোস’ আর ‘ফোবস’।

আমাদের চাঁদ এল কোথা থেকে?

জন্মলগ্ন বলতে যা বোঝায়, ঠিক সেই মুহূর্তে পৃথিবী ছিল একেবারেই একা। প্রচণ্ড গতিতে পৃথিবী তখন তার অক্ষের চার পাশে ঘুরত। এতই প্রচণ্ড ছিল তার গতি যে, ২৪ ঘণ্টার পরিবর্তে একটি দিন ও রাতের দৈর্ঘ্য ছিল সাকুল্যে ১০ ঘণ্টা বা তারও কম।

পৃথিবীর সেই শৈশবে তার বুকে আছড়ে পড়ত লক্ষ লক্ষ ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র গ্রহাণু। পৃথিবীর জন্মের সেই ভাবেই গড়িয়ে গেল প্রায় ৫০ কোটি বছর। ১৩৭০ কোটি বছর বয়সের ব্রহ্মাণ্ডের নিরিখে যা তেমন কিছুই নয়। সেই ৫০ কোটি বছর পর এক দিন পৃথিবীর বুকে আছড়ে পড়ল একটি বিশাল গ্রহাণু। কোনও গ্রহাণুর নিরিখে, আকারে তা ছিল বেশ বড়। প্রায় মঙ্গল গ্রহের সমান।

বেঙ্গালুরুর ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ অ্যাস্ট্রোফিজিক্সের অধ্যাপক, বিশিষ্ট জ্যোতির্বিজ্ঞানী সুজন সেনগুপ্ত

এই ধরিত্রীর বুক তখনও কঠিন হয়নি। পৃথিবী তখন নেহাতই শিশু! বিশাল গ্রহাণুর সঙ্গে সেই প্রচণ্ড সঙ্ঘাতে পৃথিবীর নরম বুক ফেটে গেল। ধরিত্রী আক্ষরিক অর্থেই, দ্বিধা হল।

যা হয় মঙ্গলের জন্য?

যে বিশাল মহাজাগতিক বস্তুটি সে দিন পৃথিবীর বুকে আছড়ে পড়েছিল আর তাতে প্রায় ধ্বংসের উপক্রম হয়েছিল ধরিত্রীর, তার নাম ছিল ‘থেইয়া’।

থেইয়ার ধাক্কার ফলে যে ভাবে চাঁদের জন্ম আর তার পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ শুরু হল। শিল্পীর কল্পনায়। ছবি সৌজন্যে: নাসা

তবে সে দিন সেই আঘাত থেকে পৃথিবী নিজেকে কোনও মতে বাঁচাতে পেরেছিল। তবে কিছু ক্ষয়ক্ষতিও হয়েছিল পৃথিবীর। সেই সঙ্ঘাতের পর একটি ছোট টুকরো বেরিয়ে এসে পৃথিবীর চার পাশে প্রদক্ষিণ শুরু করে। ওই ছিটকে আসা বস্তুটিই আমাদের আজকের চাঁদ।

চাঁদ না থাকলে আমার, আপনার জন্মই হত না যে!

জানেন কি, চাঁদ না থাকলে, এই পৃথিবীতে আদৌ জীবনের সম্ভাবনা থাকত না? জানেন কি, পৃথিবীর আকাশে এই একটি চাঁদ কী ভাবে বাঁচিয়ে রেখেছে জীবনকে? ‘থেইয়া’র সঙ্গে প্রচণ্ড সংঘর্ষের ফলে পৃথিবীর ঘূর্ণনের গতি অনেকটাই কমে যায়। বেড়ে যায় পার্থিব দিন আর রাত্রির দৈর্ঘ।

কিন্তু এখন পৃথিবীতে যে ২৪ ঘণ্টার একটি দিন ও রাত, তা সম্ভব হয়েছে চাঁদের প্রবল অভিকর্ষ বলের জন্যই। সেই টানে আজও পৃথিবীর ঘূর্ণনের গতি কমছে একটু একটু করে। তার ফলে, একটু একটু করে বাড়ছে পৃথিবীর দিন ও রাতের দৈর্ঘ্য। প্রতি ১০ লক্ষ বছরে পার্থিব দিন বা রাতের দৈর্ঘ্য প্রায় ষোল সেকেন্ড করে বেড়ে চলেছে।

আকারে পৃথিবীর প্রায় এক-তৃতীয়াংশ আমাদের চাঁদ। যা শুধুমাত্র মহাসাগরে জোয়ার-ভাটা সৃষ্টি করে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের প্রবাহকেই নিয়ন্ত্রণ করছে না, পৃথিবীর অক্ষকেও সে স্থায়ী করে রেখেছে। গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরত, হেমন্ত, শীত ও বসন্তের যে ঋতুচক্রের খেলা আমরা উপভোগ করি, চাঁদ ছাড়া তা সম্ভবই হত না।

বৃহস্পতির একটি চাঁদ ‘গ্যানিমিড’।

যে ঋতুচক্রের ফলে পৃথিবীর বুকে মানুষের মতো বড়সড় প্রাণের আবির্ভাব সম্ভব হয়েছে, তা সম্ভব হয়েছে একটিই কারণে। পৃথিবী তার অক্ষের উপর এখন প্রায় ২৩.৪৪ ডিগ্রি কোণ করে হেলে রয়েছে বলে।

চাঁদ না থাকলে কেন তা প্রতিকূল হত জীবনের পক্ষে?

পৃথিবীর অক্ষটি প্রায় ৪১ হাজার বছরে ২২.১০ ডিগ্রি থেকে ২৪.৫০ ডিগ্রিতে ঘোরাফেরা করে পেন্ডুলামের মতো। পৃথিবীর আকাশে চাঁদ যদি না থাকত আর তার ফলে পৃথিবী যদি খুব জোরে তার অক্ষের চার পাশে ঘুরপাক খেত, তা হলে বৃহস্পতি ও শনির মতো দৈত্যাকার গ্রহগুলির অভিকর্ষের টানে পৃথিবী তার অক্ষ-পথে আরও অনেক বেশি হেলে পড়ত, হেলে থাকত। আর তার ফলে অস্বাভাবিক জলবায়ুর সৃষ্টি হত। যা পৃথিবীর বুকে প্রাণের বিবর্তনের পক্ষে প্রতিকূল হয়ে উঠতে পারত।

শনি, বৃহস্পতির কু-দৃষ্টি থেকে আগলে রেখেছে চাঁদ!

আমাদের আদরের চাঁদ, তার অভিকর্ষ বল দিয়ে বৃহস্পতি আর শনির সেই কু-দৃষ্টি থেকে আমাদের রক্ষা করেছে, রক্ষা করে চলেছে।

যা মঙ্গল গ্রহের খুব ছোট দু’টি উপগ্রহ ‘ডিমোস’ আর ‘ফোবস’ পারেনি। তারা বৃহস্পতি বা শনির এই প্রভাব থেকে মঙ্গলকে মুক্ত করতে পারেনি বলেই লাল গ্রহে ঋতুগুলির পরিবর্তন খুবই অনিয়মিত। প্রাণের বিকাশ, তার বিবর্তন ও টিঁকে থাকার পক্ষে প্রতিকূলও।

শনির একটি চাঁদ ‘টাইটান’।

এক চাঁদেই কেল্লা ফতে!

তাই, না-ই বা থাকল আমাদের ১০টি চাঁদ। লক্ষ কোটি নক্ষত্র যেমন জ্যোৎস্না দিতে পারে না, তেমনই একাধিক চাঁদও হয়তো একটি চাঁদের মাহাত্ম্য, গৌরব, আদর-খাতির খর্ব করে দিত। হয়তো-বা, একাধিক চাঁদের উপস্থিতিতে পৃথিবীর আবহাওয়া প্রাণের জন্ম ও বিকাশের পক্ষে প্রতিকূল হয়ে উঠতে পারত।

‘আমি যামিনী, তুমি শশী হে...’

তাই কি সৃষ্টিকর্তা নিখুঁত ভাবে ঠিক সেটাই করেছেন, যাতে পৃথিবীর মতো একটি গ্রহে প্রাণের জন্ম হতে পারে? প্রাণের বিকাশ ঘটতে পারে? সেই প্রাণ বিবর্তিত হয়ে বুদ্ধিমান মানুষের জন্ম দিতে পারে?

যা এক দিন চাঁদের জ্যোৎস্নায় আপ্লুত হয়ে যে মানবসভ্যতাই গেয়ে ওঠে, ‘‘আমি যামিনী, তুমি শশী হে, ভাতিছ গগন মাঝে...’’

ছবি সৌজন্যে: অধ্যাপক সুজন সেনগুপ্ত ও নাসা।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy