চন্দ্রযান-২। ছবি সৌজন্যে: ইসরো
মঙ্গলে ঊষা, বুধে পা! হ্যাঁ, আর পৃথিবীর কক্ষপথের গণ্ডিতে আটকে নেই চন্দ্রযান-২। আমাদের গ্রহটিকে ‘গুড বাই’ জানিয়ে ভারতের দ্বিতীয় চন্দ্রযান মঙ্গলবার রাত ৩টে থেকে বুধবার ভোর ৪টের মধ্যে ঢুকে পড়েছে সরাসরি চাঁদে পৌঁছনোর পথে।
সাত দিন ধরে সেই পথ পেরনোর পর চন্দ্রযান-২ চাঁদের কক্ষপথে ঢুকবে ২০ অগস্ট, আগামী মঙ্গলবারের ঊষা লগ্নেই। ইসরো সূত্রে এই খবর জানানো হয়েছে।
তবে এখনও এখনও সরু সুতোয় ঝুলে রয়েছে ‘চন্দ্রযান-২’-এর ভাগ্য! হিসেবের একটু এ দিক ও দিক হয়ে গেলেই জলে যাবে ১ হাজার কোটি টাকা।
এখনও উদ্বেগে, উৎকণ্ঠায় ইসরো!
কারণ, পৃথিবীর কক্ষপথের বাইরে চলে গেলেও এখনও চন্দ্রযান-২-এর উপর রয়েছে পৃথিবীর অভিকর্ষ বল। ১৪ অগস্ট থেকে যতই একটু একটু করে চাঁদের দিকে এগিয়ে যাবে ভারতের দ্বিতীয় চন্দ্রযান, ততই তার উপর একটু একটু করে কমবে পৃথিবীর অভিকর্ষ বল। বাড়তে থাকবে চাঁদের অভিকর্ষ বল। যে ভাবে দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে ধরে কলকাতা থেকে দুর্গাপুরের দিকে এগলে একটু একটু করে পথের পাশের ছবিটা বদলে যায়। কমে যায় কলকাতার চেনা ছবি, চেনা পাড়া, চেনা টান। চোখে পড়তে থাকে দুর্গাপুরের অচেনা ছবি, অচেনা পাড়া আর তার নতুন এক ধরনের টান!
ভারতের দ্বিতীয় চন্দ্রাভিযান সম্পর্কে এই তথ্যগুলি জানেন কি?
বেঙ্গালুরুতে ইসরোর চন্দ্রযান-২-এর মিশন কন্ট্রোল রুমে তাই এখন রীতিমতো দাঁতে দাঁত চেপে উৎকণ্ঠায় দিন-রাতের ২৪ ঘণ্টার প্রত্যেকটি সেকেন্ড কাটাচ্ছেন প্রযুক্তিবিদ ও বিজ্ঞানীরা। বলা ভাল, উত্তেজনায় থরথর করে কাঁপছেন মিশন কন্ট্রোল রুমের সদস্যরা।
আরও পড়ুন- ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টিরহস্যের জট খুলতে আরও রোমাঞ্চকর অভিযানের পথে ইসরো
আরও পড়ুন- চাঁদে এখন না নামলে পরে খুবই পস্তাতে হত ভারতকে!
হিসাবে একটু ভুলচুক হয়ে গেলেই চন্দ্রযান-২-এর আর চাঁদে নামা হবে না! চাঁদের পাশ কাটিয়ে ভারতের মহাকাশযান চলে যেতেই পারে সৌরমণ্ডলের অন্য কোনও দিকে। কোনও অজানা, অচেনা গন্তব্যে। চাঁদ সে ক্ষেত্রে অধরাই থেকে যেতে পারে ভারতের! আশঙ্কাটা যথেষ্টই জোরালো এখনও পর্যন্ত। সঠিক ভাবে দিনক্ষণ গুণে বলতে হলে, ২০ অগস্ট পর্যন্ত তো অবশ্যই।
কেন ২০ অগস্ট পর্যন্ত আশঙ্কা এতটা জোরালো?
বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদদের একটি বড় অংশেরই বক্তব্য, চাঁদের কক্ষপথে যত ক্ষণ না ঢুকে পড়তে পারছে চন্দ্রযান-২, তত ক্ষণ বা তত দিন ‘কী হয় কী হয়’ আশঙ্কাটা থেকেই যাবে ইসরোর। তার থেকে রেহাই পাওয়ার কোনও উপায় নেই। সেটা চলবে ২০ অগস্ট পর্যন্ত। লুনার ট্রান্সফার অরবিটে চন্দ্রযান-২ ঢুকে পড়ার (যা হওয়ার কথা ১৪ অগস্ট) ৫/৬ দিন পরেও।
তাঁদের এও বক্তব্য, এই উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা ইসরো কমাতে পারত যদি ক্ষমতা আরও বাড়াতে পারত ‘জিএসএলভি-মার্ক-৩’ রকেটের। নাসার জেট প্রোপালসান ল্যাবরেটরির এক বিজ্ঞানীর কথায়, ‘‘আমরা ১৯৬৯ সালেই যে ‘স্যাটার্ন-ফাইভ’ রকেটে চাপিয়ে পাঠিয়েছিলাম অ্যাপোলো-১১ মিশন, তা উৎক্ষেপণের পর চাঁদের বুকে নামতে সময় নিয়েছিল মাত্র চার দিন বা তার সামান্য বেশি। চিনও গত বছর চাঁদের না-দেখা পিঠে ল্যান্ডার ও রোভার পাঠিয়েছে উৎক্ষেপণের পর মাত্র পাঁচ দিনে। ইসরোর লাগছে ৪২ দিন। ইসরোর ল্যান্ডারের চাঁদে নামার কথা আগামী ৬ অক্টোবর। তাই এই উদ্বেগটা আমাদের অনেকটাই কম ছিল। কম ছিল চিনেরও।’’
যে পথে চাঁদে, দেখুন ইসরোর ভিডিয়ো
সবকিছু ঠিকঠাক চললে আগামী ২০ অগস্ট, ভারতের দ্বিতীয় চন্দ্রযান ঢুকে পড়বে ল্যাগরাঞ্জ-১ পয়েন্টে। যেখানে সেখান থেকেই ঢুকে পড়বে চাঁদের অনেক দূরের কক্ষপথে। আর সেই সময়েই চন্দ্রযান-২ পড়ে যাবে পুরোপুরি চাঁদের অভিকর্ষ বলের খপ্পরে। যখন চাঁদকে এড়িয়ে সৌরমণ্ডলের আর কোথাও যাওয়া সম্ভব নয় চন্দ্রযান-২-এর। সেইখানেই বিগড়ে বা পুরোপুরি বিকল হয়ে গেলে চাঁদের কক্ষপথেই অনন্ত কাল ধরে ঘুরতে হবে ভারতের দ্বিতীয় চন্দ্রযানকে।
কোন রুটে চাঁদে যাচ্ছে চন্দ্রযান-২?
এ ব্যাপারে ইসরোর মিশন কন্ট্রোল রুম থেকে এই প্রতিবেদক একটি নির্ধারিত সূচি পেয়েছেন। সেই সূচির গভীরে ঢোকার আগে একটু আলোচনা করে নেওয়ার প্রয়োজন, পৃথিবী থেকে রওনা হওয়ার পর ঠিক কোন ‘রুট’ ধরে, পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে কী ধরনের কক্ষপথে ঘুরছে চন্দ্রযান-২।
ইসরোর মিশন কন্ট্রোল রুম সূত্রের খবর, গত ২২ জুলাই, দুপুর ২টো ৪৩ মিনিটে অন্ধ্রপ্রদেশের শ্রীহরিকোটা থেকে উৎক্ষেপণের ১৬ মিনিটের মধ্যেই (দুপুর ২টো ৫৭ মিনিট নাগাদ বা তার কিছু পরে) চন্দ্রযান-২কে পিঠে চাপিয়ে ভারতের সবচেয়ে শক্তিশালী রকেট ‘জিএসএলভি-মার্ক-৩’ পৌঁছে যায় ভূপৃষ্ঠ থেকে ১৭০ কিলেমিটার উপরে। পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করতে শুরু করে একটি উপবৃত্তাকার কক্ষপথে।
আর সেই দিন থেকেই ইসরো বিজ্ঞানীদের চেষ্টা শুরু হয়ে যায় রিমোট কন্ট্রোলে ঠেলেঠুলে চন্দ্রযান-২কে আরও দূরের কোনও উপবৃত্তাকার কক্ষপথে (ইলিপটিকাল অরবিট) ঢোকানোর।
কোনও বৃত্তের থাকে একটি কেন্দ্রীয় বিন্দু। কিন্তু কোনও উপবৃত্তের থাকে দু’টি কেন্দ্রীয় বিন্দু। ফলে, পৃথিবীকে প্রদক্ষিণের সময় কোনও বৃত্তাকার কক্ষপথে থাকলে মহাকাশযান সব সময়ই আমাদের গ্রহটি থেকে থাকে একই দূরত্বে। সেই বৃত্তাকার কক্ষপথের প্রতিটি বিন্দুতেই মহাকাশযানটির উপর পৃথিবীর অভিকর্ষ বলের পরিমাণও থাকে একই রকম। অভিন্ন।
২২ জুলাই থেকে চন্দ্রযান-২-এর মহাকাশ পরিক্রমা
তাই গত ২২ জুলাই উৎক্ষেপণের পর চন্দ্রযান-২ যখন পৃথিবীর সবচেয়ে কাছে ছিল, তখন ভূপৃষ্ঠ থেকে তা ছিল ১৭০ কিলোমিটার দূরে। আর ওই দিন যখন পৃথিবী থেকে সবচেয়ে দূরে ছিল ভারতের দ্বিতীয় চন্দ্রযান, তখন সেটি ছিল ৪৫ হাজার ৪৭৫ কিলোমিটার দূরে। ইসরো সূত্রেই এ কথা জানা গিয়েছে।
পৃথিবীর মায়ার টান যে বার বার টেনেছে চন্দ্রযান-২কে!
কিন্তু পৃথিবীর অভিকর্ষ বলের টান যে বার বারই কাছে টেনে আনার চেষ্টা করছে চন্দ্রযান-২কে। তাকে চাঁদের কাছে যেতে দিতে চাইছে না! ফলে, বার বার ইসরোর মিশন কন্ট্রোল রুম থেকে কম্যান্ড পাঠিয়ে চন্দ্রযান-২কে ঠেলেঠুলে পাঠিয়ে দিতে হয়েছে পৃথিবী থেকে আরও দূরের উপবৃত্তাকার কক্ষপথে।
তাই ইসরো জানাচ্ছে, গত ২৪ জুলাই দুপুর ২টো থেকে বিকেল সাড়ে তিনটের মধ্যে চন্দ্রযান-২কে কম্যান্ড পাঠিয়ে ঠেলেঠুলে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে যে উপবৃত্তাকার কক্ষপথে, সেখানে চন্দ্রযান-২ ছিল পৃথিবী থেকে সর্বাধিক ৪৫ হাজার ১৬২ কিলোমিটার দূরত্বে। ওই দিন আমাদের সবচেয়ে কাছে যখন এসেছিল চন্দ্রযান-২, তখন তার দূরত্ব ছিল ২৪১.৫ কিলোমিটার।
তার পর ২৬ জুলাই চন্দ্রযান-২কে ঠেলেঠুলে পাঠানো হয় (রাত ১টা থেকে ২টো) নতুন একটি উপবৃত্তাকার কক্ষপথে। যেখানে মহাকাশযানটি ছিল পৃথিবী থেকে সর্বাধিক ৫৪ হাজার ৮৪৮ কিলোমিটার দূরত্বে। সবচেয়ে কাছে থাকর সময় ছিল ২৬২.৯ কিলোমিটার দূরে।
গত ২৯ জুলাই, সোমবার চন্দ্রযান-২কে পাঠানো হয় (দুপুর ৩টে থেকে বিকেল ৪টে) আর একটি উপবৃত্তাকার কক্ষপথে। সেখানে চন্দ্রযান-২ পৃথিবী থেকে ছিল সর্বাধিক ৭১ হাজার ৩৪১ কিলোমিটার দূরে। সবচেয়ে কাছে সেই দূরত্বটা ছিল ২৮১.৬ কিলোমিটার।
গত ২ অগস্ট চন্দ্রযান-২ যায় নতুন আর একটি উপবৃত্তাকার কক্ষপথে (দুপুর ২টে থেকে দুপুর ৩টে)। সেখানে চন্দ্রযান-২ পৃথিবী থেকে ছিল সর্বাধিক ৮৯ হাজার ৭৪৩ কিলোমিটার দূরে। সবচেয়ে কাছে সেই দূরত্বটা ছিল ২৬২.১ কিলোমিটার।
আর গত ৬ অগস্ট চন্দ্রযান-২ যায় নতুন আর একটি উপবৃত্তাকার কক্ষপথে। সেখানে পৌঁছলে চন্দ্রযান-২ পৃথিবী থেকে ছিল সর্বাধিক ১ লক্ষ ৪৩ হাজার ৯৫৩ কিলোমিটার দূরে। সবচেয়ে কাছে ছিল ২৩৩.২ কিলোমিটার দূরত্বে।
আরও পড়ুন- ৩০ বছরের মধ্যেই চাঁদে বড় শিল্পাঞ্চল গড়ে ফেলবে মানুষ!
আরও পড়ুন- চার বছরের মধ্যেই চাঁদের পাড়ায় ‘বাড়ি’ বানাচ্ছে নাসা!
এর থেক়েই স্পষ্ট পরের উপবৃত্তাকার কক্ষপথে পৌঁছনোর সঙ্গে সঙ্গেই পৃথিবী থেকে দূরত্ব বেড়েছে চন্দ্রযান-২-এর। আর তা তত বেশি করে এগিয়ে গিয়েছে চাঁদের দিকে।
সোজা চাঁদে যাওয়ার রাস্তায় পা পড়ল ১৪ অগস্টে
আজ রাত ৩টে থেকে ভোর ৪টের মধ্যে চন্দ্রযান-২ ঢুকে পড়ল সোজা চাঁদের যাওয়ার রাস্তায়। বিজ্ঞানের পরিভাষায় যাকে বলা হয়, ‘লুনার ট্রান্সফার অরবিট’। যখন পৃথিবীর অভিকর্ষ বল আর চন্দ্রযান-২-এর উপর কম কার্যকরী হবে। ওই সময় চন্দ্রযান-২ পৃথিবী থেকে থাকবে সর্বাধিক ৪ লক্ষ ১২ হাজার ৫০৫ কিলোমিটার দূরে। ভূপৃষ্ঠ থেকে ২৭৮.৪ কিলোমিটার উপরে।
চন্দ্রযান-২-এর নকশা
এল-ওয়ান পয়েন্টে না পৌঁছনো পর্যন্ত উৎকণ্ঠা কাটবে না ইসরোর
সন্দীপ জানাচ্ছেন, চাঁদ পৃথিবী থেকে রয়েছে ৩ লক্ষ ৮৪ হাজার কিলোমিটার দূরে। কিন্তু চাঁদ আর পৃথিবীর মাঝে এমন একটি বিন্দু রয়েছে, যেখানে চাঁদ ও পৃথিবীর অভিকর্ষ বলের পরিমাণটা হয় সমান সমান। ওই বিন্দুটিকে বলা হয়, ‘ল্যাগরাঞ্জ-ওয়ান (এল-ওয়ান) পয়েন্ট’। সেই বিন্দুতে যখন পৌঁছবে চন্দ্রযান-২, আর তখন যদি চাঁদ পৃথিবী থেকে থাকে সবচেয়ে বেশি দূরত্বে, সেই সময়টিই হবে চাঁদের কাছের কক্ষপথে ঢুকে পড়ার জন্য চন্দ্রযান-২-এর পক্ষে সেরা সময়। কারণ, ওই সময় চন্দ্রযান-২-এর উপর পৃথিবীর অভিকর্ষ বল হবে সবচেয়ে কম। আবার চাঁদের অভিকর্ষ বলও ততটা বেশি হবে না, যা চন্দ্রযান-২কে আছড়ে ফেলতে পারে চাঁদের বুকে। এই সময়গুলি একে অন্যের সঙ্গে না মিললেই যে কোনও সময় ঘটতে পারে বিপত্তি।
গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ
ছবি সৌজন্যে: ইসরো ও নাসা
ভিডিয়ো সৌজন্যে: ইসরো
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy