পিঁপড়ে। গুটি গুটি পায়ে যত্রতত্র ঘুরে বেড়ানো প্রাণী। বাসার মধ্যে থেকে কিলবিল করতে করতে বেরিয়ে আসে ঝাঁকে ঝাঁকে। ও দিকে পৃথিবী, জনসংখ্যার বিস্ফোরণে টালমাটাল। তলে তলে পিঁপড়েরাও যে ওজনের দাঁড়িপাল্লায় মানুষের প্রধান চ্যালেঞ্জার হয়ে উঠছে, সে খবর আমরা ক’জন রাখি?
হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির প্রাণিবিজ্ঞানী অধ্যাপক এডওয়ার্ড ওসবোর্ন উইলসন সারাটা জীবন কাটালেন পিঁপড়েদের চরিত্র অনুসন্ধান নিয়ে। অনেক বই লিখেছেন তিনি। এ রকমই একটি বই ১৯৯৪ সালে প্রকাশিত ‘জার্নি টু দ্য অ্যান্টস’। সহযোগী গবেষক বার্ট হোয়েলডব্লার-এর সঙ্গে ওসবোর্ন লিখেছেন, দাঁড়িপাল্লার এক দিকে পৃথিবীর সব পিঁপড়েকে চাপালে তা অন্য ধারে সব মানুষের মিলিত ওজনের সমান হবে। সাংঘাতিক কথা!
বিবর্তনের ইতিহাসে মানুষের পূর্বসূরি পিঁপড়ে। প্রায় ১৪ কোটি বছর আগে ক্রিটেশিয়াস যুগে পিঁপড়ের উদ্ভব। মানুষ সে তুলনায় অনেক নবীন, মাত্র ৩০ লক্ষ বছর আগে অস্ট্রালোপিথেকাস-এর জন্ম। মানুষ উন্নত। সাধারণত সে নিজের প্রজাতির অন্যান্য সদস্যের সঙ্গে যোগাযোগে মুখনিঃসৃত শব্দ কাজে লাগায়। পিঁপড়েরাও ‘কথা’ বলে, তবে তা অন্য ভাবে। ওরা অত্যন্ত উন্নত এক যোগাযোগ ব্যবস্থার মালিক। নানা ভাবে ওরা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রেখে খাবার সংগ্রহ করে, প্রজনন করে, সন্তান লালন করে, এমনকি যুদ্ধও করে। প্রধানত তিন ভাবে এরা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রাখে।
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এডওয়ার্ড ওসবোর্ন উইলসন সারা জীবন কাটিয়ে দিলেন পিঁপড়ের নাড়ি-নক্ষত্র বিশ্লেষণ করে
ফেরোমন
ফেরোমন হল রাসায়নিক পদার্থ। পিঁপড়েদের নাক নেই। ওরা রাসায়নিকটাকে শনাক্ত করতে পারে মাথার অ্যান্টেনা দিয়ে। অ্যান্টেনা রাসায়নিক-সংবেদী অঙ্গ। রাসায়নিকটি দেহের কিছু গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত হয়। ফেরোমন হল একটি নয়, একগুচ্ছ রাসায়নিক। ওদের জীবনে ফেরোমনের গুরুত্ব অপরিসীম। ফেরোমনই কোটি কোটি বছর ওদের টিকে থাকার চাবিকাঠি। কাজের প্রকৃতির দিক থেকে ফেরোমন দু’ধরনের। ট্রেল ফেরোমন আর অ্যালার্ম ফেরোমন। প্রথমটার মাধ্যমে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ, খাবারের খোঁজ করা, খাবার নিয়ে আসা, প্রজনন, কলোনির সীমানা নির্দেশ— এ রকম নানা ধরনের কাজ হয়। আর দ্বিতীয়টায় হয় সম্ভাব্য বিপদ সম্পর্কে সহকর্মীদের সাবধান করা ও যুদ্ধের জায়গায় ডেকে আনা আর শত্রুকে তাড়ানো। তাড়ানো মানে, এক প্রজাতির পিঁপড়ে ভুল করে বা ইচ্ছা করে অন্য প্রজাতির এলাকায় ঢুকে পড়লে তার ফেরোমন-কোড অন্য প্রজাতির সঙ্গে মেলে না। সে তখন সাবধান হয়ে যায়।
ট্রেল ফেরোমন বিষ-যুক্ত আর বিষহীন পিঁপড়েদের শরীরের একাধিক গ্রন্থি থেকে বের হয়। কিছু পিঁপড়ে, যেমন, বুলেট অ্যান্ট, ফায়ার অ্যান্ট, ইউরোপীয় ফায়ার অ্যান্ট-দের উদরের শেষে হুল থাকে। হুলের গোড়ায় থাকে বিষগ্রন্থি। এই বিষই শত্রুকে ঘায়েল করতে কাজে লাগে আর ফেরোমন হিসেবে কাজ করে। বিষহীনদের শরীরের পিছনে থাকে ডিউফোর গ্রন্থি। খাদ্যনালীর পিছনে থাকা এই অংশ থেকে ফেরোমন বের হয়। এক প্রজাতির ফেরোমন সঙ্কেত অন্য প্রজাতির থেকে আলাদা। ফেরোমন যেন গোপন কোডের মতো কলোনির নিজস্বতা বজায় রাখে।
‘জার্নি টু দ্য অ্যান্টস’ বইতে হোয়েলডব্লার এবং উইলসন ফেরোমনের কাজের পদ্ধতির সুন্দর তথ্য দিয়েছেন। কলোনি থেকে বেরিয়ে খাবারের খোঁজে পিঁপড়ে কর্মীরা নানা দিকে যায়। যাওয়ার সময় দেহের শেষ প্রান্ত থেকে বিন্দু বিন্দু ফেরোমন মাটিতে ফেলতে ফেলতে যায়। আসলে বিন্দু বলতে যতটা বোঝায়, এটা তার থেকে অনেক কম। কণা কণা, বলা যেতে পারে। খাবার না পেলে নিজের ফেলে যাওয়া ফেরোমন-সঙ্কেত ধরেই কর্মী বাসায় ফেরত আসতে পারে। কিন্তু খাবার পেলে মুখে করে কিছুটা নমুনা নিয়ে আসে আর ফেরত আসার পথে আগের ফেলে আসা কণাগুলোর মাঝে মাঝে আবার ফেরোমন ফেলে আসে। ফলে ফেরোমনের একটা রেখা তৈরি হয়। মানে দাঁড়াল, যাওয়ার সময় বিচ্ছিন্ন কণা-পথ আসার সময় অবিচ্ছিন্ন রেখা-পথে পরিণত হল। মুখের স্যাম্পেল টেস্ট করে বাকিদের পছন্দ হলে ওই ফেরোমনের টানা রেখা ধরে খাবারের কাছে পৌঁছতে বাকিদের আর কোনও অসুবিধাই হয় না। একাধিক পিঁপড়ে যখন একই পথে ফেরোমন কণা ফেলতে ফেলতে যায় আর আসে, তখন তৈরি হয় ফেরোমন ‘হাইওয়ে’। খাবার শেষ হয়ে গেলে পিঁপড়েরা আর ফেরোমন ফেলে না। একটু বাদেই ফেরোমন উবে গেলে ‘হাইওয়ে’র আর চিহ্নই থাকে না।
অ্যালার্ম ফেরোমন কর্মীদের মধ্যে আক্রমণাত্মক ভাব জাগিয়ে তোলে। অ্যান্টেনা ও সামনের জোড়া পায়ে সহকর্মীকে স্পর্শ অনেকের মধ্যে যুদ্ধং-দেহি ভাব জাগিয়ে তোলে। এমন যুদ্ধের পরিবহে সাধারণ কর্মীরা খুব একটা সক্রিয় না থাকলেও, সৈনিক-কর্মীরা মুখ হাঁ করে, সামনের জোড়া পা উপরে তুলে আর উদরের পিছনের অংশ উপরে তুলে শত্রুর সামনে ‘পজ়িশন’ নেয়। অনেকটা ঠিক, ‘আয় দেখি কত বড় লড়ুইয়ে হয়েছিস,আয় লড় দেখি।’ এর পরই শুরু হয়ে যায় তুমুল লড়াই। লড়াইগুলো চলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মৃত্যু পর্যন্ত। ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় (পৌষ, ১৩৪৪) পিঁপড়েদের মধ্যেই এমন এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের কথা আছে, বাঙালি পতঙ্গবিদ গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্যের লেখায়।
স্পর্শ
এটা হয় অ্যান্টেনা আর প্রথম জোড়া পায়ের মাধ্যমে। খাবারের সন্ধান পেলে একে অপরের অ্যান্টেনায় এবং প্রথম জোড়া পা দিয়ে অন্যের মাথায় স্পর্শ করে। কখনও কখনও মুখে করে খাবারের একটু নমুনাও নিয়ে আসে। অন্য পিঁপড়ে সেটা পরখ করে দেখে। এ ভাবে খাবারের মানও বুঝিয়ে দেয়। অ্যান্টেনা-অ্যান্টেনাতে স্পর্শের মাধ্যমেও এরা পরস্পর পরস্পরকে চিনতে পারে। অন্যান্য পতঙ্গদের মতো ওদের শরীরও মোমের মতো একটা পাতলা আবরণ দিয়ে ঢাকা। একে কিউটিকুলার হাইড্রোকার্বনস বলে। এর রাসায়নিক চরিত্র বলে দেয় সামনের পিঁপড়েটা বন্ধু না শত্রু। প্রত্যেক কলোনির কিউটিকুলার হাইড্রোকার্বনস-এর রাসায়নিক চরিত্র আলাদা। তাই পিঁপড়ের সারিতে পিঁপড়েরা ক্রমাগত একে অপরের অ্যান্টেনাতে স্পর্শ করে। বিজ্ঞানীরা পিঁপড়ের অ্যান্টেনা থেকে এই রাসায়নিক তুলে দিয়ে দেখেছেন, সে আর নিজের বাসা খুঁজে পাচ্ছে না।
কখনও অন্য প্রজাতির পিঁপড়ে-সদস্যের সঙ্গে যুদ্ধে আহত হলে আহত সৈন্য কলোনিতে ফিরে আসে। সহকর্মীর সামনে আহত পিঁপড়ে প্রায় হাঁটু গেড়ে বসার ভঙ্গিমা করে। সহকর্মী শুশ্রূষা করে। এ প্রসঙ্গে পিঁপড়ে বিশেষজ্ঞ এরিক ফ্র্যাঙ্ক ২০১৭ সালে একটা চমৎকার পর্যবেক্ষণ করেছেন। আফ্রিকার সাহারা মরুভূমির কাছে মেটাবেল পিঁপড়েরা আহত সহকর্মীর ক্ষতস্থান অ্যান্টেনা আর ম্যান্ডিবল দিয়ে ধরে ক্ষতস্থান ‘চেটে’ দেয়। এতে অনেক ক্ষেত্রেই ক্ষত সেরে যায়।
শব্দ
সত্যজিৎ রায়ের ‘গোলক রহস্য’ গল্পে প্রফেসর শঙ্কু মাইক্রোসোনোগ্রাফ যন্ত্রে পিঁপড়ের ডাক শুনেছিলেন। যদিও কল্পবিজ্ঞান, তবুও হয়তো কোনও দিন পিঁপড়ের সৃষ্ট শব্দও আমরা শুনতে পাব। পিঁপড়েরা দেহের একাধিক অংশকে ঘষে এই শব্দ তৈরি করে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই পা দিয়ে উদরের শক্ত খোলকের উপর ঘষে। কখনও কখনও উদরে শক্ত স্পাইক বা কাঁটার মতো অংশ থাকে। এই ঘষা অনেকটা চিরুনি দিয়ে টেবিলে ঘষার মতো।
এই শব্দের মাধ্যমে যোগাযোগ বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে খুবই কাজের। যেমন, কোনও সুড়ঙ্গের ভিতরে কোনও সঙ্গী আটকে পড়লে শব্দ-সঙ্কেত ছাড়া পথ নেই। কারণ ফেরোমন সঙ্কেত তখন কাজে আসে না। সে শব্দ তখন অন্যদের কাছে এসওএস। স্যান্ডি অ্যান্ট তো এত সুন্দর শব্দ করে, যেন মনে হবে চড়াইপাখি কিচিরমিচির করছে। শক্তিশালী মাইক্রোফোনে সে শব্দ রেকর্ড করা হয়েছে। ইউটিউব ঘাঁটলে সে শব্দও শোনা যাবে।
আগে ধারণা ছিল, পিঁপড়ে পিউপারা শব্দ করতে পারে না। কথাটা আংশিক সত্য। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ওদের উদর অংশ নরম থাকে। তাই শব্দ তৈরি সম্ভব নয়। কিন্তু কোনও কোনও ক্ষেত্রে পিউপার উদরের শেষের দিকের অংশ শক্ত হয়ে গেলে পিউপাও ক্ষীণ শব্দ করতে পারে।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যোগাযোগের জন্য মানুষ অনেক জটিল যন্ত্র আবিষ্কার করেছে। অথচ মুখ দিয়ে শব্দ পর্যন্ত সৃষ্টি করতে পারে না যারা, সেই অতি ক্ষুদ্র মস্তিষ্কের এক আদিম প্রাণী তাদের মতো করে নিজেদের মধ্যের যোগাযোগ ব্যবস্থাকে যে অসামান্য পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছে, তা সত্যিই অবাক করার মতো।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy