Advertisement
২৩ নভেম্বর ২০২৪
vodafone tax

প্রণবের রেট্রোস্পেক্টিভ কর তত্ত্বে ধাক্কা, মোদী কি স্বস্তিতে

যে রেট্রোস্পেক্টিভ কর নিয়ে ভোডাফোন-ভারত সরকার বিরোধ এবং মামলা, ২০১২ সালের সাধারণ বাজেটে সেই করের প্রস্তাব রেখেছিলেন প্রণব মুখোপাধ্যায়।

আন্তর্জাতিক ট্রাইবুনালে মুখ থুবড়ে পড়ল প্রণববাবুর রেট্রোস্পেক্টিভ করের তত্ত্ব।

আন্তর্জাতিক ট্রাইবুনালে মুখ থুবড়ে পড়ল প্রণববাবুর রেট্রোস্পেক্টিভ করের তত্ত্ব।

নিজস্ব প্রতিবেদন
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২০ ১৬:০০
Share: Save:

জিতে গেল ভোডাফোন। আন্তর্জাতিক ট্রাইবুনালে গোহারা হারল ভারত সরকার। তবু আড়ালে বোধহয় খানিক স্বস্তির নিশ্বাসই পড়ল প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর।

এই আপাত-অদ্ভুত পরিস্থিতি বুঝতে পিছিয়ে যেতে হবে আট বছর।

যে রেট্রোস্পেক্টিভ কর নিয়ে ভোডাফোন-ভারত সরকার বিরোধ এবং মামলা, ২০১২ সালের সাধারণ বাজেটে সেই করের প্রস্তাব রেখেছিলেন সম্প্রতি প্রয়াত প্রণব মুখোপাধ্যায়। স্বয়ং মনমোহন সিংহের এতে আপত্তি ছিল। আশঙ্কা ছিল সনিয়া গাঁধী, পি চিদম্বরমদের মনেও। আইনজীবী হরিশ সালভে মন্তব্য করেছিলেন, ‘‘এটা বিদেশি বিনিয়োগের বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধ ঘোষণা। এর মূল্য চোকাতে হবে দেশবাসীকে।’’

প্রণববাবুর জীবদ্দশাতেই গড়াতে শুরু করেছিল মামলার জল। কিন্তু প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ও অর্থমন্ত্রীকে তাঁর অন্যতম বিতর্কিত সিদ্ধান্তের ভরাডুবি দেখে যেতে হয়নি। ঘটনাচক্রে, তাঁর মৃত্যুর মাসখানেকের মধ্যেই ভোডাফোন বনাম ভারত সরকার মামলায় আন্তর্জাতিক ট্রাইবুনালে মুখ থুবড়ে পড়ল প্রণববাবুর রেট্রোস্পেক্টিভ করের তত্ত্ব।

আরও পড়ুন:২০ হাজার কোটি নিতে পারবে না ভারত, আন্তর্জাতিক ট্রাইবুনালে জয় পেল ভোডাফোন

২০০৭ সালে ১,১০০ কোটি ডলারে হংকং-এর টেলিকম সংস্থা ‘হাচিসন হামপোয়া’র ৬৭ শতাংশ শেয়ার কিনে নেয় ব্রিটিশ টেলিকম সংস্থা ‘ভোডাফোন ইন্টারন্যাশনাল হোল্ডিংস’। ওই বছরই ‘ক্যাপিট্যাল গেন ট্যাক্স’ বা মূলধনী লাভের উপর কর বাবদ ৭,৯৯০ কোটি টাকা দেওয়ার জন্য ভোডাফোনকে নোটিস ধরায় ভারত সরকারের অর্থমন্ত্রক। পরবর্তীকালে কর না মেটানোয় জরিমানা ও সুদ মিলিয়ে সেই অঙ্ক দাঁড়ায় ২২,১০০ কোটি টাকা। কিন্তু ভোডাফোন কর্তৃপক্ষ তা দিতে অস্বীকার করে আদালতের দ্বারস্থ হন। তাঁদের যুক্তি ছিল, এই কর ধার্য করা ভারত-নেদারল্যান্ডসের দ্বিপাক্ষিক বিনিয়োগ চুক্তির পরিপন্থী। দীর্ঘ আইনি লড়াই শেষে ২০১২ সালের ২০ জানুয়ারি সুপ্রিম কোর্টের রায়ে জয় পায় টেলিকম সংস্থা।

আন্তর্জাতিক ট্রাইবুনালে ভারত সরকারের বিরুদ্ধে বড়সড় জয় ভোডাফোনের। ফাইল চিত্র।

কেন্দ্রে তখন দ্বিতীয় ইউপিএ সরকার। প্রধানমন্ত্রীর কুর্সিতে অর্থনীতিবিদ মনমোহন। তাঁর মন্ত্রিসভায় অর্থমন্ত্রী প্রণব। ওই বছরই বাজেট প্রস্তাবে রেট্রোস্পেক্টিভ কর, অর্থাৎ পুরনো লেনদেনের উপরেও কর চাপানোর প্রস্তাব দেন তিনি। ১৯৬১ সালের আয়কর আইন সংশোধনী পাশ হয় সংসদে এবং কার্যকর হয় রেট্রোস্পেক্টিভ ট্যাক্স। অর্থাৎ পুরনো বা আগে কোনও লেনদেন হলেও বর্তমান আইন অনুযায়ী তা করযোগ্য। ভারতে ব্যবসা চালানো কোনও সংস্থার শেয়ার হাতবদল হলে সরকারকে কর দিতে হবে। সেই সময়েই এই আইন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল আইনজীবী ও শিল্পপতি মহলের একাংশ। প্রকাশ্যে না এলেও কর্পোরেট জগতে এই লড়াই দীর্ঘদিনের।

আরও পড়ুন: কৃষি বিলের প্রতিবাদে রেল রোকো পঞ্জাবে, বিক্ষোভের আঁচ উত্তরপ্রদেশেও​

অন্যদিকে, সংশোধনী পাশ হয়ে আইনে পরিণত হতেই নতুন করে শুরু হয় ‘মাল্টিন্যাশনাল কর্পোরেট জায়ান্ট’ ভোডাফোনের সঙ্গে ভারত সরকারের সঙ্ঘাত। ভোডাফোন ও কেন্দ্রের সেই সময়ের একাধিক সূত্রে খবর, সংশোধনীর পরেও ভোডাফোন প্রথমে নমনীয় মনোভাবই দেখিয়েছিল। বিভিন্ন কূটনৈতিক ও কর্পোরেট লবিস্টের মাধ্যমে সরকারের সঙ্গে বোঝাপড়ার জন্য দৌত্য চালিয়েছিলেন ভোডাফোন কর্তৃপক্ষ। কিন্তু সরকারের অনমনীয় মনোভাবে সব চেষ্টা জলে যাওয়ার পর ২০১৪ সালে আন্তর্জাতিক ট্রাইবুনালের দ্বারস্থ হয় ভোডাফোন। প্রায় ছ’বছর শুনানির পর ট্রাইবুনাল জানিয়ে দিয়েছে, ভারত সরকারের করের দাবি অন্যায্য। এবং তা নয়াদিল্লি-আমস্টার্ডাম দ্বিপাক্ষিক চুক্তি-বিরোধী। টেলিকম সংস্থার কাছ থেকে কর আদায় তো করতে পারবেই না, উল্টে মামলার খরচের জন্য ভোডাফোনকে ৪০ কোটি টাকা গুনাগার দিতে হবে ভারত সরকারকে।

মোদী সরকার ক্ষমতায় আসার পরও এই বিতর্কিত করের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করেনি কেন? ফাইল চিত্র

সপ্তদশ শতকে চতুর্দশ কিং লুইয়ের শাসনকালে ১৬৬১ থেকে ১৬৮৩ সালে ফ্রান্সের ‘মিনিস্টার অব স্টেট’ ছিলেন বিখ্যাত রাজনীতিবিদ ও অর্থনীতিবিদ জিন ব্যাপটিস্ট কোলবার্ট। করব্যবস্থা প্রসঙ্গে তাঁর বিখ্যাত উক্তি ছিল, ‘‘কর শিল্প হল সেটা, যেটা রাজহাঁসকে সবচেয়ে কম ব্যথা দিয়ে সবচেয়ে বেশি পালক তুলে নিতে পারে।’’

প্রণব কি তবে রেট্রোস্পেক্টিভ সংশোধনী আনতে গিয়ে করব্যবস্থার সেই ভারসাম্যের ভিতটাই নড়বড়ে করে দিয়েছিলেন? শাসক-বিরোধী সকলের সঙ্গে প্রণবের সুসম্পর্ক থাকলেও অনেকে ঘনিষ্ঠমহলে বলে থাকেন, ভোডাফোনের বিরুদ্ধে করযুদ্ধকে কার্যত মর্যাদার লড়াই হিসেবে নিয়েছিল তৎকালীন ইউপিএ সরকার। তার মাশুল দিতে হয়েছে ভারতীয় অর্থনীতিকে।

রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়ার তথ্যই বলছে, ২০১২ সালে সংশোধনীর বছরে প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়েছিল বিদেশি বিনিয়োগে। ২০১০ সালে দেশে মোট ‘ফরেন ডিরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট’ (এফডিআই) বা প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ হয়েছিল ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় ৯৬ হাজার ১০ কোটি টাকা। সেটা এক লাফে বেড়ে ১ লক্ষ ৫৯ হাজার ৯৩০ কোটি টাকা হয়েছিল তার পরের বছর। অথচ সংশোধনীর বছরে তা কমে দাঁড়ায় ১ লক্ষ ২১ হাজার ৫৯০ কোটি টাকা। ভারতে এফডিআই-এর ইতিহাসে যা প্রায় নজিরবিহীন। শুধু তা-ই নয়, তার পরের বছরও এফডিআই বেড়েছিল খুব সামান্য। ওই বছর মোট এফডিআই-এর পরিমাণ ছিল ১ লক্ষ ২৯ হাজার ৪৯০ কোটি টাকা।

ঘটনাচক্রে ২০১৪ সালে কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসে বিজেপি-র নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোট। প্রধানমন্ত্রীর কুর্সিতে বসেন মোদী। ফের বাড়তে থাকে বিদেশি বিনিয়োগ। ওই বছর বিদেশি পুঁজিপতিদের ভারতে বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ১ লক্ষ ৭৫ হাজার ৩১০ কোটি টাকা। ২ লক্ষ ৫২ হাজার ২৫৬ কোটি টাকা এফডিআই ছিল পরের বছর, যা বৃদ্ধির নিরিখে দেড়গুণেরও বেশি। তার পর থেকে মোদী সরকারের প্রায় সাত বছরের জমানায় এফডিআই এক বছরই সামান্য কমেছিল— ২০১৯ সালে লোকসভা ভোটের বছরে। বিশেষজ্ঞদের ব্যাখ্যা, ভোটের জন্যই কমেছিল বিদেশি বিনিয়োগ। বাজার অর্থনীতিবিদদের অনেকেই মনে করেন, ২০১২-’১৩ সালে এফডিআই-এর নিম্নগতি বা সামান্য বৃদ্ধি কাকতালীয় নয়। বরং রেট্রোস্পেক্টিভ করের প্রত্যক্ষ প্রভাবে। সংশ্লিষ্ট মহলের একাংশ এমনটাও মনে করেন যে, ২০১২ সালের ওই সংশোধনী না হলে আরও বিপুল পরিমাণ বিদেশি বিনিয়োগে ভরে উঠত ভারতের রাজকোষ।

হেগ-এর আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতা ট্রাইবুনালের রায়ের পর শাসক পদ্মশিবির থেকে এখনও প্রত্যক্ষ ভাবে কোনও প্রতিক্রিয়া মেলেনি। তবে বিষয়টির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ভাবে জড়িত অর্থমন্ত্রকের একটি সূত্রের খবর, আরও বড় কোনও আইনি লড়াইয়ের ক্ষেত্র রয়েছে কিনা, তার সন্ধান না করে ট্রাইবুনালের রায় মেনে নিতে পারে কেন্দ্র। তাতে ভোডাফোনকে সামনে রেখে আন্তর্জাতিক শিল্প-বাণিজ্য ও পুঁজিপতিদের কাছে ‘সদর্থক বার্তা’ দেওয়া যাবে।

রেট্রোস্পেক্টিভ কর নিয়ে মনমোহন সিংহের আপত্তি ছিল। আশঙ্কা ছিল সনিয়া গাঁধীরও। ফাইল ছবি।

গালওয়ান উপত্যকায় ভারত-চিন সংঘর্ষ এবং তার পর লাদাখে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখায় উত্তেজনার জেরে শতাধিক চিনা অ্যাপ নিষিদ্ধ করেছে ভারত। তলানিতে নয়াদিল্লি-বেজিং দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক। ফলে থমকে গিয়েছে পাইপলাইনে থাকা লক্ষ লক্ষ কোটির চিনা বিনিয়োগ। করোনাভাইরাসের জেরে বিশ্ব অর্থনীতিও মন্দার গ্রাসে। এমন পরিস্থিতিতে ভোডাফোনের বিরুদ্ধে নতুন করে লড়াইতে ঝাঁপিয়ে, প্রতিকূল পরিস্থিতি আরও প্রতিকূল করার ঝুঁকি সরকার নেবে না বলেই ওয়াকিবহাল মহলের অভিমত।

আরও পড়ুন: ‘অপরাধ নয় যৌন পেশা’, মন্তব্য বম্বে হাইকোর্টের

প্রশ্ন উঠতে পারে, মোদী সরকার ক্ষমতায় আসার পরও এই বিতর্কিত করের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করেনি কেন? স্বয়ং প্রণবও এই প্রশ্ন রেখে গিয়েছেন। স্মৃতিকথায় তিনি লিখেছেন, ‘‘আমার প্রস্তাব নিয়ে দলের ভিতরে-বাইরে ক্ষোভ সত্ত্বেও আমি বিস্মিত যে, আমার পরবর্তী অর্থমন্ত্রীরাও একই অবস্থানে থেকেছেন।’’

আরও পড়ুন: ২৮ অক্টোবর থেকে তিন দফায় ভোট বিহারে, ফলাফল ১০ নভেম্বর

এর উত্তর সম্ভবত লুকিয়ে রাজনীতির মধ্যে। মোদী তথা বিজেপি নেতৃত্ব একদিকে যেমন দেশে বিদেশি পুঁজির বিনিয়োগের বাধা দূর করার ব্যাপারে উদ্যোগী, তেমনই দলের গায়ে বিদেশি পুঁজির সঙ্গে বেশি মাখামাখির তকমা লাগতে দিতেও নারাজ। ফলে ‘সাপও মরুক লাঠিও না ভাঙুক’ ইচ্ছে নিয়েই ছিল সরকার। ট্রাইবুনালের রায় সেদিক থেকে ৭, রেসকোর্স রোডে বোধহয় খানিক সুপবনই বইয়ে দিয়ে গেল।

অন্য বিষয়গুলি:

Retrospective taxation Pranab Mukherjee Vodafone
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy