ফাইল চিত্র।
বিরোধীরা খড়্গহস্ত। সমালোচনার ঝড় সোশ্যাল মিডিয়ায়। ছাত্র-রাজনীতিতে প্রতিবাদের ঢেউ। আর চায়ের কাপে তুফান। সিবিএসই-র সিলেবাস ছাঁটাই ঘিরে বুধবার দিনভর সরগরম যুক্তি-তর্কের প্রায় সমস্ত পরিসর।
বিশেষজ্ঞদের একাংশের অভিযোগ, শাসক দলের ভাবাদর্শ কম বয়স থেকে পড়ুয়াদের মনে গেঁথে দিতে যে-যে পাঠ আগে ভোলানো জরুরি, সেগুলিই ছাঁটাই করা হয়েছে পাঠ্যক্রম থেকে। কিন্তু সিবিএসই-র পাল্টা দাবি, এই ‘বাদ পড়া’ নিছকই সাময়িক। শুধুমাত্র ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের জন্য। তা-ও করা হয়েছে পড়ুয়াদের ঘাড় থেকে পড়ার বোঝা কমাতে। তা ছাড়া, এই সমস্ত বিষয়কে পরীক্ষার আওতার বাইরে রাখলেও ক্লাসে তা পড়ানো কিংবা আলোচনায় বাধা নেই। বরং তাদের উল্লেখ রয়েছে এনসিইআরটি-র তৈরি বিকল্প শিক্ষা নির্ঘণ্টে। তাই সংবাদমাধ্যম বিষয়টির ভুল ব্যাখ্যা করছে বলে তাদের দাবি।
কিন্তু বিতর্ক থামছে কোথায়? মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘করোনা-সঙ্কটের এই সময়ে সিবিএসই-র পাঠ্যক্রম কমাতে গিয়ে নাগরিকত্ব, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো, ধর্মনিরপেক্ষতা, দেশভাগের মতো বিষয় কেন্দ্র বাদ দিয়েছে জেনে আমি স্তম্ভিত। আমরা এর ঘোর বিরোধিতা করছি। আর্জি জানাচ্ছি, কোনও মূল্যেই তা বাদ না-দিতে।” কংগ্রেসের রণদীপ সিংহ সুরজেওয়ালার কটাক্ষ, ‘‘যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো, নাগরিকত্ব, ধর্মনিরপেক্ষতার মতো বিষয় বাদ দিয়ে কি শেষ পর্যন্ত শুধু নোট বাতিল সম্পর্কে পড়ানো হবে?’’ হিসেবে একটু ‘ভুল’ হল। দ্বাদশ শ্রেণির বিজনেস স্টাডিজ থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে নোটবন্দির কথাও! একাদশ শ্রেণির পাঠ্যক্রম থেকে বাদ পণ্য-পরিষেবা কর বা জিএসটি! সোশ্যাল মিডিয়ায় কটাক্ষ, যাকে কিছু দিন আগেও নিজেদের অন্যতম বলিষ্ঠ সংস্কার বলে মোদী সরকার দাবি করত, তার উপরেও কোপ! তবে কি নোটবন্দি আর তড়িঘড়িতে চালু জিএসটি অর্থনীতির কোমর ভেঙে দিয়েছে বুঝেই নতুন প্রজন্মকে তার থেকে দূরে রাখতে মরিয়া কেন্দ্র? অনেকে মনে করাচ্ছেন, সম্প্রতি ২০ লক্ষ কোটি টাকার আর্থিক প্যাকেজ ঘোষণার সময়েও সংস্কারের তালিকায় নোটবন্দির কথা উচ্চারণ করেননি অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন। জেএনইউয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক জয়তী ঘোষের কথায়, “নোট বাতিলে যে অর্থনীতির সর্বনাশ হয়েছে, তার প্রমাণ প্রায় সমস্ত পরিসংখ্যানেই। নিজেদের ভাবাদর্শ পড়ুয়াদের মনে গেঁথে দেওয়া বা অপ্রিয় বিষয় তাদের চোখের সামনে থেকে সরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা এই শাসকের দীর্ঘ দিনের। তা কার্যকর করতে করোনা-সঙ্কটকে দু’হাতে কাজে লাগাচ্ছে তারা।”
সিবিএসই-র বাদ যাওয়া বিষয়
দ্বাদশ শ্রেণির বিজনেস স্টাডিজ
• ব্যবসার পরিবেশ (নোট বাতিল সম্পর্কে ধারণা)
দ্বাদশ শ্রেণির অর্থনীতি
• ভারতীয় অর্থনীতির সামনে চ্যালেঞ্জ (দেশে শিক্ষা ক্ষেত্রের বৃদ্ধি)
দ্বাদশ শ্রেণির সমাজবিদ্যা
• ভারতে সামাজিক পরিবর্তন ও উন্নয়ন (ভারতে গণতন্ত্রের আখ্যান, জন-সংযোগ মাধ্যম ও যোগাযোগ)
দ্বাদশ শ্রেণির আইন
• ভারতে মানবাধিকার (ভারতে মানবাধিকারের ইতিহাস)
দ্বাদশ শ্রেণির রাষ্ট্রবিজ্ঞান
• আঞ্চলিক আকাঙ্ক্ষা
• সামাজিক এবং নয়া সামাজিক আন্দোলন
• পরিবেশ ও প্রাকৃতিক সম্পদ
• পরিকল্পিত উন্নয়ন (যোজনা কমিশন ও পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা)
• ভারতের বিদেশ নীতি (প্রতিবেশী দেশগুলির সঙ্গে সম্পর্ক)
দ্বাদশ শ্রেণির ইতিহাস
• দেশভাগ
একাদশ শ্রেণির বিজনেস স্টাডিজ
• অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য (পণ্য-পরিষেবা কর বা জিএসটির ধারণা)
একাদশ শ্রেণির অর্থনীতি
• বাজারের ধরন ও দাম নির্ণয় (একচেটিয়া বাজার, একচেটিয়া বাজারে প্রতিযোগিতা)
একাদশ শ্রেণির মনস্তত্ত্ব
• ভাবনা
• প্রেরণা ও আবেগ
একাদশ শ্রেণির ইংরেজি
• লেখা (বায়োডেটা-সহ চাকরির আবেদন)
একাদশ শ্রেণির রাষ্ট্রবিজ্ঞান
• যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো
• নাগরিকত্ব
• ধর্মনিরপেক্ষতা
• স্থানীয় প্রশাসন (কেন প্রয়োজন এবং স্থানীয় প্রশাসনের বিকাশ)
দশম শ্রেণির সমাজবিজ্ঞান
• গণতন্ত্র এবং বৈচিত্র
• লিঙ্গচেতনা, ধর্ম ও জাতিভেদ
• গণ আন্দোলন
• গণতন্ত্রের চ্যালেঞ্জ
নবম শ্রেণির সমাজবিজ্ঞান
• গণতান্ত্রিক অধিকার
• খাদ্য নিরাপত্তা
* তালিকা আংশিক
আরও পড়ুন: পরীক্ষা নিতে স্বাস্থ্যবিধিও দিল ইউজিসি
শিক্ষাবিদ তথা দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ডিন অনিল সদগোপালও বলছেন, “এই পাঠ্যক্রম ছাঁটাই কেন্দ্রের শাসক দলের ভাবাদর্শ এবং মানসিকতারই প্রতিফলন। এই সরকার যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর নিয়ম মেনে ক্ষমতা ভাগে আগ্রহী নয়। নিজেদের ধর্মনিরপেক্ষ প্রমাণ করার দায় হিন্দু-রাষ্ট্রের ধ্বজাধারী দলের নেই। সিএএ-এনআরসির মাধ্যমে নাগরিকত্ব, গণতন্ত্রকে দুমড়ে-মুচড়ে দিতে চায় তারা। তাই ওই সমস্ত বিষয় পড়ুয়াদের জানা জরুরি বলে মনেই করে না।” সিবিএসই-কে এ ভাবে ঠিক এই বিষয়গুলি বাদ দিতে মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক চাপ তৈরি করেছে কি না, প্রশ্ন উঠছে তা নিয়েও।
বিরোধিতায় নেমেছে এসএফআই, এআইএসএ-র মতো ছাত্র সংগঠনগুলিও। তাদের প্রশ্ন, পাঠ্যক্রমের বোঝা এ ভাবে কমানোর বদলে শিক্ষাবর্ষের সময় বাড়ানো যেত না? যদি বাদ দিতেই হয়, পুরো পরিচ্ছেদ কেন? প্রত্যেক পরিচ্ছেদ থেকে কিছু-কিছু অংশ বাদ দেওয়ার সুযোগ ছিল না? অনেকে আবার কৌতুকে বিঁধেছেন সরকারকে। সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রশ্ন উঠেছে, অর্থনীতি থেকে একচেটিয়া বাজারের প্রসঙ্গও গায়েব। কেন? শাসক দলের ঘনিষ্ঠ কিছু শিল্পপতি সেই সুযোগ পাচ্ছেন বলে? কারও আবার জিজ্ঞাসা, মনস্তত্ত্বের পাঠ্যক্রমে যদি ভাবনার পরিচ্ছেদই বাদ পড়ে, তা হলে আর রইল কী? কেউ আবার জবাবে বলেছেন, আসলে পড়ুয়াদের ভাবনার জায়গাতেই তো আগে কুড়ুল মারতে চায় সরকার! পাঠ্যক্রম ছাঁটাইয়ে ফের প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছেন হীরক রাজা। ‘মগজ ধোলাইয়ের’ শুরু তো শিক্ষার উঠোন থেকেই!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy