Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪
সার্থক জনম...!

দেশপ্রেমে মুগ্ধ দেশ, সেই হায়দর এখন নিজেই দেশহীন

১৫ অগস্ট, ২০১৭। দেশ জুড়ে ‘ভাইরাল’ একটি ছবি। অসমে দক্ষিণ শালমারার বানে ডোবা স্কুলে দেশের পতাকা উঠেছে। গলা-জলে দাঁড়িয়ে সেলাম ঠুকছে আদুড় গায়ে দুই খুদে ছাত্র। পাশে প্রধান শিক্ষক।

১৪ অগস্ট, ২০১৮: মায়ের সঙ্গে হায়দর আলি খান। (ডানদিকে) ১৫ অগস্ট, ২০১৭: বানভাসি স্কুলে তেরঙাকে কুর্নিশ হায়দরের (চিহ্নিত)। নিজস্ব চিত্র।

১৪ অগস্ট, ২০১৮: মায়ের সঙ্গে হায়দর আলি খান। (ডানদিকে) ১৫ অগস্ট, ২০১৭: বানভাসি স্কুলে তেরঙাকে কুর্নিশ হায়দরের (চিহ্নিত)। নিজস্ব চিত্র।

রাজীবাক্ষ রক্ষিত
গুয়াহাটি শেষ আপডেট: ১৫ অগস্ট ২০১৮ ০৩:৫১
Share: Save:

১৫ অগস্ট, ২০১৭। দেশ জুড়ে ‘ভাইরাল’ একটি ছবি। অসমে দক্ষিণ শালমারার বানে ডোবা স্কুলে দেশের পতাকা উঠেছে। গলা-জলে দাঁড়িয়ে সেলাম ঠুকছে আদুড় গায়ে দুই খুদে ছাত্র। পাশে প্রধান শিক্ষক।

এ বছর গুয়াহাটির গাঁধী মণ্ডপে যখন ৩০৬ ফুট উচ্চতায় পতাকা উড়িয়ে চমক দেওয়া চলছে, বাক্সার গোরেশ্বরে যখন সাড়ে তিন কিলোমিটার দীর্ঘ তেরঙা বানিয়ে জাতীয় নজির গড়ার চেষ্টা চলছে, তখনই ৩৬৫ দিন আগে ভারতীয়ত্ব ও দেশপ্রেমের প্রতীক হয়ে ওঠা ওই দুই ছাত্রের এক জন, হায়দর আলি খান আপাতত ‘দেশহীন’। সৌজন্যে অসমের নাগরিক পঞ্জি তথা এনআরসির চূড়ান্ত খসড়া। বাবা প্রাণ দিয়েছেন জঙ্গি বুলেটে। মা জাইবন খাতুন, দাদা জাইদর আর বোন রিনার নাম আছে নাগরিক পঞ্জিতে। অজ্ঞাত কারণে বাদ পড়েছে হায়দর।

হায়দরের সেরা বন্ধু জিয়ারুল যতটা ছটফটে, হায়দর ততটাই চুপচাপ। কিন্তু সাঁতারে দু’জনই দক্ষ। তাই গত বছর যখন নসকরা নিম্ন প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্যায় ডুবে যায় ওই দুই খুদে সাঁতারু জলে ঝাঁপ দিয়ে চলে গিয়েছিল স্কুলের সামনে পতাকাস্তম্ভের কাছে। ডুব দিয়ে খুলে ফেলেছিল জাতীয় পতাকার রশি। প্রধান শিক্ষক তাজেম শিকদারও সাঁতরে চলে আসেন। বাকি শিক্ষক ও ছাত্ররা তখন উঁচু রাস্তায় দাঁড়িয়ে। পতাকা উত্তোলন করে স্যালুট ঠোকেন তাজেম, হায়দর, জিয়ারুল। এগিয়ে আসেন অন্য শিক্ষকেরাও। ধরেন জাতীয় সঙ্গীত। গলা মেলায় আশপাশে জমে থাকা ভিড়। শিক্ষক মিজানুর রহমান ওই ছবি তুলে পোস্ট করেছিলেন নিজের ফেসবুক পাতায়। বিকেলের মধ্যে তা গোটা দেশে ভাইরাল হয়ে যায়। অভিনন্দনে ভাসেন নসকরা স্কুলের শিক্ষক-ছাত্ররা।

১৫ অগস্ট, ২০১৭: বানভাসি স্কুলে তেরঙাকে কুর্নিশ হায়দরের।

স্থানীয় সাংসদ বদরুদ্দিন আজমল স্কুলকে এক লক্ষ টাকা এবং ওই দুই ছাত্র ও চার শিক্ষককে নিজের তরফে আর্থিক ইনাম দেন। মিজানুরবাবু বলেন, “আমাদের এলাকা এতই প্রত্যন্ত যে ধুবুরি যেতেও দুই ঘণ্টা নৌকায় পাড়ি দিতে হয়। রাস্তাঘাট নেই। আমার নিজের বাড়ির একটা অংশ নদীতে তলিয়ে গিয়েছে। নেতারা পাত্তা দেন না। গত বার হইচইয়ের পরে ভেবেছিলাম, এ বার এলাকার উন্নতি হবে। কিন্তু কিছুই হল না।”

আরও পড়ুন
এ বারও পতাকা তুলল, কিন্তু মন বেজার হায়দরের, এ দেশটা তার থাকবে তো?

এ বছর ৩০ জুলাই এনআরসির চূড়ান্ত খসড়া তালিকা প্রকাশ হলে দেখা যায়, গ্রামের অনেকের মতো হায়দরের নামও তালিকায় নেই। হায়দরের মা জানান, এনআরসি সেবা কেন্দ্র থেকে বলা হয়েছে, হায়দরের জন্মের শংসাপত্রে সম্ভবত গোলমাল আছে। সেবা কেন্দ্র সূত্রে বলা হচ্ছে, গ্রামে মহিলাদের অনেকের প্রসবই হাসপাতালে হয় না। পরে জন্মের শংসাপত্র সংগ্রহ করতে যায় পরিবার। তখনই কোনও গোলমাল হয়ে থাকবে।

২০১২ সালে কোকরাঝাড়ে জঙ্গি হানায় মারা যান হায়দরের বাবা রুপনাল খান। তার পর থেকেই চুপচাপ হায়দার। এখন চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র। ছোট হলেও, নাম বাদ পড়ার গুরুত্ব সে জানে। তাই আরও চুপ হয়ে গিয়েছে। মা মাদ্রাসায় রান্না করে নামমাত্র টাকা পান। বলেন, “সংসারই চালাতে পারি না, ছেলেকে ভারতীয় প্রমাণ করতে মামলা-মকদ্দমা চালানোর সাধ্য কোথায়! সেবা কেন্দ্র ভরসা দিয়েছে পরের বার ঠিক মতো আবেদনপত্র জমা দিলে নাম উঠবে।”

আশঙ্কাকে সঙ্গী করেই হায়দর এ বারেও স্বাধীনতা দিবসে পতাকা তুলবে। ক’দিনের মধ্যেই হায়দরের নিম্ন প্রাথমিক স্কুলটি এলাকার মধ্য ইংরেজি স্কুলে মিশে যাচ্ছে। তাই এ বারই স্কুলের মাঠে শেষ বার পতাকা তোলা হবে। গাওয়া হবে ‘জনগণমন’। ছোট্ট হায়দর জানে না, তার কপালে কী লিখে রেখেছেন ‘ভারত ভাগ্যবিধাতা’।

অন্য বিষয়গুলি:

NRC Assam Independence Day
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE