কানপুরের অদূরে এখানেই হয়েছে বিকাশ দুবের পুলিশি এনকাউন্টার। ছবি: এপি
পুলিশি এনকাউন্টারে বিকাশ দুবের মৃত্যুর ঘটনা সামনে আসার পরেই শুক্রবার সকালে নানা ‘ব্যাখ্যা’ হাজির করেছেন উত্তরপ্রদেশ পুলিশের কর্তারা। ঠারেঠোরে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন, আট পুলিশকর্মীর খুনে অভিযুক্ত বিকাশের মতো নৃশংস গ্যাংস্টারের এমন চটজলদি ‘কঠোরতম সাজা’ প্রয়োজনীয় ছিল। কিন্তু গোটা ঘটনাপর্বে উত্তরপ্রদেশ পুলিশের ‘ভূমিকা’ নিয়ে উঠে আসছে আটটি ‘বেসুরো’ (এবং সঙ্গত) প্রশ্ন।
১. কী ভাবে বিকাশ তার গাড়ি উল্টে যাওয়ার পরে চার পুলিশকর্মীকে এড়িয়ে বাইরে বেরিয়ে এল? কী ভাবেই বা পিস্তল ছিনিয়ে নিয়ে দৌড় দিতে পারল?
উত্তরপ্রদেশ পুলিশের দাবি, দুর্ঘটনায় গাড়ি উল্টে চার জওয়ান জখম হন। সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করে বিকাশ। কিন্তু ‘দুর্ঘটনাগ্রস্ত’ গাড়ির পুলিশকর্মীরা জখম হলেও বিকাশ অক্ষত থাকায় এই ব্যাখ্যা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
স্থানীয় বাসিন্দাদের কয়েকজন এদিন সকালে গুলির আওয়াজ শুনলেও গাড়ি দুর্ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী মেলেনি একজনও। কনভয়ের অন্য গাড়ির পুলিশকর্মীদের নাগাল এড়িয়ে খোলা মাঠের মধ্যে কাঁচা রাস্তা দিয়ে প্রায় ২০০ মিটার ছুটে পালাল, তা নিয়েও ‘রহস্য’ তৈরি হয়েছে। আশপাশের কেউই এমন ঘটনা দেখেননি। শুধু ভারী চেহারা নয়, ৫২ বছরের বিকাশের পায়ে জখম ছিল। ফলে উত্তরপ্রদেশ পুলিশের স্পেশাল টাস্ক ফোর্সের জওয়ানদের হাত এড়িয়ে তার ছুটে পালানোর ‘তথ্য’ অনেকের কাছেই বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছে না। তেমনই একজন পুলিশের প্রাক্তন ডিজি এন সি আস্থানা। এদিন তাঁর টুইট, ‘‘চারিদিকেই তো ফাঁকা মাঠ। বোকাসোকা কোনও মোটা লোকও এমন ক্ষেত্রে ছুটে পালানোর ঝুঁকি নেবে না।’’
OUTRAGEOUS STORY of Vikas Dubey encounter. The vehicle is seen lying "conveniently" on its side, all doors closed. Note the road condition. No reason to overturn "so softly"! Open fields all around! Even a fool with a paunch wud not consider running away in open. pic.twitter.com/8NGT2zx6lT
— Dr. N. C. Asthana, IPS (Retd) (1986-2019) (@NcAsthana) July 10, 2020
২. উল্টে গিয়েও কেন প্রায় অক্ষত গাড়ি?
পুলিশের ব্যাখ্যা, বৃষ্টিভেজা পথে চালক নিয়ন্ত্রণ হারান। কিন্তু অবসরপ্রাপ্ত আইপিএস অফিসার আস্থানা এদিন দুর্ঘটনা নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন। তাঁর টুইট, ‘‘গল্পটা বেশ ভয়ানক। গাড়িটা তো দেখছি সুবিধামতো জায়গাতেই শোয়ানো আছে। চারটি দরজাই বন্ধ। রাস্তার হাল দেখুন। এতো মোলায়েম ভাবে গাড়ি উল্টে যাওয়ার কোনও কারণই নেই।’’
রাস্তার ধারে ‘মোলায়েম ভাবে’ উল্টে যাওয়া ওই সাদা গাড়িটির একটি মাত্র জানলার কাচ ভেঙেছে। বৃষ্টিতে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে যা অস্বাভাবিক বলে মনে করছেন প্রাক্তন পুলিশ আধিকারিকদের অনেকেই। দুর্ঘটনাস্থলের আশপাশে কোনও ‘রোড ব্লকার’ বা ‘ব্যারিকেড’ও নজরে আসেনি। ফলে চালকের ‘আচমকা নিয়ন্ত্রণ হারানোর তত্ত্ব’ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
৩. আত্মসমর্পণের পরেও কেন পালানোর চেষ্টা ?
উজ্জয়িনীতে মধ্যপ্রদেশ পুলিশের কাছে আত্মসমর্ণের পরে ভিড়ের সামনে নিজেকে ‘কানপুরওয়ালা’ বলে পরিচয় দিয়েছিল বিকাশ। আস্থানার প্রশ্ন, বিকাশের যদি পালানোরই মতলব থাকবে, তবে কেন সে মধ্যপ্রদেশে গিয়ে মন্দিরে পুজো দিয়ে আত্মসমর্পণ করল? অভিযোগ, গত এক সপ্তাহে নিজের পাঁচ সঙ্গীর পুলিশ এনকাউন্টারে মৃত্যুর পরে বিকাশও তার ‘পরিণতি’ সম্পর্কে শঙ্কিত হয়ে পড়েছিল। তাই পুলিশি হেফাজতে যাওয়ার সময় নিজের পরিচয় প্রকাশ করে ভেবেছেন, প্রাণ বাঁচানোর সুযোগ মিলবে।
৪. বিকাশ নিকেশের ইঙ্গিত দিয়েছিলেন পুলিশ অফিসার?
সোশ্যাল মিডিয়ায় মধ্যপ্রদেশের এক পুলিশ অফিসারের ভিডিয়ো এদিন ভাইরাল হয়েছে। বৃহস্পতিবার তোলা ভিডিয়োতে ওই উজ্জয়িনীর ওই অফিসারকে বলতে শোনা গিয়েছে, ‘‘আশা করব বিকাশ শেষ পর্যন্ত কানপুর পৌঁছবে না।’’ গতকাল রাতেই সুপ্রিম কোর্টে ধৃত বিকাশের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য আবেদন জানানো হয়েছিল। তার গ্যাংয়ের পাঁচ সদস্যের সাম্প্রতিক পুলিশ এনকাউন্টারের ঘটনার সিবিআই তদন্তের আর্জিও জানানো হয়েছিল শীর্ষ আদালতে। অভিযোগ, সেই আবেদনের শুনানির আগেই বিচার প্রক্রিয়াকে পাশ কাটিয়ে ‘দৃষ্টান্তমূলক শান্তি’র পথ বেছে নিয়েছে উত্তরপ্রদেশ পুলিশ।
আরও পড়ুন: ঠিক আধ ঘণ্টা আগে কেন আটকানো হল মিডিয়ার গাড়ি? দুবে ‘সংঘর্ষে’ রহস্য এখানেও
৫. গন্তব্যে পৌঁছনোর ঠিক আগেই কেন গাড়ি বদল?
এনকাউন্টারের ঘণ্টা তিনেক আগেও ‘দুর্ঘটনাগ্রস্ত’ ওই সাদা গাড়িতে ছিল না বিকাশ। ভোর ৪টে নাগাদ তোলা একটি টোল প্লাজার সিসিটিভি ফুটেজ বলছে, উজ্জয়িনী থেকে কানপুরগামী পুলিশ কনভয়ের অন্য একটি এসইউভি’র সওয়ারি ছিল সে। অর্থাৎ মাঝরাস্তাতে গাড়ি বদল হয়েছিল। উজ্জয়িনী থেকে প্রায় ৬৫০ কিলোমিটার রাস্তা ওই এসইউভি’তেই বিকাশকে আনা হয়েছিল বলে জানাচ্ছেন পুলিশ কনভয়ের সঙ্গী সাংবাদিকেরা। আর সেই গাড়ি বদলানো হয় গন্তব্যে পৌঁছনোর মাত্র কয়েক কিলোমিটার আগে! অবশ্য কানপুর পুলিশের ব্যাখ্যা, নিরাপত্তা জনিত কারণে অনেক সময়ই এ ভাবে গাড়ি বদলে আনা হয় ধৃতকে। এ ক্ষেত্রে কানপুরে বিকাশ গ্যাংয়ের দুষ্কৃতীরা তাকে ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা পারে বলেও আশঙ্কা ছিল বলে পুলিশের সাফাই।
৬. কেন আটকানো হয় সাংবাদিকদের?
উজ্জয়িনী থেকেই পুলিশ কনভয়ের পিছু নিয়েছিল সাংবাদিকদের একটি দল। কিন্তু এদিন ভোর সাড়ে ৬টা নাগাদ কানপুর জেলার সীমানায় সাংবাদিকদের গাড়িগুলি আটকে দেয় উত্তরপ্রদেশ পুলিশ। আর তার আধঘণ্টার মাথায় কয়েক কিলোমিটার দূরেই হয় এনকাউন্টার! এই ‘আশ্চর্য সমাপতন’ নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে এদিন।
৭. তিনটি গুলিই সামনে থেকে কেন?
বিকাশের হাত, কোমর এবং বুকে তিনটি গুলির জখমও ‘সাজানো পুলিশি সংঘর্ষের তত্ত্ব’ সমর্থন করছে বলে এনকাউন্টার বিশেষজ্ঞদের অনেকের ধারণা। তিনটি গুলিই চালানো হয়েছে সামনে থেকে। যদিও এ ক্ষেত্রে কানপুর পুলিশের ব্যাখ্যা, বিকাশকে প্রথমে আত্মসমর্পণ করতে বলা হয়েছিল। কিন্তু সে তা না মেনে পুলিশের দিকে গুলি চালায়। সে সময় পুলিশকর্মীরা পাল্টা গুলি চালালে সে গুরুতর জখম হয়। গুলির লড়াইয়ের কারণেই গুলি লেগেছে সামনে থেকে।
৮. কেন নেই হাতকড়া?
শুধু আট পুলিশকর্মীকে খুন নয়, গত তিন দশক ধরে অন্তত ৬০টি অপরাধের ঘটনায় অভিযুক্ত বিকাশ। এর মধ্যে থানায় ঢুকে প্রতিমন্ত্রী স্তরের রাজনৈতিক নেতাকে খুনের অভিযোগও রয়েছে। খুনের মামলায় সাজাপ্রাপ্ত বিকাশ হাইকোর্টের নির্দেশ জামিন পেয়েছিল। এমন এক অপরাধীকে আনার সময় কেন হাতকড়া পরানো হয়নি, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এক অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ আধিকারিক এদিন বলেন, ‘‘শুধু হাতকড়া নয়, পলাতক, ভয়ঙ্কর অপরাধী বা জঙ্গিদের গাড়িতে নিয়ে যাওয়ার সময় প্রয়োজনে পায়ে শিকলও পরানো হয়।’’
আরও পড়ুন: কানপুরের কাছে গাড়ি দুর্ঘটনা, পালাতে গিয়ে পুলিশের সঙ্গে ‘সংঘর্ষে’ নিহত গ্যাংস্টার বিকাশ দুবে
এই পরিস্থিতিতে উঠে আসছে তদন্তের দাবি। প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বিশিষ্ট আইনজীবী কপিল সিব্বল এদিন টুইট করেন, ‘‘বিকাশ দুবের পুলিশি এনকাউন্টারের সম্ভাবনা আঁচ করেছিলেন অনেকেই। স্বেচ্ছাচারিতা না কি, বিকাশের সঙ্গে কিছু ব্যক্তি ও রাজনৈতিক দলের যোগাযোগের প্রমাণ লোপাটের ষড়যন্ত্র। উত্তরপ্রদেশে পুলিশ-অপরাধী যোগাযোগের তদন্তের জন্য কমিশন গড়া প্রয়োজন।’’ গত বছর তেলঙ্গানায় গণধর্ষণ ও খুনের ঘটনায় ধৃত চার অভিযুক্তের পুলিশি এনকাউন্টারের পরেও এমন কিছু প্রশ্ন সামনে এসেছিল। কিন্ত শেষ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠিত হয় পুলিশের যুক্তি। বিকাশ নিকেশের ক্ষেত্রেও বিধি মেনে ম্যাজিস্ট্রেট পর্যায়ের তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে উত্তরপ্রদেশ প্রশাসন। এখন তার রিপোর্টের প্রতীক্ষা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy