গত শনিবারই গ্রেফতার করা হয় বছর ৪৭-এর জলিকে। ফাইল চিত্র।
পরিবারের আরও দুই শিশুকে একই ভাবে সায়ানাইড খাইয়ে মেরে ফেলার পরিকল্পনা ছিল জলি জোসেফের! ২০০২ সাল থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত, স্বামী-সহ পরিবারের ছ’জনকে ঠান্ডা মাথায়, দীর্ঘ পরিকল্পনা করে খুন করার অভিযোগে, কেরলে, গত শনিবারই গ্রেফতার করা হয় বছর ৪৭-এর জলিকে। এর পর তাকে দফায় দফায় জেরা করে উঠে আসছে একের পর এক নতুন তথ্য।
কেরলের এই চাঞ্চল্যকর সিরিয়াল কিলিংয়ের রহস্য ভেদ করতে ইতিমধ্যেই বিশেষ তদন্তকারী দল (সিট) গঠন করেছে কেরল পুলিশ। সেই সিটের অন্যতম সদস্য কোঝিকোড় (গ্রামীণ)-এর পুলিশ সুপার কে জি সাইমন সংবাদ সংস্থাকে জানিয়েছেন, ‘‘জলিকে জেরা করে জানা গিয়েছে, পরিবারের আরও দুই শিশুকে সায়ানাইড খাইয়ে খুনের ছক করেছিল সে। কিন্তু ঠিক মতো সুযোগ না পাওয়ায় পারেনি।”
পুলিশের দাবি, ওই ছ’জন ছাড়া নিজের ননদকেও সায়ানাইড মেশানো খাবার খাইয়েছিল জলি। কিন্তু তিনি সেই খাবার পরিমাণে খুব কম খাওয়ায়, এবং অসুস্থতা বোধ করার সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসা শুরু হওয়ায়, অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যান ননদ রেনজি। এর পরেই সাবধান হয়ে যায় জলি। তাই পরিকল্পনা থাকলেও, পরিবারের আরও দুই শিশুকে হত্যা করার ব্যাপারে জলি সময় নিচ্ছিল।
আরও পড়ুন: মা সিরিয়াল কিলার? বিশ্বাস হচ্ছে না ছেলের, জলি সাইকোপ্যাথ বলেই সন্দেহ পুলিশের
আরও পড়ুন: নেতা সরে গিয়েছেন, সেটাই কংগ্রেসের বড় সমস্যা, রাহুলের ইস্তফা নিয়ে বিস্ফোরক খুরশিদ
তদন্তে পুলিশ জানতে পেরেছে, খুনের শুরু ২০০২ সালে। নিজের শাশুড়ি, অবসর প্রাপ্ত শিক্ষিকা আন্নাম্মা থমাসকে সায়ানাইড মেশানো খাবার খাইয়ে খুন করে জলি। কিন্তু শাশুড়ির মৃত্যু স্বাভাবিক কারণে হয়েছে বলে মনে করেছিলেন পরিবারের সদস্যরা। এর পর জলির টার্গেট শ্বশুর টম। ২০০৮ সালে মারা যান টম। তিন বছরের মাথায়, ২০১১ সালে, মারা যান স্বামী রয়। এই প্রথম বিষের অস্তিত্ব মেলে। রয়ের মত্যু অস্বাভাবিক বলে মনে হয়েছিল পরিবারের সদস্যদের। দেহের ময়নাতদন্ত হয় এবং সেখান থেকেই জানা যায় রয়ের শরীরে সায়ানাইডের অস্তিত্ব। এক তদন্তকারীর কথায়, ‘‘রয়ের মৃত্যুর সূত্র ধরেই বর্তমান তদন্ত শুরু হয়। রয়ের মৃত্যুতে কিছু অস্বাভাবিকতা পাওয়া গিয়েছিল। তাই তাঁর দেহের ময়না তদন্ত হয়েছিল সেই সময়। সেখান থেকেই জানা গিয়েছিল তাঁর দেহে সায়ানাইড বিষের অস্তিত্ব।” কিন্তু সেই সময় পুলিশ তদন্ত করেও এই বিষ রহস্যের কোনও কিনারা করতে পারেনি। ফলে আড়ালেই থেকে গিয়েছিল খুনি।
স্বামী রয়ের মৃত্যুর পর তাঁর খুড়তুতো ভাই সাজুকে বিয়ে করে জলি। পুলিশ তদন্তে জানতে পারে, ঠিক যে ভাবে মৃত্যু হয়েছিল টম এবং আন্নাম্মার, ঠিক সেই ভাবেই ২০১৪ সালে মারা যান রয়ের এক মামা এম ম্যাথিউ। তার দু’বছরের মধ্যেই সাজুর প্রাক্তন স্ত্রী সিলি এবং মেয়ে আলপাইনেরও মৃত্যু হয়। উল্লেখযোগ্য ভাবে, এঁদের সবার মৃত্যুই হয়েছে আকস্মিক ভাবে। সব ক্ষেত্রেই উপস্থিত ছিল জলি। কিন্তু যে কোনও কারণেই হোক, এতগুলো মৃত্যু নিয়ে কারওরই মনে বড় কোনও সন্দেহের উদ্রেক হয়নি।
আরও পড়ুন-দু’দিনের বেসরকারি সফরে ভারতে আসছেন চিনফিং, চেন্নাইয়ে বৈঠক মোদীর সঙ্গে
সম্প্রতি জলির প্রথম স্বামী রয় থমাসের এক আমেরিকা প্রবাসী ভাই রোজোর সন্দেহ হয়। সেই পুলিশে অভিযোগ করে। তার পর ধীরে ধীরে তদন্তে উঠে আসে একের পর এক চাঞ্চল্যকর তথ্য। রহস্যের গভীরতা এতটাই বেশি যে, কেরল পুলিশকে বিশেষ তদন্তকারী দল (সিট) গঠন করতে হয়েছে। সেই সিটেরই এক তদন্তকারী বলেন,‘‘ গল্পের ডঃ জেকিল অ্যান্ড মিস্টার হাইডের বাস্তব রূপ এই জলি।”
তবে জলিকে এখন পর্যন্ত গ্রেফতার করা হয়েছে শুধুমাত্র স্বামী রয়ের মৃত্যুর ঘটনায়। কারণ একমাত্র ওই ঘটনায় বিষের অস্তিত্ব পাওয়া গিয়েছিল। পুলিশ বাকিদের দেহ কবর থেকে তোলার ব্যবস্থা করেছে। ওই দেহগুলির ময়না তদন্ত করানো হবে বলে জানা গিয়েছে সিটের তদন্তকারীদের কাছ থেকে।
কেরলের ফরেন্সিক সায়েন্স ল্যাবরেটরির প্রধান লোকনাথ বেহারা জানিয়েছেন, ‘‘আমরা বিদেশের কয়েকটি ফরেন্সিক ল্যাবকে চিহ্নিত করেছি। বিষের অস্তিত্ব আছে কি না জানার জন্য মৃতদের দেহ সেখানেও পাঠানো হতে পারে।”
রয়ের দেহে মেলা সায়ানাইডের উৎস খুঁজতে গিয়েই প্রাজু কুমার এবং এম ম্যাথিউ নামে দুজনের হদিশ পায় পুলিশ। তদন্তকারীরা জানতে পেরেছেন— গয়না তৈরির কারখানার কর্মী প্রাজু সায়ানাইড পৌঁছে দিত ম্যাথিউয়ের কাছে। ম্যাথিউয়ের কাছ থেকে তা পেত জলি। শুরু হয় জলিকে জেরা। প্রথমে জলি সমস্তটাই অস্বীকার করে। সুলেখা নামে ওই গ্রামেরই এক বাসিন্দা সংবাদ সংস্থাকে জানিয়েছেন, গ্রেফতারের আগের দিনও জলি গোটা দিন তাঁর সঙ্গে কাটিয়েছে। কোনও সময়তেই তাকে উদ্বিগ্ন মনে হয়নি। তত দিনে জলিকে বেশ কয়েক বার জেরা করেছে পুলিশ। শনিবার জলিকে গ্রেফতার করা হয়। তার পর গ্রেফতার করা হয়েছে ম্যাথিউ এবং প্রাজুকেও।
পুলিশ সূত্রে খবর, জেরায় জলি স্বীকার করেছে যে রয় ছাড়াও, বাকি পাঁচজনকে একই ভাবে খাবারের সঙ্গে সায়ানাইড মিশিয়ে মেরেছিল সে। এমন পরিমাণে সায়ানাইড সে দিত, যাতে শরীরে বাইরে থেকে বিষের কোনও লক্ষণ দেখা না যায়। মনে হয় স্বাভাবিক মৃত্যু। নিজের ননদকে একই ভাবে মারার চেষ্টার কথাও স্বীকার করেছে জলি।
আরও পড়ুন-কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মীদের দিওয়ালির উপহার, মহার্ঘ ভাতা বাড়ল ৫%, কার্যকর জুলাই থেকে
কেবল মাত্র পরিবারের মধ্যে নয়। জলির কীর্তি প্রকাশ্যে আসার পর স্থানীয় কংগ্রেস নেতা পি রামকৃষ্ণনের মৃত্যুর তদন্তের দাবি তুলেছেন তাঁর ছেলে এম রোহিত। তাঁর দাবি, রামকৃষ্ণণেরও একই রকম ভাবে মৃত্যু হয়েছিল। রোহিত পুলিশকে জানিয়েছেন, তাঁর বাবার রিয়েল এস্টেটের ব্যবসা ছিল। সেই সূত্রে তিনি একটি বিউটি পার্লারে যেতেন। ওই পার্লারে নিয়মিত যাতায়াত ছিল জলিরও। রোহিতের অভিযোগ, তাঁর বাবার মৃত্যুর পিছনেও হাত থাকতে পারে সিরিয়াল কিলার জলির।
সিটের তদন্তকারীদের আশঙ্কা, আরও তথ্য উঠে আসবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে। কিন্তু তাঁরা এখনও নিশ্চিত নন, একের পর এক হত্যার মোটিভ নিয়ে। কেন পর পর খুন করেছে জলি? প্রাথমিক ভাবে পুলিশ মনে করেছিল, সম্পত্তির জন্য খুন। কিন্তু পরে সেই মোটিভ জোরাল হয়নি। পুলিশ, জলির মানসিক বিকারের সম্ভবনাও খতিয়ে দেখছে। তদন্তকারীদের একাংশের ধারণা, খুনের পিছনে মনোবিকার কাজ করতেও পারে। তবে পুলিশ হেফাজতেও জলির অবিচলিত, শান্ত আচরণ অবাক করেছে পুলিশকে।
জলির সম্পর্কে খোঁজখবর করতে গিয়ে অদ্ভুত কিছু তথ্য পাচ্ছে পুলিশ। কেরলের উপকূলবর্তী কোঝিকোড় শহর থেকে ৩২ কিলোমিটার দূরে জলিদের কুডাথাই গ্রাম। আশে পাশের আর পাঁচটা গ্রামের মতোই খুব সাধারণ। সেখানকার সবাই এক ডাকে চেনেন জলিকে। ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলোজি(এনআইটি)-র শিক্ষিকা হিসাবে তাঁর পরিচয় ছিল এত দিন। জানা গিয়েছে গোটা এলাকা তাঁকে এনআইটির শিক্ষিকা হিসাবে জানলেও, আসলে জলি বাণিজ্য শাখায় স্নাতক। এনআইটির সঙ্গে তার কোনও যোগ নেই। কিন্তু জলি রোজ সকালে নিজের গাড়ি চালিয়ে কোঝিকোড় চলে যেত। সবাই জানত সে এনআইটিতে যায়। পুলিশ জানতে পেরেছে নিজের শিক্ষাগত যোগ্যতা সম্পর্কিত নথি জাল করেছে জলি। এনআইটি-র জাল পরিচয় পত্রও তৈরি করেছিল। গ্রামের অনেকেই পুলিশকে জানিয়েছেন, জলিকে তাঁরা বিভিন্ন সময়ে কোঝিকোড়ের এনআইটি ক্যাম্পাসে দেখেছেন। কিন্তু জলি যে এনআইটিতে যুক্ত নন, সে বিষয়ে পুলিশ নিশ্চিত। কিন্তু পুলিশের এখনও অজানা, প্রতিদিন সকালে এনআইটি যাওয়ার নাম করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে কোথায় কাদের সঙ্গে সময় কাটাতো জলি।
এর পাশাপাশি, ভীষণ ভাবে ধার্মিক মহিলা হিসেবেই গোটা গ্রামে জলির পরিচয় ছিল এত দিন। গোঁড়া রোমান ক্যাথলিকদের বাস ওই গ্রামে। জলি কোনও রবিবার গির্জায় প্রার্থনায় যোগ দেয়নি, এমনটা মনে করতে পারেন না কেউ। কিন্তু আচমকাই বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো গোটা গ্রাম জানতে পারল, সেই ‘শিক্ষিকা’, ধার্মিক জলিই একে একে নিজের স্বামী, শ্বশুর, শাশুরি-সহ পরিবারের ৬ জনকে খুন করেছে। ননদকে খুনের চেষ্টা করেছে। এবং আরও দুই নাবালককেও খুন করার পরিকল্পনা করেছিল সে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy