Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Education

নেটের অধিকার না থাকায় বাড়ছে সামাজিক অসাম্য, কোন পথে দেশ…

যে দেশে আর্থিক বৈষম্য গত আধ দশকে ক্রমাগত বেড়েই চলেছে, সেই দেশে কিন্তু নেট দুনিয়ার অধিকার হারানো মানেই আরও বৈষম্যের পথ খুলে যাওয়া।

কোভিড দেখিয়েছে, নেট ব্যবহারের অধিকার শিক্ষার অধিকারের সঙ্গে কী ভাবে জড়িয়ে পড়েছে। —ফাইল চিত্র।

কোভিড দেখিয়েছে, নেট ব্যবহারের অধিকার শিক্ষার অধিকারের সঙ্গে কী ভাবে জড়িয়ে পড়েছে। —ফাইল চিত্র।

সুপর্ণ পাঠক
কলকাতা শেষ আপডেট: ২১ অগস্ট ২০২০ ১২:২৩
Share: Save:

বিজ্ঞান শিক্ষার কেন্দ্র হিসাবে কলকাতার কাছে এই কেন্দ্রীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির দেশজোড়া খ্যাতি। অথচ এমন একটি শিক্ষাকেন্দ্রে পদার্থবিদ্যা নিয়ে উচ্চশিক্ষায় মগ্ন অনেক ছাত্রই নাকি ল্যাপটপ কিনতে পারেন না। কিনতে পারলেও গ্রামের বাড়িতে ফিরে ব্যবহার করার উপায় নেই। কারণ, নেট নেই। তাই এই কোভিড কালে তাঁদের শিক্ষা নিয়ে মাস্টারমশাই ও ছাত্র, দু’পক্ষই চিন্তিত।

ওই প্রতিষ্ঠানের ভ্রাতৃপ্রতিম এক শিক্ষকের সঙ্গে ফোনে কোভিডের নানান দিক নিয়ে আলোচনার সময়েই উঠে এসেছিল এই প্রসঙ্গ। তবে এই গবেষক-শিক্ষকের অনেক বেশি চিন্তা তাঁর স্কুল-পড়ুয়া দুই সন্তানের শিক্ষা নিয়ে। ল্যাপটপে ক্লাস চলে আর ছোটটি নিজের খেলায় মত্ত। তাঁর বক্তব্য: অনলাইন শিক্ষা সম্ভব। কিন্তু ইট সিমেন্টের প্রথাগত ক্লাসরুমের বাইরে গিয়ে শিক্ষকদের শেখাতে হবে এই নেট দুনিয়ার রকমসকম।

তাঁর সন্তানরা পড়ে মধ্যবিত্তের স্কুলে। কালে দিনে এই সব স্কুলের শিক্ষকরা তৈরি হয়ে যাবেন নতুন প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহারে। কিন্তু কী হবে তাঁদের, যাঁদের সন্তানদের শিক্ষা চালু রাখতে গয়না বন্ধক দিতে হচ্ছে স্মার্টফোন কেনার জন্য? কী হবে তাঁদের, যাঁদের সন্তানরা যায় প্রান্তিক স্কুলে, যেখানে শিক্ষকদের কাছেই এই প্রযুক্তি অধরা?

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

যে দেশে আর্থিক বৈষম্য গত আধ দশকে ক্রমাগত বেড়েই চলেছে, সেই দেশে কিন্তু নেট দুনিয়ার অধিকার হারানো মানেই আরও বৈষম্যের পথ খুলে যাওয়া। কোভিড দেখিয়েছে, নেট ব্যবহারের অধিকার শিক্ষার অধিকারের সঙ্গে কী ভাবে জড়িয়ে পড়েছে। যে দেশে আয়ের সিঁড়ির উপরের ১০ শতাংশের হাতে দেশের ৭৭ শতাংশ সম্পদ, সেই দেশে কিন্তু নেট সংযোগের অধিকার না থাকলে শিক্ষার অধিকারও হারাবে। এটা কোভিড চোখে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে। আর শিক্ষার অধিকার হারালে, হারাবে পেট ভরানোর অধিকারও। কী ভাবে তা অন্য আলোচনা দাবি করে। আমরা বুঝে নিই, দেশের বর্তমান হাল এবং ছাত্রদের কাছে শিক্ষা নিয়ে পৌঁছনো নিয়ে কেনই বা এত দুশ্চিন্তা।

আরও পড়ুন: আক্রান্তদের আলাদা বুথ, ভার্চুয়াল সভা, করোনা আবহে ভোট নিয়ে একগুচ্ছ ভাবনা কমিশনের​

নাগরিকের মুঠোয় পরিষেবা, তা সে শিক্ষাই হোক বা ব্যাঙ্ক অথবা সরকারি কাজের সুবিধা, তুলে দিতে গেলে কিন্তু দরকার অনেক কিছুই। যেমন, বিদ্যুৎ সংযোগ, নেট সংযোগ এবং স্মার্ট ফোন বা কম্পিউটার। আর এই বিষয়ে তথ্যগুলি বেশ মজার। আপনাকে যদি বলি, আমরা ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের সংখ্যায় দ্বিতীয়, চিনের পরেই, তক্ষুনি মনে হতেই পারে যে, ‘বাপরে! তা হলে এত কথা কেন?’ এত কথা হচ্ছে কারণ, সংখ্যাটা যদি জনসংখ্যার প্রেক্ষিতে দেখি তা হলে যে সেটা সমুদ্রে শিশির বিন্দু! আমাদের দেশে জনসংখ্যা ১৩৩ কোটি, আর নেট ব্যবহার করেন ৬ কোটি ৮৭ লক্ষ! হিসাবটা টেলিকম রেগুলেটরি অথরিটির বা ট্রাই-এর সাম্প্রতিক সমীক্ষার। মজার ব্যাপার হল, এঁদের মধ্যে ২ কোটি ৪৭ লক্ষ কিন্তু গ্রামে, আর ৪ কোটি ৩৯ লক্ষ হল শহুরে মানুষ। শহরে আবার প্রতি ১০০ জনের মধ্যে ১০৪.২৫ জন নেট ব্যবহার করেন। অর্থাৎ, শহরে এক জনের কাছে একাধিক সংযোগ আছে। কিন্তু গ্রামে প্রতি ১০০ জনে মাত্র ২৭.৫৭ জনের কাছে আছে নেট সংযোগ! অর্থাৎ, দেশের বেশির ভাগ মানুষই যে অঞ্চলের বাসিন্দা সেখানে প্রায় ৭৮ শতাংশ মানুষের কাছেই নেট দুনিয়ার সুযোগ অধরা।

নেটভিত্তিক শিক্ষাদান আমাদের সরকারের নীতির অন্যতম স্তম্ভ। সরকারও যে তা অনুভব করে না, তা-ও বলা যাবে না। প্রমাণ তো নীতিতেই পরিষ্কার। কিন্তু ভারত নেটের প্রসার যে ভাবে ঠেকে গিয়েছে, তাতে সেই নীতি যে কবে বাস্তব হবে তা কেউ বলতে পারে না। তবে প্রধানমন্ত্রীর স্বাধীনতা দিবসের দাবি যদি সত্যি হয়, তা হলে আর তিন বছরের মধ্যেই সবার কাছেই নেট দুনিয়ায় পা রাখার সুযোগ হয়ে যাবে! সে তো ভবিষ্যতের কথা।

নেটভিত্তিক শিক্ষাদান আমাদের সরকারের নীতির অন্যতম স্তম্ভ। —ফাইল চিত্র।

ভারত নেট-তার দিয়ে নেট নিয়ে যাবে গ্রামে গ্রামে। যত দিন তা না হয়, আমাদের ভরসা তারহীন ইন্টারনেট সংযোগ। কিন্তু যদি দেশের অধিকাংশ মানুষের কাছেই নেট সংযোগ না থাকে, আয়ের কারণে বা পরিষেবার অভাবে, তা হলে ছাত্রদের কাছেই বা স্কুল কী ভাবে পৌঁছবে?

আছে আরও প্রশ্ন। শুধু নেট পৌঁছলেই হবে না, সেই নেট ব্যবহার করতে গেলে তো লাগবে যন্ত্রও। কিন্তু যে দেশের মানুষ হাসপাতালে চিকিৎসা করতে গিয়ে হারিয়ে ফেলে গোটা বছরের রোজগার, সে দেশের আয়ের পিরামিডের তলার মানুষেরা কী ভাবে কিনবে এ সব যন্ত্র? সরকারি নীতিতে কিন্তু এর বিশেষ উল্লেখ নেই।

বাংলাদেশের মহম্মদ ইউনুসের দেখানো পথে কিন্তু একটা উপায় আছে। মাইক্রো ফিনান্সের হাত ধরে গোষ্ঠী উদ্যোগের মডেলে বাংলাদেশে যে ভাবে ইকবাল কাদির গ্রামীণ ফোন সংস্থা তৈরি করেছিলেন, সেই পথে তো আমরা এগিয়ে দেখতেও পারি। ইকবাল কাদির, ইউনুসের পথেই গোষ্ঠী উদ্যোগের হাত ধরে গ্রামে গ্রামে ফোন পৌঁছে দিয়েছিলেন।

আরও পড়ুন: কোভিডে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু কলকাতার সহকারী পুলিশ কমিশনারের​

আমাদের দেশেও ইউনুসের পথেই গড়ে উঠেছে গোষ্ঠী উদ্যোগ স্বনির্ভর গোষ্ঠীর নামে। এই গোষ্ঠীগুলিকে কাজে লাগিয়ে ইকবাল কাদিরের মডেলে কি সবার কাছে হাজির করা যায় না নেট দুনিয়া? আমরা কি ভাবব? না হলে আরও বাবা-মা বাধ্য হবেন গয়না বেচতে।

আর তা যদি না হয়, তাহলে শিক্ষার অধিকার আরও সংকুচিত হবে দেশের ক্রমবর্মান দরিদ্র পরিবারের! যার আঘাত কিন্তু উন্নয়ন প্রচেষ্টার উপরই গিয়ে পড়বে। কিন্তু সে আলোচনার পরিসর আলাদা।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy