Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Hathras

রাহুলকে গলাধাক্কা, হাথরস ঘিরে তপ্ত রাজনীতি, হস্তক্ষেপ হাইকোর্টের

‘গাঁধীদের ফোটোশ্যুট’, কটাক্ষ সিদ্ধার্থনাথ সিংহের। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মুখতার আব্বাস নকভির খোঁচা, ‘রাজনৈতিক পর্যটন’।

হাথরস গণধর্ষণ-খুন কাণ্ডের প্রতিবাদে যোগী আদিত্যনাথ সরকারের বিরুদ্ধে এক সুর বিরোধীদের। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ

হাথরস গণধর্ষণ-খুন কাণ্ডের প্রতিবাদে যোগী আদিত্যনাথ সরকারের বিরুদ্ধে এক সুর বিরোধীদের। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ

সংবাদ সংস্থা
লখনউ ও নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ০১ অক্টোবর ২০২০ ২২:২৭
Share: Save:

হাথরস গণধর্ষণ ও খুনের প্রতিবাদ-প্রতিরোধ অন্য মাত্রায় পৌঁছে গেল বৃহস্পতিবার। হাথরসে যাওয়ার পথে প্রথমে যমুনা এক্সপ্রেসওয়ের উপর রাহুল গাঁধী-প্রিয়ঙ্কা গাঁধীর কনভয় আটকায়। তার পর রাহুলকে গলাধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে দেয় যোগীর পুলিশ। রাহুল-প্রিয়ঙ্কা-সহ কংগ্রেসের শীর্ষ নেতা-নেত্রীকে গ্রেফতার করা হয়। সংবাদমাধ্যম থেকে রাজনৈতিক প্রতিনিধি— কাউকেই ঢুকতে না দিয়ে কার্যত দুর্গ বানিয়ে হাথরসকে পাহারা দিল উত্তরপ্রদেশ পুলিশ। যোগীর বিরুদ্ধে ‘জঙ্গলরাজ’ আর মোদী সরকারের বিরুদ্ধে দমন-পীড়ন নীতির অভিযোগ তুলে আক্রমণের ঝাঁঝ তীব্র করল কংগ্রেস। পদ্ম শিবির থেকেও ধেয়ে এল ‘রাজনৈতিক পর্যটন’, ‘ফোটোশ্যুট’-এর মতো পাল্টা খোঁচা। রাতে যদিও ইলাহাবাদ হাইকোর্ট স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে হাথরস-কাণ্ডে হস্তক্ষেপ করেছে।

মঙ্গলবার দিল্লির সফদরজং হাসপাতালে হাথরসের দলিত তরুণীর মৃত্যুর পর থেকেই কাঠগড়ায় যোগী আদিত্যনাথের পুলিশ-প্রশাসন। সোশ্যাল মিডিয়ায় তো বটেই, ছোটখাটো প্রতিবাদ-প্রতিরোধে নির্যাতিতার পক্ষে আর যোগী সরকারের বিরুদ্ধে জনমত বাড়ছিল। তার মধ্যেই মঙ্গলবার মধ্যরাতে পরিবারকে না দিয়ে পুলিশ-প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে কার্যত চুপিসারে ওই তরুণীর দেহ দাহ করে দেওয়ায় জনরোষ বাড়ছিল যোগী সরকারের উপরে।

বৃহস্পতিবার সেই আগুনে ঘি পড়ল রাহুল-প্রিয়ঙ্কা গাঁধী-সহ কংগ্রেসের একঝাঁক শীর্ষ নেতৃত্বের হাথরস অভিযান ঘিরে। বুধবারই ঘোষিত হয়েছিল কর্মসূচি। বৃহস্পতিবার সকালে ১৪৪ ধারা জারি করে দিয়েছিল যোগীর প্রশাসন। ফলে রাহুলদের হাথরস যাত্রা ঘিরে যে ধুন্ধুমার ঘটতে পারে, তেমন আশঙ্কা ছিলই। নয়ডার পরি চকে তাঁরা পৌঁছতেই সেই আঁচ পাওয়া যায়। আটকে দেওয়া হল রাহুল-প্রিয়ঙ্কা, অধীর চৌধুরী, রণদীপ সিংহ সুরজেওয়ালা, কে সি বেণুগোপালদের কনভয়। কংগ্রেস নেতৃত্বও নাছোড়। শুরু হয় যমুনা এক্সপ্রেসওয়ে ধরে পায়ে হেঁটে হাথরস অভিমুখে যাত্রা। কিন্তু কিছু দূর এগোতেই থামতে হয় রাহুলদের। পথ আটকায় পুলিশ। পুলিশের লাঠি, ধস্তাধস্তির মধ্যে রাহুলকে কার্যত গলাধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে দেয় পুলিশ। বেড়ে যায় রাজনৈতিক উত্তেজনার পারদ।

পুলিশের সঙ্গে ধস্তাধস্তি রাহুল গাঁধীর:

আরও পড়ুন: যোগী আমলে ধর্ষণ করে খুনের রমরমা ‘উত্তমপ্রদেশে’

গ্রেফতার করে রাহুল-প্রিয়ঙ্কা-অধীরদের নিয়ে যাওয়া হয় ঘটনাস্থল থেকে। বিকেল পর্যন্ত ধোঁয়াশা ছিল, রাহুলদের গ্রেফতার করা হয়েছে, না কি আটক? বিকেলের দিকে নয়ডার অতিরিক্ত ডেপুটি পুলিশ কমিশনার রণবিজয় সিংহ জানান, মহামারি আইনে রাহুল ও প্রিয়ঙ্কা-সহ কংগ্রেস নেতাদের আটকে দেওয়া হয়। শেষ পর্যন্ত রাহুল-প্রিয়ঙ্কাকে এ দিন উত্তরপ্রদেশ পুলিশ হাথরসে যেতে দেয়নি। ১৪৪ ধারা ভাঙার অভিযোগে তাঁদের গ্রেফতার করে গ্রেটার নয়ডায় বুদ্ধ ইন্টারন্যাশনাল সার্কিট-এর গেস্ট হাউসে নিয়ে যাওয়া হয়। তার পরে বিকেলে তাঁদের পুলিশের গাড়িতে দিল্লিতে ফিরিয়ে দেওয়া হয়।

রাহুল-প্রিয়ঙ্কা-সহ কংগ্রেস নেতা-নেত্রীদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছে গৌতম বুদ্ধ নগরে:

কেন আটকানো হল কংগ্রেস নেতৃত্বকে? ধস্তাধস্তি, বাগ্‌বিতণ্ডার সময় পুলিশকে প্রশ্ন করেছিলেন রাহুল। পুলিশের দাবি, ১৪৪ ধারা জারি রয়েছে। সরকারি নির্দেশ অমান্য করায় ১৮৮ ধারায় তাঁদের আটকানো হচ্ছে। যোগীর পুলিশকর্তাদের দাবি, করোনা সংক্রমণ রুখতে গত ১ সেপ্টেম্বর থেকে রাজ্যে ঢোকার উপর জারি হয়েছিল নিয়ন্ত্রণ। তার মেয়াদ ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। ১৪৪ ধারা জারি থাকলে একসঙ্গে বা একটি দলে ৪ জনের বেশি যাওয়া যায় না। সেই প্রশ্ন তুলে রাহুল বলেন, ‘‘আমি একা যাচ্ছি হাথরসে। তা হলে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের প্রশ্ন আসছে কোথা থেকে?’’ যুক্তি ধোপে টেকেনি পুলিশের কাছে। রাতের দিকের খবর, ইলাহাবাদ হাইকোর্ট স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে হস্তক্ষেপ করেছে হাথরস-কাণ্ডে। আগামী ১২ অক্টোবর উত্তপ্রদেশ পুলিশ-প্রশাসনের কর্তাদের আদালতে ডেকে পাঠানো হয়েছে।

আরও পড়ুন: ধর্ষণের উল্লেখ নেই হাথরসের নির্যাতিতার ময়নাতদন্ত রিপোর্টে

রাহুলের সঙ্গেই এ দিন ছিলেন সংবাদ মাধ্যমের প্রতিনিধিরাও। কংগ্রেস সাংসদ তাঁদের বলেন, ‘‘পুলিশ আমাকে ধাক্কা মেরে মাটিতে ফেলে দিয়েছে।’’ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর উদ্দেশে তাঁর প্রশ্ন, ‘‘এ দেশে কি শুধু মোদীজিই রাস্তায় হাঁটতে পারবেন? আর কোনও সাধারণ মানুষ পথে নামতে পারবেন না?’’ রাহুলের সঙ্গে এই ব্যবহার মেনে নিতে পারেনি কংগ্রেস। যমুনা এক্সপ্রেসওয়ের পাঁচটি লেন দীর্ঘ ক্ষণ অবরোধ করে যোগী সরকারের বিরুদ্ধে স্লোগান দিয়েছেন কংগ্রেস কর্মী-সমর্থকেরা। বিকেলের দিকে অবশ্য ধীরে ধীরে ফাঁকা হয় এক্সপ্রেসওয়ে।

জ্বলছে প্রতিবাদের আগুন।

বর্তমান কংগ্রেস সভানেত্রী সনিয়া গাঁধী থেকে শুরু করে কংগ্রেসের শীর্ষ নেতৃত্ব এ নিয়ে তীব্র আক্রমণ করেছে বিজেপি এবং যোগী সরকারকে। সনিয়া বলেন, ‘‘বিজেপি তাঁদের শাসিত রাজ্যগুলিতে মহিলাদের সম্ভ্রম রক্ষা করতে পারছে না। নিরাপত্তা দিতে পারছে না। উল্টে কংগ্রেসকে রুখতে ব্যস্ত।’’ প্রিয়ঙ্কার টুইট, ‘‘বর্বর ভাবে লাঠি চালানো হল। দলের বহু কর্মী আহত। উদ্ধত সরকারের এই লাঠি আমাদের দমাতে পারবে না। হাথরসের দলিত বোনের সুরক্ষায় এই পুলিশ আর তাঁদের লাঠি ব্যবহার হলে খুশি হতাম।’’ হাথরস গণধর্ষণ-কাণ্ড এবং রাহুলদের আটকানোর নিন্দায় প্রায় একই সুর আরজেডি, এনসিপি-সহ অধিকাংশ বিজেপি-বিরোধী দলের। উত্তরপ্রদেশের একাধিক জায়গায় প্রতিবাদ-বিক্ষোভ দেখিয়েছে সমাজবাদী পার্টি ও বহুজন সমাজ পার্টির কর্মী-সমর্থকরাও। ‘‘যোগীকে সরান, নয়তো রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করুন’’— দাবি তুলেছেন বিএসপি নেত্রী মায়াবতী। প্রতিবাদ-বিক্ষোভ হয়েছে অন্যান্য রাজ্যেও।

হাথরস কাণ্ডের প্রতিবাদে তেলঙ্গানায় বিক্ষোভ কংগ্রেসের। ছবি: টুইটার থেকে নেওয়া

সরব পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও। রাহুলদের সঙ্গে পুলিশি বিতণ্ডা, ধাক্কাধাক্কির আগেই যোগী সরকার ও বিজেপির বিরুদ্ধে আক্রমণ শানিয়ে তৃণমূল নেত্রী টুইটারে লেখেন, ‘‘হাথরসের দলিত তরুণীকে ঘিরে এই বর্বর এবং লজ্জাজনক-কাণ্ডের নিন্দার কোনও ভাষা নেই। নির্যাতিতার পরিবারকে গভীর সমবেদনা জানাই। আরও লজ্জাজনক ঘটনা, পরিবারের কারও অনুমতি এবং উপস্থিতি ছাড়াই তরুণীর দেহ সৎকার করে দেওয়া। যাঁরা খালি ভোটের জন্য স্লোগান দেন আর লম্বাচওড়া প্রতিশ্রুতি দেন, তাঁদের আসল চেহারাটা সামনে এনে দিয়েছে এই ঘটনা।’’

রাহুল-প্রিয়ঙ্কাদের অভিযানকে কটাক্ষ এবং হাথরসের নির্যাতিতার পাশে দাঁড়ানোর বার্তা দেওয়ার

চেষ্টা করেছে বিজেপি। কৈলাস বিজয়বর্গীয়ের আগে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষক ছিলেন সিদ্ধার্থনাথ সিংহ। যোগীর মন্ত্রিসভায় তিনি স্বাস্থ্যমন্ত্রী। তাঁর কটাক্ষ, ‘‘এটা গাঁধীদের ফোটোশ্যুট।’’ কিছুটা ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা করেছেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মুখতার আব্বাস নকভি। তিনি বলেন, ‘‘যোগী আদিত্যনাথজি এই দুষ্কৃতীদের (হাথরস গণধর্ষণে অভিযুক্ত) কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করেছেন। সমস্ত তদন্তকারী সংস্থাগুলি একসঙ্গে কাজ করছে।’’ কংগ্রেসের বিরুদ্ধে অসংবেদনশীলতার অভিযোগ তুলে তাঁর বক্তব্য, ‘‘কংগ্রেস দলের নেতাদের মধ্যে সংবেদনশীলতা নেই। এই ধরনের স্পর্শকারত বিষয় নিয়েও রাজনীতি? আপনারা রাজনীতির অনেক সুযোগ পাবেন। এই ধরনের ঘটনা নিয়ে রাজনৈতিক পর্যটনের কোনও অধিকার আপনাদের নেই।’’

হাথরস অবশ্য দিনভর লোকচক্ষুর অন্তরালেই থেকে গিয়েছে। রাজনৈতিক নেতা-নেত্রী, সমাজকর্মী, মানবাধিকার সংগঠন বা নারীবাদী সংগঠনের কাউকেই ঢুকতে দেওয়া হয়নি হাথরসের ত্রিসীমানায়। এমনকি, সংবাদমাধ্যমের প্রবেশও নিষিদ্ধ ছিল। করোনার কারণে রাতারাতি হাথরসকে ‘কন্টেনমেন্ট জোন’ ঘোষণা করা হয়েছে। পুলিশ-প্রশাসন বা সরকারি আধিকারিকদের সেই কন্টেনমেন্ট জোনে ঢুকতে যদিও বাধা ছিল না। সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিয়োই তার প্রমাণ। মোবাইল ক্যামেরায় তোলা ওই ভিডিয়োয় হাথরসের জেলাশাসক প্রবীণ লক্সকরকে রীতিমতো শাসাতে দেখা গিয়েছে মৃতার পরিবারের লোকজনকে। হিন্দিতে যা বলতে শোনা গিয়েছে, তার সারকথা, ‘‘কয়েক দিন পর মিডিয়া চলে যাবে। কিন্তু সব সময় আমরাই থাকব। তাই মিডিয়ার সামনে মুখ খুলবেন কি না, ভেবে দেখুন।’’ আনন্দবাজার ডিজিটাল সেই ভিডিয়োর সত্যতা যদিও যাচাই করেনি। এই প্রবীণ লক্সকরের গাড়ির সামনেই মঙ্গলবার রাতে শুয়ে পড়তে দেখা গিয়েছিল মৃতা তরুণীর মাকে। মেয়েকে এক বার দেখার জন্য মাটিতে আঁচল পেতে কাকুতি মিনতি করেছিলেন। কিন্তু সে কথায় কর্ণপাত করেননি প্রবীণ।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy