ফাইল ছবি।
চামড়া থেকে ব্রেন সেল (মস্তিষ্কের কোষ) বানিয়ে এক ধরনের অটিজম সারানোর পথের হদিশ দিলেন এক বঙ্গসন্তান। দেখালেন, এত দিন আমাদের মস্তিষ্কে যে কোষদের তেমন গুরুত্ব দেওয়া হত না, কিছুটা ‘অচ্ছুত’ বলেই ভাবা হত, সেই ‘উপেক্ষিত’রাই শিশুদের এক ধরনের অটিজমের প্রধান কারিগর। তারাই শিশুদের মস্তিষ্কের নিউরনগুলিকে বিগড়ে দেয়। তাদের খামখেয়ালি করে তোলে। যার জেরে জন্ম নেয় বিশেষ এক ধরনের অটিজম। যার নাম- ‘ফ্র্যাজাইল এক্স সিনড্রোম’। সেই উপেক্ষিতদের দেখতে একেবারেই আকাশের তারার মতো।
শান্তিনিকেতনের সোনার এই আবিষ্কার একটি বিশেষ ধরনের অটিজম থেকে শিশুদের রেহাই দেওয়ার জন্য নতুন নতুন ওষুধ আবিষ্কারের দরজাটাও খুলে দিতে চলেছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। বলা ভাল, অটিজমে ‘তারার আলো’ ফেললেন সোনা!
বেঙ্গালুরুর ‘ন্যাশনাল সেন্টার ফর বায়োলজিক্যাল সায়েন্সেস (এনসিবিএস)’-এর অধ্যাপক ও ‘সেন্টার ফর ব্রেন ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড রিপেয়ার’-এর অধিকর্তা সুমন্ত্র (সোনা) চট্টোপাধ্যায় ও তাঁর সহযোগীদের গবেষণাপত্রটি রিভিউয়ের জন্য দিনকয়েক আগে জমা পড়েছে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান-জার্নাল ‘মলিকিউলার অটিজম’-এ। সুমন্ত্রের গবেযকদলে রয়েছেন এনসিবিএস-এ তাঁর সহকর্মী রাখি পাল এবং ছাত্রী শ্রেয়া দাস শর্মাও।
অটিজম: ভারতে ভয়াবহ
শুধু ভারতেই অটিজমে আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা অন্তত ১ কোটি। এ দেশে প্রতি ১০০টি শিশুর মধ্যে একটিতে ধরা পড়ে অটিজম। জন্মের মাসছয়েক পর থেকেই সাধারণত অটিজমে আক্রান্ত হয় শিশুরা। তবে শিশুরা মোটামুটি ৩ বছর বয়সের আগে তেমন ভাবে কথা বলতে শেখে না বলে অটিজম ধরাই পড়ে অনেক দেরিতে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অটিজমের প্রাথমিক লক্ষণ হল, শিশু ঠিকমতো কথা বলতে শেখে না। বললেও জড়িয়ে যায়।
গলার স্বরও অন্য রকম হয়। দৃষ্টি ঝাপসা হয়। কারও সঙ্গে মিশতে শেখে না শিশু। এমনকী মা, বাবার থেকেও দূরে থাকতে চায়। চট করে রেগে যায়। অটিজম-এ আক্রান্ত শিশুদের প্রথমে মানসিক প্রতিবন্ধী ভাবা হয়। তাই অধিকাংশেরই চিকিৎসা হয় না। হলেও ভুল চিকিৎসা হয়।
নির্দিষ্ট টার্গেট মিলল এই প্রথম
সুমন্ত্র বলছেন, ‘‘অটিজম নানা ধরনের হয়। বিশেষ একটি ধরনের নাম ‘ফ্র্যাজাইল এক্স সিনড্রোম’। অটিজমের জন্য দায়ী বিভিন্ন ধরনের জিন। কিন্তু ফ্র্যাজাইল এক্স সিনড্রোম হয় শুধুই এক্স ক্রোমোজোমে। বিশেষ একটি জিনের জন্য। যার নাম- ‘এফএমআর-ওয়ান’। ফলে, ফ্র্যাজাইল এক্স সিনড্রোম থেকে শিশুদের রেহাই দিতে নিউরন ছাড়াও এই প্রথম অন্য একটি নির্দিষ্ট টার্গেট পাওয়া গেল। যা অটিজমের বিরুদ্ধে লড়াই চালানোর গবেষণাকে সমৃদ্ধ করবে বলেই আমার বিশ্বাস।’’
সুমন্ত্র অবশ্য এও জানিয়েছেন, এই নতুন পথ সব ধরনের অটিজমের সমস্যা মেটাতে পারবে না। কারণ, অটিজম হয় অনেক রকমের জিনের জন্য। কোনও একটি ক্ষেত্রে ‘দুষ্টু’ জিনও শরীরের অন্যান্য কাজকর্মে ‘সুবোধ বালক’ হয়ে ওঠে। সেই জিন আমাদের উপকারও করতে পারে। তাই অটিজম সারাতে সেই সব জিনকে ‘ব্লক’ করে দেওয়াটা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। সে ক্ষেত্রে অন্য রাস্তা খুঁজতে হবে। অটিজম থেকে রেহাই পেতে এখন তো খড়ের গাদায় সূচ খোঁজা চলছে!
বেঙ্গালুরুর গবেষণাগারে স্নায়ুবিজ্ঞানী সুমন্ত্র চট্টোপাধ্যায়
সুমন্ত্রের কথায়, ‘‘এটুকু বলা যায়, ভিনদেশ বা ভিনরাজ্য থেকে পশ্চিমবঙ্গের জেলায় জেলায় যেতে অন্তত কলকাতায় পা ছোঁয়ানো গেল!’’
অটিজমের তেমন কার্যকরী ওষুধ কেন নেই?
বিভিন্ন ধরনের অটিজমের কথা জানি আমরা অনেক আগেই। তা হলে, অটিজমের তেমন কার্যকরী ওষুধ কেন বাজারে আনা সম্ভব হয়নি এত দিন?
লন্ডন থেকে মিনিটকুড়ির দূরত্বে ব্রিটেনের রেডিং বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘নিউরোসায়েন্স’ বিভাগের অধ্যাপক ও ‘সেন্টার ফর অটিজম’-এর অধিকর্তা ভীষ্মদেব চক্রবর্তী বলছেন, ‘‘এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার। এত দিন প্রধানত, ইঁদুরের মস্তিষ্কের উপর পরীক্ষা চালিয়েই বাজারে ওষুধ আনা হত। যেহেতু মানবমস্তিষ্ক নিয়ে পরীক্ষা চালানোর সুযোগটা দুর্লভই। দেখা গিয়েছে, ইঁদুরের মস্তিষ্কের উপর পরীক্ষা চালিয়ে বাজারে আনা সেই সব ওষুধ মানবশিশুদের অটিজম সারাতে মস্তিষ্কে তেমন কার্যকরী হয় না।’’
তাই পরীক্ষানিরীক্ষার জন্য কৃত্রিম ভাবে ব্রেন সেল বানানোর প্রয়োজন হয়েছিল। যা চামড়া থেকে নেওয়া স্টেম সেল দিয়ে বানানো হয়েছে। তবে এর আগেও চুল বা চামড়া থেকে ব্রেন সেল বানানো হয়েছে কোনও কোনও দেশে।
সুমন্ত্রের গবেষণার অভিনবত্ব
কিন্তু অটিজম সারাতে মানুষের কৃত্রিম ব্রেন সেলের উপর পরীক্ষানিরীক্ষা তেমন ভাবে হয়নি। সেটাই করেছেন সুমন্ত্র ও তাঁর সহযোগীরা। আর সেটা করতে গিয়েই দেখেছেন চমকে দেওয়ার মতো ঘটনা। দেখেছেন, মস্তিষ্কের যে উপেক্ষিত কোষগুলিকে (অ্যাস্ট্রোসাইটস) এত দিন অটিজমের কারণ হতে পারে বলে ধর্তব্যের মধ্যে ধরা হয়নি, তাদেরই কেউ কেউ বিশেষ এক ধরনের অটিজম- ফ্র্যাজাইল এক্স সিনড্রোমে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিচ্ছে। এদের দেখতে একেবারে আকাশের তারার মতো। আমাদের ব্রেন ও মেরুদণ্ডে এরা থাকে প্রচুর পরিমাণে। এদের আরও একটি নামে ডাকা হয়। ‘অ্যাস্ট্রোগ্লিয়া’।
অ্যাস্ট্রোসাইটস: কী, কেমন?
আমাদের মস্তিষ্ক ও মেরুদণ্ডে নিউরন ছাড়াও রয়েছে ‘গ্লায়াল কোষ’। সংখ্যায় প্রায় সাড়ে ৮ হাজার কোটি। একই সংখ্যায় নিউরন রয়েছে আমাদের মস্তিষ্ক ও মেরুদণ্ডে। এই গ্লায়াল কোষগুলি একেবারে ঘিরে থাকে নিউরনগুলিকে। এরা মোট ৬ ধরনের হয়। ‘ওলিগোডেনড্রোসাইটস’, ‘অ্যাস্ট্রোসাইটস’, ‘স্যাটেলাইট সেলস (উপগ্রহ কোষ), ‘মাইক্রোগ্লিয়া’, ‘এপেন্ডিম্যাল সেল’ এবং ‘সোয়ান সেল’। এদেরই বলা হয় আদার ব্রেন সেল।
আমাদের মস্তিষ্কে নিউরন ও অ্যাস্ট্রোসাইটস
সুমন্ত্র ও ভীষ্মদেব জানাচ্ছেন, বছরদশেক হল এটা জানা গিয়েছে, আমাদের নিউরনগুলিকে সুস্থ, সবল, সক্রিয় রাখতে বড় ভূমিকা নেয় এই গ্লায়াল কোষগুলি।
ভীষ্মদেবের কথায়, ‘‘বলা যায়, এরাই নিউরনগুলিকে সুস্থ ভাবে বেঁচে থাকার রসদ জোগায়। একটি নিউরন থেকে অন্য নিউরনে বার্তা (সিগন্যাল বা অ্যাকশন পোটেনশিয়াল), যার মাধ্যমে শরীরের বিভিন্ন অনুভূতি ও কাজকর্ম হয়) পাঠানোর সহায়ক হয় এরাই। এরা না থাকলে নিউরন দুর্বল হয়ে পড়ে। নিউরনের বার্তা প্রেরণেও ব্যাঘাত ঘটে। এই ধরনের কোষগুলি মস্তিষ্কে হোমোস্টাসিসেও (বাইরের চাপ ও তাপমাত্রার বাড়া-কমা সত্ত্বেও শরীরের ভিতরের অবস্থাকে অপরিবর্তিত রাখা) বড় ভূমিকা নেয়।’’
এই গ্লায়াল কোষগুলির মধ্যে সুমন্ত্র যে অ্যাস্ট্রোসাইটস নিয়ে চমকে দেওয়ার মতো গবেষণা করেছেন, অ্যালঝাইমার্স ডিজিজ, পারকিনসন্স ডিজিজ, হেপাটিক এলসেফ্যালোপ্যাথির মতো কয়েকটি মস্তিষ্কঘটিত রোগে তাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে দেখা গিয়েছে অতীতে।
‘তারা’র আলো পড়লে আর না পড়লে যেমন ভাবে বার্তা পাঠায় আমাদের নিউরন
ভীষ্মদেব জানাচ্ছেন, আমাদের মস্তিষ্ক ও মেরুদণ্ডের সুস্থ, সবল নিউরনগুলি সাধারণত অন্য নিউরনে বার্তা পাঠানোর সময় ঝলক মারে। যাকে স্নায়ুবিজ্ঞানীরা ‘ফায়ারিং’ বলেন। এই ফায়ারিং না হলে একটি নিউরন অন্য নিউরনে বার্তা পাঠাতে পারে না। সুস্থ, সবল নিউরনগুলির এই ফায়ারিং-এর একটি নির্দিষ্ট ধরন রয়েছে। সেগুলি খুব বড় বড় ফায়ারিং হয়। আর তা অনেকটা সময় পর পর হয়। কিন্তু ফ্র্যাজাইল এক্স সিনড্রোমে আক্রান্ত নিউরনগুলির ফায়ারিং-গুলি হয় একেবারেই অন্য রকমের। সেগুলি খুব ঘনঘন হয়। আর সেগুলি মোটেই বড় ফায়ারিং নয়। ছোট ছোট ফায়ারিং। সুমন্ত্ররা দেখিয়েছেন, সেটা হয় অ্যাস্ট্রোসাইটসের জন্যই। এমনকী, মানবমস্তিষ্কের যেখানে যেখানে অ্যাস্ট্রোসাইটস তৈরি হয়েছে, সেখান থেকে যদি তাদের অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়, তা হলেও সুস্থ নিউরনগুলির ফায়ারিং-এর ধরনটা হয়ে পড়ে ফ্র্যাজাইল এক্স সিনড্রোমে আক্রান্ত নিউরনের ফায়ারিং-এর মতোই। এটা বোঝাচ্ছে, অ্যাস্ট্রোসাইটস এক ধরনের রস নিঃসরণ করে। অ্যাস্ট্রোসাইটসের অবর্তমানে সেই রসও (সুমন্ত্রের কথায়, ‘রসম’, দেখা গিয়েছ ওই রসে থাকে ‘এস ১০০ বিটা’ নামে একটি পদার্থ) ফ্র্যাজাইল এক্স সিনড্রোমে আক্রান্ত নিউরন গুলিকে সুস্থ করে দিতে পারে।
সুমন্ত্রের দুই সহযোগী গবেষক শ্রেয়া দাসশর্মা ও রাখি পাল।
এ বার হয়তো কার্যকরী ওষুধ আসবে: চিকিৎসক জয়রঞ্জন রাম
কলকাতার ‘অ্যাপোলো গ্লেনিগেল্স’ হাসপাতালের মনোরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক জয়রঞ্জন রাম বলছেন, ‘‘সুমন্ত্রের কৃতিত্ব, ফ্র্যাজাইল এক্স সিনড্রোমের মতো বিশেষ এক ধরনের অটিজমের ক্ষেত্রে তিনি অ্যাস্ট্রোসাইটসের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা প্রথম পরীক্ষানিরীক্ষার মাধ্যমে দেখাতে পেরেছেন। তার ফলে হয়তো আগামী দিনে এই বিশেষ ধরনের অটিজমের কার্যকরী ওষুধ বেরতে পারে।
শুধু তাই নয়, সুমন্ত্রের গবেষণা অটিজমে আক্রান্ত মানবশিশুদের ব্রেনের কাজকর্মগুলিকে বুঝতে অনেকটাই সাহায্য করবে।’’ জয়রঞ্জন ও ভীষ্মদেবের নেতৃত্বে একটি গবেষকদলই প্রথম কাজ করেছিল পশ্চিমবঙ্গে অটিজমের প্রভাব-বৃদ্ধি নিয়ে।
সুমন্ত্রের দেখানো পথ এ বার ওষুধ আবিষ্কারের ক্ষেত্রে হতেই পারে ‘টিপ অফ আইসবার্গ’। হিমশৈলের চূড়া!
ছবি সৌজন্যে: অধ্যাপক সুমন্ত্র চট্টোপাধ্যায়
গ্রাফিক-তথ্য: ইন্ডিয়া অটিজম সেন্টার
গ্রাফিক: তিয়াসা দাস
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy