লাইনে পড়ে আছে শ্রমিকদের জামাকাপড়, চটি ও না-খাওয়া রুটি। শুক্রবার মহারাষ্ট্রের ঔরঙ্গাবাদ জেলার করমাডের কাছে। রয়টার্স
চড়া রোদে কষ্ট হবে। তাই সন্ধ্যায় মহারাষ্ট্রের অওরাঙ্গাবাদের জলনা থেকে রওনা হয়েছিলেন ওঁরা। ওঁরা মানে জলনার একটি ইস্পাত কারখানায় কর্মরত ২০ জন পরিযায়ী শ্রমিকের একটি দল। না কারখানা কর্তৃপক্ষ, না জেলা প্রশাসন— কাউকে কিছু না-জানিয়েই বেরিয়ে পড়েছিলেন ওঁরা। সঙ্গে খাবার বলতে কিছু শুকনো রুটি আর টিফিনের কৌটোয় সামান্য চাটনি। প্রাথমিক গন্তব্য, ১৫০ কিলোমিটার দূরের ভুসাবল। সেখান থেকে শ্রমিক স্পেশাল ট্রেন ধরে কেউ যাবেন মধ্যপ্রদেশের শহদোল-এ, কেউ বা উমরিয়া-য়।
হাঁটা শুরু হয়েছিল বাসরাস্তা ধরে। বদনাপুরে এসে চলতে শুরু করেন ভুসাবলগামী ট্রেন লাইন ধরে। কারণ, পথ চেনার সেটাই সহজ উপায়। প্রায় ৪০ কিলোমিটার একটানা হাঁটার পরে যখন বদনাপুর ও করমাডের মাঝামাঝি পৌঁছল দলটি, তখন কারও শরীর আর চলছে না। ক্লান্তিতে অবসন্ন দেহগুলো এলিয়ে পড়েছিল রেলের লাইনেই। নিশ্চিন্ত ঘুমে তলিয়ে যাওয়ার আগে ভেবেছিল, লকডাউনে তো ট্রেন বন্ধ, তাই কোনও ভয় নেই। কিন্তু মালবাহী ট্রেন যে চলছে, তা জানা ছিল না।
দলের মধ্যে তিন জন একটু সরে শুয়েছিলেন। ভোর তখন ৫টা ২২। ট্রেন আসছে বুঝতে পেরে তাঁরা লাইনে শুয়ে থাকা সঙ্গীদের ঘুম ভাঙানোর চেষ্টা করেছিলেন। মালগাড়ির চালকও আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন ট্রেন থামানোর। কিন্তু ট্রেন থামানো যায়নি। মালগাড়ির হর্ন বা সঙ্গীদের ডাকাডাকিতেও ঘুম ভাঙেনি লাইনে শুয়ে থাকা হা-ক্লান্ত ১৭ জনের। মনমাডের পানেওয়াডিগামী মালগাড়ির চাকায় পিষে গেলেন ১৪ জন। পরে হাসপাতালে মৃত্যু হল আরও ২ জনের। আহত এক জন। রেললাইনে পড়ে রইল কয়েকটা রুটির টুকরো, ছেঁড়া চটি, গামছা, দাঁতন, এমনকি সস্তার মাস্কও। এক জনের পকেট খুঁজে দেখা গেল, সম্বল মাত্র দু’শো টাকা।
রেললাইন থেকে এক শ্রমিকের দেহ সরাচ্ছেন উদ্ধারকর্মীরা। ছবি: রয়টার্স।
আরও পড়ুন: দেশে ফেরাতে টাকা কেন, প্রশ্ন রাহুলের
আরও পড়ুন: বিষক্ষয়ের পথ কি গোষ্ঠীর সংক্রমণই
সাতসকালে এমন খবরের পরে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর প্রতিক্রিয়া, ‘‘(আমি) প্রচণ্ড মর্মাহত।’’ তাঁর মন্ত্রিসভার দ্বিতীয় ব্যক্তি অমিত শাহের টুইট, ‘‘দুঃখ প্রকাশের ভাষা নেই।’’ রেলমন্ত্রীর টুইট, এ বার থেকে রেললাইনে হাঁটবেন না। মহারাষ্ট্র এবং মধ্যপ্রদেশ সরকারের তরফে মৃত শ্রমিকদের জন্য ৫ লক্ষ টাকা করে ক্ষতিপূরণের ঘোষণাও হল।
কিন্তু দেশ জুড়ে প্রশ্ন উঠল, বাড়ি ফিরতে মরিয়া ১৬ জন ঘুমন্ত শ্রমিকের রেলের চাকায় পিষ্ট হওয়ায় যে সরকার এত ‘ব্যথিত’, তারা পরিযায়ী শ্রমিকদের বাড়ি ফেরানোর জন্য গত ৪০ দিনে ঠিক কী করেছে? পরিযায়ী শ্রমিকদের এমন দুর্দশা কেন?
বিরোধী নেতৃত্ব এবং ট্রেড ইউনিয়নগুলির অভিযোগ, পরিযায়ী শ্রমিকদের নিয়ে প্রথম থেকে নরেন্দ্র মোদী সরকারের কোনও পরিকল্পনা ছিল না। বরং অনীহাই ছিল। তারই মাসুল ১৬টি প্রাণ। সূত্রের খবর, বাড়ি ফেরার জন্য এক সপ্তাহ আগে ‘পারমিট’ চেয়েছিলেন এই পরিযায়ী শ্রমিকেরা। সরকার সাড়া দেয়নি।
শুধু এঁরা নন, হেঁটে বাড়ি ফিরতে গিয়ে এ পর্যন্ত পথে মৃত্যু হয়েছে আরও অন্তত ৪০ জন পরিযায়ী শ্রমিকের। কংগ্রেস নেতা রাহুল গাঁধীর টুইট, “ভিন্ রাজ্যে কাজ করতে গিয়ে চরম দুর্দশার মধ্যে আটকে পড়া শ্রমিকদের বাড়ি ফেরানোর বন্দোবস্ত করুক সরকার। তাঁদের হাতে দেওয়া হোক অন্তত কিছু টাকা।”
ইতি-বৃত্ত
• বৃহস্পতিবার সন্ধে ৭টা নাগাদ ২০ জন শ্রমিকের দল জলনা থেকে রওনা হয়
• বাসরাস্তা দিয়ে হেঁটে বদনাপুরে পৌঁছনোর পরে হাঁটা শুরু লাইন ধরে
• প্রায় ৪০ কিমি হেঁটে ক্লান্তির ঘুম রেললাইনের উপরেই
• রেললাইন থেকে কিছুটা দূরে ঘুমোচ্ছিলেন তিন জন
• মালগাড়ি আসতে দেখে তাঁরা বাকিদের তোলার চেষ্টা করেন
• শুক্রবার ভোর ৫টা ২২-এ করমাডের কাছে দুর্ঘটনা
সিটু-র সাধারণ সম্পাদক তপন সেনের অভিযোগ, “বেশির ভাগ রাজ্যেই মালিকেরা গত চল্লিশ দিন পরিযায়ী শ্রমিকদের মজুরি দেয়নি। খাবার দেয়নি। মাথা গোঁজার জায়গাও জোটেনি বেশির ভাগ জায়গায়। অথচ লকডাউন উঠলে দক্ষ কর্মীর অভাব যাতে না-হয়, সে জন্য এখন তাঁদের বাড়ি ফিরতে দিতেও নারাজ মালিকপক্ষ। এঁদের চাপেই ট্রেন বাতিলের কথা বলেছিল কর্নাটক সরকার।” তাঁর দাবি, সরকার বাড়ি ফেরাতে চায় না বুঝেই পায়ে হেঁটে বাড়ি ফেরার এই মরিয়া চেষ্টা।
এআইটিইউসি-র সাধারণ সম্পাদক অমরজিৎ কউরের ক্ষোভ, “কাজ গিয়েছে। মাথায় ছাদ নেই। পকেট শূন্য। প্রায় দেড় মাস দু’বেলা পেট ভরে খাবারও জোটেনি ত্রাণ শিবিরে। তার পরেও বাড়ি ফেরাতে অনীহা সরকারের! এমন অবস্থায় মরিয়া হওয়া কি খুব অস্বাভাবিক?”
ভোটের প্রচারে মোদী বলেছিলেন, “আমার স্বপ্ন, হাওয়াই চটি পরা গরিব মানুষকে হাওয়াই জাহাজে (বিমানে) চড়ানো।” তুমুল হাততালি পেয়েছিলেন সে দিন। এ দিন প্রশ্ন উঠেছে, অনাবাসী ভারতীয়দের বিমান আর জাহাজে ফেরানোর কথা বুক ফুলিয়ে বলছে মোদী সরকার। অথচ দেশের শ্রমিকেরা বাড়ি ফেরার ট্রেন না-পেয়ে হাঁটতে গিয়ে মারা যাচ্ছেন!
(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy