Advertisement
২৩ নভেম্বর ২০২৪
National news

দারিদ্র ছিল, কিন্তু এখন কিছুই রইল না, বলছে এনসেফেলাইটিসে আক্রান্ত দরিয়াপুর

কাঁদতে কাঁদতে শীলা দেবী বললেন, ‘‘আমরা খুব গরিব। হাড়ভাঙা খাটতে হয় রোজগারের জন্য। খুব লড়াই করে বেঁচে থাকতে হয় আমাদের। ছেলের নাম রেখেছিলাম প্রিন্স রাজ। ওর দিকে তাকালেই সব কষ্ট, সব দুঃখ ভুলে যেতাম। অনেক অভাব সত্ত্বেও সুখেই ছিলাম। আমার সুখ বোধহয় সহ্য হল না ভগবানের! সব কেড়ে নিলেন!’’

এনসেফেলাইটিসে আক্রান্ত শিশুকে কোলে নিয়ে হাসপাতালে মা। ছবি: পিটিআই

এনসেফেলাইটিসে আক্রান্ত শিশুকে কোলে নিয়ে হাসপাতালে মা। ছবি: পিটিআই

সংবাদ সংস্থা
মুজফ্‌ফরপুর (বিহার) শেষ আপডেট: ২৩ জুন ২০১৯ ১৬:২১
Share: Save:

‘নুন আনতে পান্তা ফুরোয়’ গোছের অবস্থা। স্বামীর সঙ্গেই মজুরের কাজ করেন শীলা দেবী। তবু বলছেন, ‘‘তাতেও অনেক সুখ ছিল। এখন যে আর কিছুই রইল না!’’ পাঁচ-পাঁচটি মেয়ের পর শীলা দেবীর কোলে এসেছিল ছেলে। চার বছর আগে। আনন্দের বন্যা বয়ে গিয়েছিল গোটা তল্লাটে। ১০ দিন আগে শীলা দেবীর সেই ‘সবেধন নীলমণি’ ছেলে মারা গিয়েছে এনসেফেলাইটিসে। বিহার সরকারের হিসাবে যে অ্যাকিউট এনসেফেলাইটিস সিনড্রোমে (এইএস) মৃত্যু হয়েছে ১৫৬ জনের। তার মধ্যে শ্রীকৃষ্ণ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালেই মৃত্যু হয়েছে ১০৯ জনের। চিকিৎসায় গাফিলতির দায়ে সাসপেন্ড করা হয়েছে হাসপাতালের এক জন রেসিডেন্ট ডাক্তারকে।

কাঁদতে কাঁদতে শীলা দেবী বললেন, ‘‘আমরা খুব গরিব। হাড়ভাঙা খাটতে হয় রোজগারের জন্য। খুব লড়াই করে বেঁচে থাকতে হয় আমাদের। ছেলের নাম রেখেছিলাম প্রিন্স রাজ। ওর দিকে তাকালেই সব কষ্ট, সব দুঃখ ভুলে যেতাম। অনেক অভাব সত্ত্বেও সুখেই ছিলাম। আমার সুখ বোধহয় সহ্য হল না ভগবানের! সব কেড়ে নিলেন!’’ বলতে বলতে কান্নায় গলা বুঁজে গেল শীলা দেবীর। চার বছরের ছেলের হঠাৎ মৃত্যুর পর থেকেই আর ঘর ছেড়ে বেরচ্ছেন না শীলা দেবী। কাজে যাচ্ছেন না। খাচ্ছেনও না তেমন কিছু। তারই মধ্যে যতটা সম্ভব আগলে রাখার চেষ্টা করছেন পাঁচটি মেয়েকে। ভয়, মেয়েদেরও না হারাতে হয় তাঁকে!

গত ১২ জুনের ঘটনা। পাঁচ মেয়ে আর ছেলেকে নিয়ে পাশের গ্রামে একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন শীলা দেবী। মুজফ্ফরপুরের দরিয়াপুর গ্রামে নিজের বাড়িতে ফেরার সময় ৬ ছেলেমেয়ের জন্য সামোসা কিনেছিলেন। সকলে মিলে সেই সামোসা খেল। তার পর সাড়ে সাতটা নাগাদ ছেলেমেয়েরা রাতের খাবার খেয়ে নিল। চার বছরের ছেলেকে কোলে নিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিলেন শীলা দেবী।

পরের দিন তখন সবে ভোর হয়েছে। ঘড়িতে ৬টা কি সাড়ে ৬টা। শীলা দেবী দেখলেন, হঠাৎ ওঁর ছেলের শরীর খুব শক্ত হয়ে যাচ্ছে। খিঁচুনি হচ্ছে। স্বামী ও ছেলেকে নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে ছুটলেন মুজফ্‌ফরপুরের কেজরীবাল হাসপাতালে। ঘণ্টাখানেকর মধ্যেই হাসপাতালের ডাক্তাররা প্রিন্সকে ডেক্সট্রোজ খাওয়ালেন। দেওয়া হল নানা রকমের ওষুধ। শুরু হল চিকিৎসা। কিন্তু বাঁচানো গেল না।

আরও পড়ুন- বিহারে শিশুমৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে ১৫৬ ​

আরও পড়ুন- নিখোঁজ লালুপুত্রকে খুঁজে দিলে ৫১০০ টাকা পুরস্কার!​

‘‘আমার ছেলে খুব নাদুসনুদুস ছিল। আগে কোনও অসুখও হয়নি ওর’’, বলছিলেন শীলা। এলাকায় অনেক লিচু গাছ। লোকের মুখে শুনেছিলেন লিচু খেলেই নাকি ভয়ঙ্কর একটা রোগ হচ্ছে। তাতে মৃত্যু হচ্ছে। ফলে, ছেলেমেয়েরা যাতে লিচু না খায় তার দিকে সব সময় নজর রাখতেন শীলা। এমনকি, গ্রামের ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়ে রিহাইড্রেশন সলিউশনও খাইয়েছিলেন ছেলেমেয়েদের। যাতে কোনও রোগে না আক্রান্ত হতে হয় ছেলেমেয়েদের।

ছেলের মৃত্যুর পর সরকার ক্ষতিপূরণের জন্য একটি চেক পাঠিয়েছিল তাঁকে। ৪ লক্ষ টাকার। জনৈক তুল্লো মাহাতোর নামে। কিন্তু সেই চেক নিতে পারেননি, তা তাঁর স্বামী নান্নো মাহাতোর নামে পাঠানো হয়নি বলে। ব্লক ডেভেলপমেন্ট অফিসারের কাছে সেই চেক ফিরিয়ে দিয়েছেন শীলা।

আর ১০০টি পরিবারের মতো দরিয়াপুর গ্রামেই থাকেন রেখা দেবী। এই সে দিন তাঁর সাত বছরের মেয়ে নিধিকে হারিয়েছেন রেখা। পাঁচ ছেলেমেয়ে তাঁর। নিধি ছিল সবার বড়।

গত ১৩ জুন সকালে ঘুম থেকে উঠতে একটু দেরী করেছিল নিধি। উঠেছিল ৯টায়। রেখার বাড়ির চার পাশে শুধু আম আর লিচু গাছ। রেখা বলছিলেন, ‘‘ঘুম থেকে উঠেই মেয়ে বলল, খুব মাথা ব্যথা করছে। তবু সকালের খাবার খেল। তার পর আবার ঘুমিয়ে পড়ল। কিন্তু ঘুম ভেঙেও গেলও ওর, অস্বস্তিতে। ওকে নিয়ে স্বামীর সঙ্গে আমি ছুটলাম শ্রীকৃষ্ণ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। সাড়ে দশটার মধ্যেই পৌঁছে গেলাম। সাড়ে এগারোটায় মেয়েকে ভর্তি করিয়ে নিলেন ডাক্তাররা। দেওয়া হল দু’বোতল স্যালাইন ওয়াটার।’’

নিধির বাবা সুবোধ প্রধান বললেন, ‘‘তার পর আর চার ঘণ্টা বেঁচেছিল আমার মেয়ে। বিকেল সওয়া তিনটে নাগাদ ও মারা গেল হাসপাতালেই।’’

মুজফ্‌ফরপুরের কান্তি ব্লকের মধ্যে পড়ে দরিয়াপুর গ্রাম। একই অবস্থা পাশের গ্রাম দামোদ্রির। মুসলিম প্রধান সেই গ্রামেও দু’টি শিশুর মৃত্যু হয়েছে এই রোগে।

থমথম করছে দরিয়াপুর ও তার আশপাশের গ্রামগুলি।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy