অলঙ্করণ: শৌভিক দেবনাথ
‘পাপ্পু’ বনাম ‘ফেকু’। ‘সাহাবজাদা’ নাকি ‘৫৬ ইঞ্চি’। ‘রাহুল বাবা’র বিরুদ্ধে ‘এনআরআই প্রধানমন্ত্রী’ কিংবা ‘জ্ঞান কি বাত’ এবং ‘পাপ্পু পাস হো গ্যায়া’!
কোন দু’জনকে নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ার এই লড়াই, তার উত্তর দেওয়ার জন্য কোনও পুরস্কার নেই। কিন্তু ই-রাজনীতিতে কে এগিয়ে কে পিছিয়ে তা নিয়ে বিতর্কের অবকাশ রয়েছে। তথ্য পরিসংখ্যানের চুলচেরা বিশ্লেষণে না গিয়েও বলা যায়, নেট দুনিয়ায় উপস্থিতি বেশি নরেন্দ্র মোদীর। জনপ্রিয়তা বাড়ছে রাহুল গাঁধীর। ক্রিকেটের পরিভাষায় বলা যায়, স্ট্রাইক রেট বেশি রাহুলের।
নজর দেওয়া যাক দু’জনের নেট দুনিয়ায় অভিষেকের দিকে। এটা প্রতিষ্ঠিত যে, প্রধানমন্ত্রী সোশ্যাল মিডিয়া বিপ্লবের শুরুর দিকের সৈনিক। বরাবরই তিনি ফেসবুক-টুইটারে সড়গড়। সামাজিক কোনও উৎসব-অনুষ্ঠানে শুভেচ্ছা বার্তা, জন্মদিনের শুভেচ্ছা, সরকারি কর্মসূচির প্রচার, সবেতেই তাঁর সরব উপস্থিতি। গত লোকসভা ভোটের আগে মোদীকে ঘিরে বিজেপির প্রচার তুঙ্গে ওঠে। প্রতিটি কর্মসূচির খবর, তথ্য, সময়সূচি—সব কিছুই তখন ফেসবুক-টুইটার ইনস্টাগ্রামে ভেসে উঠত হরবখত। ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী হলেন । তার পর থেকে আরও বেড়ে গিয়েছে মোদীর সোশ্যাল তৎপরতা।
আগে উপস্থিতির জন্য ফলোয়ারের দিক থেকে রাহুলকে অবশ্যই টেক্কা দিয়েছেন মোদী। প্রধানমন্ত্রীর ধারে-কাছে নেই কংগ্রেস সভাপতি।
অন্য দিকে কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গাঁধীর প্রবেশ আরও অনেক পরে। ২০১৫ সালের আগে পর্যন্ত সোশ্যাল মিডিয়ায় সে ভাবে কংগ্রেসের উপস্থিতিই ছিল না। একমাত্র শশী তারুর ছাড়া কারও টুইট, ফেসবুক পোস্ট চোখে পড়ত না। সেই সময়ই টুইটারে আবির্ভাব ঘটে রাহুলের। আবার ময়দানে নামার পরও টেস্ট ইনিংসের মতো ধরে ধরে খেলতে শুরু করেন তিনি। এখনও যে ওয়ান ডে-র মেজাজে খেলেন, তেমন নয়। তবে কার্যক্রম বেড়েছে।
আরও পড়ুন: যে কোনও কম্পিউটারে চালানো যাবে নজরদারি, নয়া নির্দেশিকা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের
ফলোয়ার, কমেন্ট, রিটুইট, রিঅ্যাকশন, লাইক— নেটিজনদের কাছে এগুলির অপরিসীম গুরুত্ব। কে কতটা জনপ্রিয়, এগুলি কার্যত তার এক একটি একক। তর্ক থাকতে পারে ফেক অ্যাকাউন্ট নিয়ে। কিন্তু মোটের উপর ভিত্তি এগুলিই। আগে উপস্থিতির জন্য ফলোয়ারের দিক থেকে রাহুলকে অবশ্যই টেক্কা দিয়েছেন মোদী। প্রধানমন্ত্রীর ধারে-কাছে নেই কংগ্রেস সভাপতি। শুধু তাই নয়, এক্ষেত্রে মোদীর জনপ্রিয়তা রীতিমতো ঈর্ষণীয়, প্রায় চার কোটি ৭৭ লক্ষ। সারা বিশ্বের প্রধানমন্ত্রীদের তালিকায় টুইটারের ফলোয়ারে বিশ্বের মধ্যে তিনি পঞ্চম। রাহুল সেখানে তালিকাক্রমেই ঢুকতে পারেননি। তাঁর ফলোয়ার প্রায় ৮০ লক্ষ ৮০ হাজারের কাছাকাছি। আবার টুইটের সংখ্যাতেও মোদীর ধারেকাছে পৌঁছতে পারেননি। ২০১৭-র জানুয়ারি থেকে ২০১৮-এর ডিসেম্বর পর্যন্ত দু’বছরের হিসেবে কখনওই মোদীকে টপকাতে পারেননি রাহুল। এবং মোদী সব সময়ই অনেক ব্যবধানে এগিয়ে মোদী।
সোশ্যাল মিডিয়ায় এই অ্যাকটিভিটিকে বলা যেতে পারে ‘এনগেজমেন্ট’। এই ক্ষেত্রেই মোদীকে টেক্কা দিয়েছেন রাহুল। দু’জনের মধ্যে এই দু’বছরের এনগেজমেন্টের গ্রাফ করলে দেখা যাচ্ছে, রিপ্লাই, রিটুইট এবং লাইক— তিনটির চরিত্র প্রায় কাছাকাছি। ২০১৭-র শুরুতে রাহুলের গ্রাফ বেশ খানিকটা নীচে। কিন্তু সেটাই ওই বছরের অগস্ট-সেপ্টম্বরে মোদীকে টপকে গিয়েছেন রাহুল। তার পর সময় যত গড়িয়েছে, মোদীর চেয়ে রাহুলের টুইটের এনগেজমেন্ট উপরের দিকে উঠেছে। কমেছে মোদীর। এবং বাড়তে বাড়তে এখন সেই গ্রাফে মোদীর অনেক উপরে রাহুল গাঁধী। রিটুইটে যেমন মোদীর গ্রাফ গড়ে ২০০০ থেকে ২৫০০-র ঘরে। রাহুলের সেখানে ৬০০০ থেকে ৬৫০০-র মধ্যে। রিপ্লাইয়ে রাহুল ২৫০০ থেকে ৩০০০ এর মধ্যে, মোদী ৫০০ থেকে ১০০০। লাইক-এ মোদী ১০ থেকে ১৫ হাজারের মধ্যে, রাহুলের অবস্থা ২০ থেকে ২৫ হাজারে।
আরও পড়ুন: ‘খুব ভয় করছে, যদি আমার সন্তানদের ঘিরে জনতা জানতে চায় তারা হিন্দু না মুসলিম...’
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, আম জনতার কাছে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রতিষ্ঠান বিরোধী মতামত গুরুত্ব পায় বেশি। অন্য দিকে সরকারের সাফল্যের প্রচার ঢাক পেটানো বলেই গ্রহণযোগ্যতা কম। সোশ্যাল মিডিয়াও তার ব্যতিক্রম নয়। আবার একই রকম বিষয় (এক্ষেত্রে সরকারি প্রকল্পের সাফল্য তুলে ধরে টুইট) বার বার প্রতিফলিত হলে সেটা ক্লিশে হয়ে যায়। মানুষের আগ্রহ কমে। রাহুলের টুইটে এনগেজমেন্ট বাড়ার কারণ এই দু’টি হতে পারে। কিন্তু তাতে তাঁর কৃতিত্ব খাটো করে দেখা ঠিক হবে না বলেই মনে করেন পর্যবেক্ষকরা।
অনেকেই মনে করেন, আম জনতার মনোভাব বুঝতে সোশ্যাল মিডিয়া বিরাট এক মাধ্যম। কারণ এখানে সরাসরি প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়, যেটা অন্য মাধ্যমে এত প্রত্যক্ষ ভাবে পাওয়া প্রায় অসম্ভব। অনেকটা গ্রেডিং সিস্টেম, আর নম্বর সিস্টেমের মতো। সরাসরি স্কোর কত হল, তা প্রায় হাতে হাতে পাওয়া যায়। বিতর্ক থাকতে পারে। ফেক অ্যাকাউন্ট খুলে রিটুইট, রিপ্লাই দেওয়া বা লাইক শেয়ার করা যেতে পারে। কিন্তু তাতে সার্বিক মোট ফলাফলে বিরাট কিছু পরিবর্তন করা যায়, এমনটা মেনে নেন না সোশ্যাল মিডিয়ার বিশেষজ্ঞরা। ফলে ভিত্তি অবশ্যই রয়েছে।
বিতর্কের বিষয়বস্তু হতে পারে। কিন্তু সামাজিক মাধ্যমের এই স্কোর যদি জনপ্রিয়তারমানদণ্ড হয়, তা হলে রাহুল গাঁধীর জনপ্রিয়তা বা গ্রহণযোগ্যতা বাড়ছে। ২০১৯-এ লোকসভার মহারণের আগে নেটযুদ্ধে অন্তত মোদীকে পিছনে ফেলেছেন রাহুল। রাহুলের বিরুদ্ধে ‘পাপ্পু’, ‘সাহাবজাদা’ কটাক্ষ বেশ কিছুদিন ধরেই কমেছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা ভোটের সেমিফাইনালে ‘পাপ্পু পাস হো গ্যায়া’। বরং মোদীকে কটাক্ষ করেই মিম, জিফ, ভিডিয়োর ভিড় বেশি সোশ্যাল মিডিয়ায়। লোকসভা ভোটের ইভিএম-এও কি সোশ্যাল মিডিয়ার এই প্রবণতা ধরা পড়বে? উত্তর আপাতত সময়ের গর্ভে।
গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
(কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী, গুজরাত থেকে মণিপুর - দেশের সব রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ খবর জানতে আমাদেরদেশবিভাগে ক্লিক করুন।)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy