গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
উঁচু জাত বলে তাদের বিরুদ্ধে চক্রান্ত হচ্ছে। নইলে দলিত মেয়েটির গায়ে হাত লাগাতেই বা যাবে কেন ছেলেগুলো? শুক্রবার বুলা গড়হীতে পঞ্চায়েতের সভায় সবর্ণ-রাজপুত সমাজের মোড়লরা যখন নিজেদের মধ্যে এমন বলাবলি করছেন, তার ঢের আগেই উর্দিধারী পুলিশ জানিয়ে দিয়েছে, ১৯ বছরের তরুণীকে ধর্ষণ করা হয়েছে, এমন কোনও প্রমাণ মেলেনি।
তবে শুধু পুলিশকে দিয়ে বলানোই নয়, হাথরস-কাণ্ডে ধর্ষণের অভিযোগ একেবারে ধুয়েমুছে সাফ করার চেষ্টায় যোগী আদিত্যনাথের উত্তরপ্রদেশ সরকার চেষ্টার কোনও কসুর রাখছে না। তার জন্য গাঁটের কড়ি খরচ করে জনসংযোগ (পিআর) সংস্থাকেও নিয়োগ করা হয়েছে।
অবশ্য এত করেও শেষরক্ষা হবে কি না, সে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। কারণ, শনিবারই হাসরথ-কাণ্ডে সিবিআই তদন্তের সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে যোগীকে। সেই হাই প্রোফাইল তদন্তে জনসংযোগের মলম প্রলেপ দিতে পারবে কি না তা নিয়ে সন্দিহান যোগী প্রশাসনেরই একাংশ।
So disgusting! Not that one should expect anything better of the UP govt, but why would Concept PR even take this up. Yuck https://t.co/mFtD4u9AAv
— Shilpa S. Ranipeta (@Shilparanipeta) October 1, 2020
পিআর সংস্থার কাছ থেকে পাওয়া ইমেলের স্ক্রিনশট টুইটারে শেয়ার করেছেন এক সাংবাদিক।
আরও পড়ুন: প্রিয়ঙ্কার রণে ‘দাদির তেজ’, পোশাকে টান দিল ‘বীরপুরুষ’
দীর্ঘ ১৫ দিন মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ার পর গত ২৯ সেপ্টেম্বর দিল্লির সফদরজং হাসপাতালে মৃত্যু হয় হাথরসের নির্যাতিতার। তার পর পরিবারের হাত থেকে কার্যত ছিনতাই করে তাঁর দেহ সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হোক বা পেট্রল ছড়িয়ে রাতারাতি তা পুড়িয়ে ফেলা— উত্তরপ্রদেশ সরকারের প্রতিটি পদক্ষেপে ফুঁসছে গোটা দেশ। বিদেশেও সেই খবর পৌঁছেছে। ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’, ‘দ্য গার্ডিয়ান’-এর মতো সংবাদমাধ্যমে সে খবর ফলাও করে ছাপা হয়েছে। উত্তরপ্রদেশে দলিত মহিলাদের শিক্ষা দেওয়ার যে আদি রীতি, জাতপাত সংক্রান্ত ছুঁৎমার্গ, ইত্যাদি নিয়েও সবিস্তার আলোচনা করেছে তারা।
পেট্রল ঢেলে রাতারাতি নির্যাতিতার দেহ পুড়িয়ে দেওয়া নিয়ে প্রশ্নের মুখে যোগীর পুলিশ।
তার পরেই যোগীর সরকার ড্যামেজ কন্ট্রোলে নেমেছে। গত মঙ্গল-বুধবার রাতে গায়ের জোরে উত্তরপ্রদেশ পুলিশ নির্যাতিতার দেহ পুড়িয়ে দিয়েছিল বলে অভিযোগ। সেই নিয়ে চারিদিক যখন উত্তাল, তখনই ভারতে কর্মরত বিদেশি পত্রপত্রিকার প্রতিনিধি এবং বিশেষ কিছু সর্বভারতীয় সংবাদমাধ্যমের কাছে মুম্বইয়ের একটি সংস্থার তরফে বিশেষ বিবৃতি পৌঁছয়। বলা হয়, উত্তরপ্রদেশ সরকারের তরফে সেটি প্রকাশ করা হয়েছে। হাথরস-কাণ্ডের উল্লেখ করে সেখানে বলা হয়েছে, ‘হাথরসের ওই তরুণীকে ধর্ষণ করা হয়নি। ফরেনসিক তদন্ত, প্রাথমিক চিকিৎসা এবং ময়নাতদন্তের রিপোর্টেই তা পরিষ্কার’। একই সঙ্গে বলা হয়, ‘জাতপাত নিয়ে রাজ্য জুড়ে অশান্তি সৃষ্টি করার লক্ষ্যে কেউ বা কারা এই ষড়যন্ত্র করছে। সরকার নিযুক্ত বিশেষ তদন্তকারী দল (সিট) এই কুচক্রীদের পর্দাফাঁস করে ছাড়বে’।
ভোরের আলো ফোটা পর্যন্ত অপেক্ষা না করে, পরিবারের অনুমতি না নিয়ে রাতারাতি যে ভাবে ওই তরুণীর দেহ পুড়িয়ে ফেলে পুলিশ, তা নিয়েও সাফাই দেওয়া হয় ওই বিবৃতিতে। বলা হয়, ‘বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তবে যাতে অপ্রীতিকর কিছু না ঘটে যায়, তার জন্যই এমন পদক্ষেপ করেছিল পুলিশ’।
আরও পড়ুন: হাথরসে সিবিআই, নির্যাতিতার বাড়িতে গিয়ে কথা রাহুল-প্রিয়ঙ্কার
ময়নাতদন্তের রিপোর্টে নির্যাতিতাকে ধর্ষণ করা হয়েছে এমন কোনও প্রমাণ মেলেনি বলে আগেই দাবি করেছিলেন উত্তরপ্রদেশের এডিজি (আইনশৃঙ্খলা) প্রশান্তকুমার। বিবৃতিতে তাঁর বক্তব্যেরই পুনরাবৃত্তি করে বলা হয়, ‘সমস্ত জল্পনার অবসান ঘটিয়ে জানাতে চাই, মেয়েটির যৌনাঙ্গ থেকে নমুনা পরীক্ষা করে ফরেনসিক সায়েন্স ল্যাবরেটরি (এফএসএল)-র রিপোর্টে বলা হয়েছে, মেয়েটিকে ধর্ষণ করা হয়নি। ময়নাতদন্ত এবং ডাক্তারি রিপোর্টেও ধর্ষণের কোনও উল্লেখ নেই। তাই চূড়ান্ত রিপোর্ট হাতে পাওয়ার পর এ নিয়ে আর কোনও সন্দেহ থাকা উচিত নয়’।
কিন্তু হাথরসের নির্যাতিতা ধর্ষণের শিকার হননি, তা প্রমাণ করতে উত্তরপ্রদেশ সরকার যে ভাবে মরিয়া হয়ে উঠেছে, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন চিকিৎসা এবং আইনি বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের মতে, ভারতীয় দণ্ডবিধির আওতায় ধর্ষণের সংজ্ঞা কী, তা জানা নেই উত্তরপ্রদেশ পুলিশের। ফরেনসিক তদন্ত সম্পর্কে প্রাথমিক জ্ঞানটুকুও নেই তাদের। অপরাধ ও অভিযুক্তদের নিয়ে তদন্তে জোর দেওয়ার চেয়ে গোটা ঘটনাটিকে ‘ষড়যন্ত্র’ বলে প্রতিপন্ন করাই তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য।
শনিবার সকাল পর্যন্ত নির্যাতিতার বাড়ির সামনে ব্য়ারিকেড বসিয়ে রেখেছিল পুলিশ, যেতে দেওয়া হয়নি কাউকেই।
বিশিষ্ট সমাজকর্মী তথা আইনজীবী নূতন ঠাকুরের মতে, তদন্ত এখনও শেষ হয়নি। তার আগেই ধর্ষণের অভিযোগ খারিজ করছে পুলিশ, যা আইনবিরোধী। এতেই বোঝা যায়, তদন্ত কোন পথে এগোবে, তা আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছেন তদন্তকারীরা। যেখানে গণধর্ষণের মতো গুরুতর অভিযোগ রয়েছে, সেখানে তড়িঘড়ি কোনও সিদ্ধান্তে না পৌঁছে সমস্ত তথ্য-প্রমাণ খতিয়ে দেখা উচিত বলে অভিমত নূতন ঠাকুরের। একই সঙ্গে অভিযোগ দায়ের করা থেকে নমুনা পরীক্ষা, গোড়া থেকে তদন্তে ঢিলেমি, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন তিনি।
আরও পড়ুন: ‘মেয়ে করোনায় মরলে টাকা পেতে?’
নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক এক ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ জানিয়েছেন, একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নমুনা সংগ্রহ করা গেলে বোঝা যেত ওই তরুণীর উপর কোনও যৌন নির্যাতন চালানো হয়েছে কিনা। কিন্তু এ ক্ষেত্রে যে দিন ওই তরুণীকে ধর্ষণ করা হয় বলে অভিযোগ, তার আট দিন পর তাঁর ডাক্তারি পরীক্ষা হয়। তা থেকে কিছু না পাওয়াই স্বাভাবিক। ধর্ষণের তদন্তের ক্ষেত্রে ভারত এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে যে বিধিনিয়ম রয়েছে এ ক্ষেত্রে তা-ও লঙ্ঘন হয়েছে বলে অভিযোগ করেন তিনি। তাঁর বক্তব্য, কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রকের নির্দেশিকা অনুযায়ী যৌননিগ্রহের চার দিনের মধ্যে সমস্ত পরীক্ষা মিটিয়ে ফেলাই নিয়ম। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সাত দিনের সময়সীমা পাওয়া যায়। তার পর আর প্রমাণ হাতে পাওয়ার তেমন কোনও সম্ভাবনা থাকে না।
ঘটনার সময় তরুণী যে পোশাক পরেছিলেন, তাঁর নখের নমুনা ইত্যাদি সংরক্ষণ করা হয়েছে কিনা, তা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন ওই বিশেষজ্ঞ। তাঁর দাবি, নির্দিষ্ট সময়ের পর তরুণীর যৌনাঙ্গ পরীক্ষা করে কিছু না পাওয়া গেলেও পোশাক থেকে নমুনা পাওয়া সম্ভব। তবে তেমন কিছু আদৌ সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে কিনা, উত্তরপ্রদেশ পুলিশের তরফে এখনও তা খোলসা করা হয়নি। সে সবে গুরুত্ব দেওয়ার চেয়ে ধর্ষণের খবর কারা ফলাও করে ছাপিয়েছে, পুলিশের দেওয়া বিবৃতিতে কারা খুঁত বার করেছে, তা খুঁজে বার করতেই ব্যস্ত উত্তরপ্রদেশ সরকার। বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে ওই জনসংযোগ সংস্থার বিবৃতিতে জানানো হয়েছে।
হাথরসের ঘটনার প্রতিবাদে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে রাস্তায় নেমে এসেছেন সাধারণ মানুষ।
অর্থাৎ, আসল অপরাধ খতিয়ে না দেখে রাজ্যে যে সমস্ত সংবাদমাধ্যম হাথরসের ঘটনাকে গণধর্ষণ বলে দেখিয়েছে, নির্যাতিতার পরিবারের বয়ান নিয়েছে এবং এখনও গোটা ঘটনা নিয়ে কাটাছেঁড়া চালিয়ে যাচ্ছে, তাদের লাগাম টেনে ধরতেই যোগী সরকার বেশি সচেষ্ট বলে মত বিশেষজ্ঞদের। তাঁদের দাবি, জনতার কাছে কাজের ফিরিস্তি পৌঁছে দিতে প্রত্যেক রাজ্যের সরকারই কোনও না কোনও সংস্থাকে নিয়োগ করে। হাথরস-কাণ্ডকে ধামাচাপা দিতে বেসরকারি সংস্থাটিকে ‘ঢাল’ হিসেবে ব্যবহার করছে উত্তরপ্রদেশ সরকার। যাতে বিদেশি সংবাদমাধ্যম এ নিয়ে ‘হইচই’ না করে, ‘আত্মনির্ভর’ উত্তরপ্রদেশ এবং ভারতের ভাবমূর্তি যাতে আন্তর্জাতিক মহলে কালিমালিপ্ত না হয়, জাতপাত নিয়ে ভেদাভেদের বাস্তব চিত্রটা যাতে বেরিয়ে না পড়ে, ইউপিএ আমলে ঘটে যাওয়া নির্ভয়া-কাণ্ডের সঙ্গে হাথরসের তুলনা যাতে না টানা হয় এবং সর্বোপরি সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রবাসী ভারতীয়রা যাতে বিজেপির সমর্থনে গলা চড়িয়ে যেতে পারেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy