সলাজার’স পিট ভাইপার— ফাইল চিত্র।
হিলহিলে সাপটির গায়ের রঙ কচিপাতার মতো সবুজ। শরীরে সামান্য লালের ছোঁয়া। সাপটি দেখে জীবনবিজ্ঞানের গবেষকদের হ্যারি পটার উপন্যাসের সলাজার স্লিদারিংয়ের বশ-করা সবুজ বিষধর সাপের কথা মনে পড়েছে। জে কে রাওলিংয়ের উপন্যাসে হগওয়ার্টের প্রফেসর সলাজার নাকি ওই সাপের সঙ্গে কথা বলতেন।
গল্পকথার সাপটি কি এবার খুঁজে পাওয়া গেল অরুণাচল প্রদেশের জঙ্গলে? তা হলে কি বাস্তবে রয়েছে সাপটি? তবে বাস্তবের এই সাপ বশ মানে না। কাছে গেলেই হিস হিস করে ওঠে। ছোবল মারলেই ভবলীলা সাঙ্গ। মারাত্মক বিষ নিমেষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে শরীরে। মস্তিষ্কের কাজ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাবে। কেউটে, গোখরো, শঙ্খচূড়েরর মতো এই সাপ ‘কোবরা’ গোত্রের নয়। ভাইপার গোত্রের। ভাইপারদের বিষ যেমন ভয়ঙ্কর, তেমনই উত্তাপ বোঝার ক্ষমতাও নিখুঁত। এদের চোখ আর নাকের মাঝামাঝি ছোট্ট গর্তের (পিট) মতো সংবেদী স্নায়ু আছে। যার সাহায্যে যে কোনও প্রাণীর দেহে উষ্ণ রক্তের চলাচল বুঝলেই ছোবল বসায়। রাওলিং তাঁর বর্ণনায় সাপের বৈজ্ঞানিক নাম জানাননি। শুধু চেহারার বিবরণ দিয়েছেন। হুবহু সেই চেহারার সবুজ সাপটিরই ছবি উঠেছে সমীক্ষকদের ক্যামেরায়। সিনেমার চেয়েও দেখতে সুন্দর বাস্তবের সাপটি।
অরুণাচলের বন দফতরের এক পদস্থ কর্তা জানাচ্ছেন, বিজ্ঞানীরা নতুন এই সাপের প্রজাতির নাম রেখেছেন ‘সলাজার পিট ভাইপার’। বৈজ্ঞানিক পরিভাষায় নাম ‘ট্রিমেরিসোরাস সলাজার’।
২০১৯ সালের জুলাইয়ে বেঙ্গালুরুর ন্যাশনাল সেন্টার অফ বায়োলজিক্যাল সায়েন্স এবং বম্বে ন্যাচারাল হিস্ট্রি সোসাইটির একদল সমীক্ষক অরুণাচলের পাক্কে ব্যাঘ্র প্রকল্পে গিয়েছিলেন নতুন প্রজাতির বন্যপ্রাণীর সন্ধানে। দু’টি প্রজাতির কচ্ছপ-সহ বেশ কয়েকটি সরীসৃপের নমুনা সংগ্রহ করে নিয়ে যান তাঁরা। তার মধ্যেই ছিল সবুজ ওই সাপটি। ওই ধরনের সাপের বিভিন্ন গোত্রের সঙ্গে মিলিয়ে দেখে বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত হন যে, এটি একটি নতুন প্রজাতি। আন্তর্জাতিক সাময়িকীতে এই আবিষ্কারের কথা প্রকাশ হতেই হইচই পড়ে যায়। তার আরও একটি কারণ, সাপটির নাম ‘ট্রিমেরিসোরাস সলাজার’। যে নামকরণে অমর হয়ে গেল রাওলিংয়ের তৈরি চরিত্র জাদুবিদ্যায় পারদর্শী সলাজারও।
মাইক্রোহাইলা ইওস
সমীক্ষকেরা ছ’টি রাত ওই গহন অরণ্যে কাটিয়েছেন নতুন প্রজাতির প্রাণী খোঁজার আশায়। সেই সময়ে সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ১০টার মধ্যে পথের ধারে ঝোপের মধ্যে দেখা যায় তিনটি সালাজার ভাইপার। দু’টিকে তাঁরা নমুনা হিসেবে সঙ্গে করে নিয়ে যান। একটি ঝোপের আড়ালে এমন ভাবে গা ঢাকা দেয় যে, তাকে আর দেখাই দেয়নি। ভারতে ২২ ধরনের সবুজ পিট ভাইপার্স রয়েছে। এটি যে তাদের কোনও গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত নয়, তা বোঝা গিয়েছে। সবুজ পিট ভাইপার্স সাপের বংশের এই সাপটির মাথা ও শরীরে ইটের রংয়ের লাল বা কমলা স্ট্রাইপ রয়েছে। ডিএনএ পরীক্ষা করে দেখা গিয়েছে, এটি সাপের একটি নতুন প্রজাতি। গবেষক জিশান এস মির্জা, হর্ষল ভোঁসলে, পুষ্কর ফানসালাকার, মন্দার সাওয়ান্ত, গৌরাঙ্গ গোওয়ান্দে এবং হর্ষিল পটেল অরুণাচলের জঙ্গল থেকে কিছু অজ্ঞাত প্রাণীর নমুনা সংগ্রহ করেন। তার মধ্যেই পাওয়া যায় এই সাপটি। ‘জু সিস্টেম্যাটিক অ্যান্ড ইভোলিউশন’ পত্রিকায় গবেষণা সংক্রান্ত বিশদ তথ্য প্রকাশিত হতেই সোরগোল পড়েছে।
আরও পড়ুন: ‘প্রথমে ভেবেছিলাম নির্বিষ সাপ, ফণা তুলতেই...’, ১৫ ফুটের শঙ্খচূড় সাপকে ঘিরে আতঙ্ক নাগরাকাটায়
শুধু এই সাপের প্রজাতিই নয়, সম্প্রতি অরুণাচল প্রদেশের নামধাপা জাতীয় উদ্যানের জঙ্গলে পাওয়া গিয়েছে এক প্রকার নতুন উভচর প্রাণী। নতুন এক ধরনের ব্যাঙ। জুওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া ও দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞান বিভাগের গবেষকরা ওই জঙ্গলে সূচলো মুখের একটি প্রজাতি খুঁজে পান। শুধু শরীরের গড়নই নয়, সেটির ডিএন-এর নমুনা অন্য ব্যাঙের প্রজাতির সঙ্গে মিলিয়ে দেখে গবেষকেরা নিশ্চিত হন, এটি সম্পূর্ণ নতুন প্রজাতির ব্যাঙ। অরুণাচলের নামে ভৌগোলিক ব্যাখ্যা লুকিয়ে আছে। ভারতে প্রথম সূর্য ওঠে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ওই রাজ্যে। নামকরণের সময় সেটাই গুরুত্ব পেয়েছিল। সেইমতোই ব্যাঙের প্রজাতিটির নাম রাখা হয়েছে ‘ইওস’। গ্রিসের উষাকালের দেবী। পুরো নাম ‘মাইক্রোহাইলা ইওস’। সূ্চলো মুখের ব্যাঙেদের গোত্র হল ‘মাইক্রোহাইলা’। সেই গোত্রের নবতম সদস্য এই ‘ইওস’। গত বছর সেপ্টেম্বরে ‘জুট্যাক্সা জার্নালে’ প্রকাশিত হয় আবিষ্কারের কাহিনি। তারপরেই জীবজগতের পরিচয়পত্রের তালিকায় ঢুকে পড়েছে এই ব্যাঙ।
আরও পড়ুন: কোদালের কোপে নিকেশ মা কেউটে, ডিম ফুটিয়ে শিশুদের ‘পুনর্বাসন’ হুগলিতে
জীববিজ্ঞানী ও বিজ্ঞান গবেষকেরা বলছেন, অরুণাচল ও অসমের নর্থ কাছাড় পার্বত্য এলাকার জঙ্গলে এখনও সে ভাবে ‘উন্নয়নের কুফল’ পৌঁছতে পারেনি। পর্যটকদের যাওয়া-আসাও সীমিত। তাই খুঁজলে আরও নতুন নতুন সরীসৃপ, উভচর এবং পতঙ্গের নমুনা পাওয়া যেতে পারে ওই এলাকায়। তবে অরুণাচলে যে ভাবে নতুন দু’টি জাতীয় সড়ক তৈরির পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে, তাতে পাক্কে জাতীয় উদ্যানের বেশ কিছু জমি অধিগ্রহণ করা হবে। জঙ্গলের মধ্যে ঢুকবে ভারী ভারী যন্ত্র, খাটানো হবে তাঁবু, রাতে জ্বলবে আলো। এক গবেষকের কথায়, ‘‘সালাজার পিট ভাইপার প্রজাতিটিকে খুঁজে পেতে টানা ছ’দিন আমাদের রাতবিরেতে জঙ্গলে অতি সন্তর্পণে ঘুরে বেড়াতে হয়েছে। দেখা মিলেছে মাত্র তিনটির। ওরা সহজে দেখা দেয় না। এখন জঙ্গল ফুঁড়ে রাস্তা তৈরি হলে অবাক করা ওই সব প্রাণীর বাসস্থান নষ্ট হয়ে যাবে না তো? আর কি দেখা মিলবে ওদের?’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy