ছবি রয়টার্স।
প্রণব মুখোপাধ্যায়, আমাদের সকলের প্রণবদার মৃত্যুতে দেশের রাজনীতিতে একটা শূন্যস্থান তৈরি হল। শেষ হল সংসদ থেকে সরকারে গুরুত্বপূর্ণ পদে কাজের দীর্ঘ পাঁচ দশকের রাজনৈতিক জীবন।
উনি যখন প্রথম রাজ্যসভায় পা রাখেন, আমি তখন স্কুলে পড়ি। বয়স ও অভিজ্ঞতায় প্রবীণ হলেও অপেক্ষাকৃত তরুণদের তাচ্ছিল্য করতেন না। আমার নিজের ক্ষেত্রে বলতে পারি, সব সময়েই এমন ভাবে কথা বলেছেন, যেন আমি ওঁরই সমবয়সি কেউ। মতভেদ ছিল। তা বলে বিদ্বেষ প্রকাশ করেননি।
সত্তরের দশক থেকেই প্রণবদার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ভাবে লড়তে হয়েছে। জরুরি অবস্থার সময় তো উনি ইন্দিরা গাঁধীর আস্থাভাজন মন্ত্রী। তার পরে চার দশক ধরে সেই মতবিরোধ বজায় থেকেছে। বাণিজ্যমন্ত্রী হিসেবে উনি যখন ডব্লিউটিও তৈরিতে দর কষাকষি করছেন, ভারত ডাঙ্কেল চুক্তির খসড়াকে সমর্থনের দিকে এগোচ্ছে, তখন সংসদে না-থাকলেও রাজনৈতিক ভাবে ওঁর বিরোধিতা করতে হয়েছে। আমরা যখন দিল্লির রাস্তায় প্রতিবাদ করছি, উনি তখন ডব্লিউটিও তৈরিতে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করছেন।
বাজপেয়ী সরকারের আমলে ওঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ভাবে মেশার সুযোগ হয়। ২০০৪-এর লোকসভা নির্বাচনে এনডিএ সরকারকে হারাতে সমস্ত ধর্মনিরপেক্ষ দলকে এককাট্টা করার কাজের সূত্রে। সে বার লোকসভার সঙ্গেই ছিল অন্ধ্রপ্রদেশের বিধানসভা নির্বাচন। আসন সমঝোতা নিয়ে আলোচনায় প্রণবদা কংগ্রেসের প্রতিনিধি দলের নেতৃত্বে ছিলেন। এ রকমই একটা বৈঠকের সময়ে এক দিন হঠাৎ এক পাশে টেনে নিয়ে গিয়ে ওঁর লোকসভা ভোটে লড়া ঠিক হবে কি না, তা নিয়ে আমার মতামত চাইলেন। তার আগে উনি কখনও লোকসভায় সাংসদ হিসেবে জিতে আসেননি। মনে আছে, প্রথমটায় কিছু বলতে চাইনি। ওঁর মতো কাউকে এ বিষয়ে উপদেশ দেওয়াটা ঠিক হবে না বলে এড়িয়ে যাচ্ছিলাম। উনি কিন্তু জোর করলেন। বললাম, জেতার ব্যাপারে নিশ্চিত হলে তবেই লড়ুন। সে বারের ভোট খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। বিজেপি-কে হারাতে আমরা সবাই মিলে কাজ করছিলাম। প্রণবদা হারলে ভুল বার্তা যেত।
শেষ পর্যন্ত প্রণবদা জঙ্গিপুর থেকে লড়লেন। এবং জিতলেনও। ইউপিএ জোট সরকারের প্রধান ‘পয়েন্টসম্যান’ হিসেবে উঠে এলেন। ইউপিএ সরকারে প্রণবদা ছিলেন অপরিহার্য। জোট শরিকদের সঙ্গে সমন্বয়ের প্রতিটি কমিটিতে ছিলেন। ইউপিএ-বাম সমন্বয় কমিটি তো বটেই। তার পরে ভারত-মার্কিন পরমাণু চুক্তিতে বামেদের বিরোধিতার জেরে তৈরি কমিটিতেও।
উনি বরাবর বলতেন, আমার সংসদে আসা উচিত। ২০০৫-এ পার্টির কথায় যখন রাজ্যসভায় গেলাম, প্রণবদা যে ভাবে অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন, অভিভূত হয়ে গিয়েছিলাম। সংসদের কাজকর্ম তখন কিছুই জানি না। গুরুত্বপূর্ণ টিপস দিলেন। তার পর থেকে ওঁর রাষ্ট্রপতি হওয়া পর্যন্ত প্রায় রোজই কথাবার্তা হত। তার বেশির ভাগ জুড়েই অবশ্য থাকত মতবিরোধ। সংসদের ভিতরেও। আর বাইরে ইউপিএ-বাম সমন্বয় কমিটিতে।
এক বার, ২০০৮-এর বিশ্ব জুড়ে আর্থিক মন্দা থেকে ভারতকে আগলে রাখার সাফল্য দাবি করে প্রণবদা রাজ্যসভায় বললেন, ইন্দিরা গাঁধীর ব্যাঙ্ক জাতীয়করণের জন্যই দেশের ব্যাঙ্ক ও আর্থিক ব্যবস্থা বেঁচে গেল। ঘটনাটা ২০০৮-এ পরমাণু চুক্তির বিরোধিতা করে বামেদের সমর্থন প্রত্যাহারের ঠিক পরে-পরে। আমি ওঁর বক্তৃতার মাঝখানে বাধা দিয়ে একটা কথা বলতে চাইলাম। উনি অম্লানবদনে সুযোগ দিলেন। সংসদে এই রকম শিষ্টাচার ও পারস্পরিক সম্মান এখন অতীত। বললাম, ভি ভি গিরিকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে সমর্থনের বিনিময়ে বামেরা ইন্দিরা গাঁধীর সামনে ব্যাঙ্ক জাতীয়করণের শর্ত রেখেছিল। তার সঙ্গে কয়লা ক্ষেত্রের জাতীয়করণের শর্তও ছিল। প্রণবদার ছিল হাতির মতো স্মৃতিশক্তি। ওঁর সেই আলোচনার খুঁটিনাটি মনে ছিল। আমিই বরং খুব সামান্য জানতাম। উনি বললেন, বামেরা আরও একটা দাবি জানিয়েছিলেন। তা হল, প্রিভি পার্সের অবসান। তত দিন পর্যন্ত আমার ধারণা ছিল, ওই দাবি অন্য কারও ছিল।
মনে আছে, সে দিন বলেছিলাম, কংগ্রেস বামেদের পরামর্শ মেনে চললে শুধু সরকারের লাভ হয়নি, দেশেরও লাভ হয়েছে। দুর্ভাগ্যবশত, পরমাণু চুক্তিতে তা হয়নি। সংসদের বিতর্কে হাসিঠাট্টা হত। বাদানুবাদও। কিন্তু রাজনীতিতে অনেক তরুণ এক জনের সঙ্গে যুঝতে গিয়েও প্রণবদা কখনও এক মিনিটের জন্য মেজাজ হারাননি। তর্কবিতর্কের সংস্কৃতিতে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে সবাইকে সমান ভাবে দেখার শিষ্টাচার মেনে চলতেন।
রাষ্ট্রপতি হিসেবে প্রণবদার প্রথম সফর ছিল বাংলাদেশে। ওঁর স্ত্রী শুভ্রা ছিলেন অবিভক্ত বাংলার ও-পার থেকে আসা পরিবারের। বাংলাদেশের জামাই হিসেবে প্রণবদা সাদর অভ্যর্থনা পেয়েছিলেন। সেই রাষ্ট্রীয় সফরে আমি ওঁর সঙ্গী ছিলাম। বাংলা ও তার সংস্কৃতি, দেশভাগ ও তার যন্ত্রণা সম্পর্কে ওঁর আশ্চর্যরকম জ্ঞান ছিল। উনি ছিলেন বাঙালির সংস্কৃতি ও জীবনযাত্রার সঙ্গে গভীর ভাবে জড়িয়ে থাকা এক জন মানুষ। প্রতি বছর পুজোয় নিজের গ্রামের বাড়িতে যেতেন। নিজের ধর্মীয় বিশ্বাস ও পুজোর সঙ্গে জড়িয়ে থাকা সংস্কৃতিই ছিল এর কারণ।
নস্টালজিয়ায় ভেসে ওঠে গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পৈতৃক ভিটে জোড়াসাঁকোতে একসঙ্গে যাওয়ার কথা। রবীন্দ্রনাথের জীবন, কাজকর্ম সম্পর্কে অনেক অজানা গল্প বলেছিলেন। বাংলাদেশে গিয়েও ওখানকার অফিসারদের জোর দিয়ে বলেছিলেন, তাঁরা যেন আমাদের সেই নির্জনে বসে রবীন্দ্রনাথের লেখালেখির ঠিকানা, নদীর তীরে রাখা হাউসবোটটি দেখাতে নিয়ে যান।
এমন আরও অজস্র গল্প বলে যেতে পারি। সে সব না হয় ভবিষ্যতের জন্য যত্নে রাখা থাক।
প্রণবদার অভাব টের পাব। প্রণবদা উইল বি মিসড!
লেখক সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy