প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। —ফাইল চিত্র
এই শতকের তৃতীয় দশকটা শুরুই হল এক ওলট-পালট দিয়ে। কোভিড-১৯ নিয়ে এল অসংখ্য ভাঙ্গনকে।
মানুষের ব্যক্তিগত জীবনের রূপরেখাকে করোনাভাইরাস লক্ষণীয় ভাবে বদলে দিয়েছে।
আজ বাড়িই হয়ে উঠেছে নতুন অফিস।
ইন্টারনেট হয়ে দাঁড়িয়েছে নতুন মিটিং রুম।
সাময়িক ভাবে কাজের ফাঁকে সহকর্মীদের সঙ্গে আড্ডাকে আজ ইতিহাস বলে মনে হচ্ছে।
আমিও এই পরিবর্তনগুলোর সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে চেষ্টা করছি। বেশির ভাগ মিটিং, তা আমার মন্ত্রী-সহকর্মীদের সঙ্গেই হোক, আধিকারিকদের সঙ্গেই হোক অথবা বিশ্বের অন্য দেশের নেতৃত্বের সঙ্গেই হোক, এখন ভিডিয়ো কনফারেন্সের মাধ্যমে সারতে হচ্ছে।
বিভিন্ন বিষয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কাছ থেকে তৃণমূলস্তরের প্রতিবেদন পেতে সমাজের বিভিন্ন মহলের সঙ্গে ভিডিয়ো কনফারেন্স মিটিংই ভরসা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ ভাবেই বিভিন্ন এনজিও, সিভিল সোসাইটি গ্রুপ এবং কমিউনিটি সংস্থাগুলির সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। রেডিও জকিদের সঙ্গেও কথাবার্তা হয়েছে।
এ সব ছাড়াও আমি প্রত্যেক দিন অসংখ্য ফোন করি, তার মাধ্যমে সমাজের বিভিন্ন অংশের প্রতিক্রিয়া জানতে পারি।
এই দিনগুলিতে কী ভাবে মানুষ তাঁদের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন, তা দেখা যাচ্ছে। ফিল্ম তারকারাও বিভিন্ন সৃজনশীল ভিডিয়ো তৈরি করে ঘরে থাকার প্রয়োজনীয় বার্তাকে তুলে ধরছেন। গায়করা অনলাইন কনসার্ট করেছেন। দাবা খেলোয়াড়রা ডিজিটাল মাধ্যমে দাবা খেলে কোভিড-১৯-এর সঙ্গে লড়াইয়ের বার্তা দিয়েছেন। এ সব কিছুই খুব মৌলিক।
কাজের ক্ষেত্রটা ক্রমেই ডিজিটাল হয়ে যাচ্ছে। আর হবে না-ই বা কেন?
প্রযুক্তির পরিবর্তনের প্রভাব দেশের দরিদ্র মানুষের জীবনে প্রায়শই পড়ে। প্রযুক্তিই আমলাতান্ত্রিক স্তরবিভাজন, দালালশ্রেণির দাপটকে দূর করে, কল্যাণকর পদক্ষেপ করতে সাহায্য করে।
আপনাদের একটা উদাহরণ দিই।
২০১৪-এ যখন আপনাদের সেবায় আসার সু্যোগ পেলাম, আমরা ভারতীয়দের, বিশেষ করে দরিদ্র মানুষের জন ধন অ্যাকাউন্ট, আধার এবং মোবাইল নম্বর সংযুক্তির কাজ শুরু করি। এই সরল সংযোগ কেবল দশকের পর দশক ধরে চলে আসা দুর্নীতি অথবা অন্যায্য মুনাফা লাভকে রুখে দেয়নি, সেই সঙ্গে একটা মাত্র বোতাম টিপে সরকারের ঘর থেকে টাকা পাওয়ার ব্যাপারটাকেও সম্ভব করে তোলে। এই একটি মাত্র বোতাম টেপার বিষয়টা পাঁজা পাঁজা ফাইল ঘাঁটা আর সপ্তাহের পর সপ্তাহ অপেক্ষা করার যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দেয়।
এই ধরনের পরিকাঠামো সম্ভবত ভারতেই সর্ববৃহৎ। কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে এই পরিকাঠামো আমাদের সরাসরি টাকা লেনদেনে বিরাট ভাবে সাহায্য করেছে, লাভবান হয়েছেন দরিদ্র মানুষ, লাভবান হয়েছে কোটি কোটি পরিবার।
শিক্ষা ক্ষেত্র আর একটি বড় উদাহরণ। এই ক্ষেত্রে বহু প্রতিভাবান পেশাদার মানুষ ইতিমধ্যেই কাজে লিপ্ত। এই ক্ষেত্রে প্রযুক্তিগত উন্নতির সুফলও পাওয়া গিয়েছে। ভারত সরকার শিক্ষকদের সাহায্যার্থে এবং ইন্টারনেট ভিত্তিক পড়াশোনাকে উদ্দীপিত করতে ‘দীক্ষা’ পোর্টালের মতো উদ্যোগ নিয়েছে। শিক্ষার গুণগত মানের উন্নতি, তার সমান প্রসার এবং সকলের কাছে তার পৌঁছনোকে সুগম করতে ‘স্বয়ম’-এর মতো প্রকল্প গৃহিত হয়েছে। ই-বুক এবং পড়াশোনার জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণকে সহজলভ্য করার জন্য খোলা হয়েছে ‘ই-পাঠশালা’, যা দেশের বিভিন্ন ভাষায় লভ্য।
আরও পড়ুন: সঙ্গত কারণ না দেখিয়ে রাজ্যে কেন কেন্দ্রীয় দল? প্রশ্ন তুললেন মমতা
আজ পৃথিবী নতুন বাণিজ্যিক মডেলের সন্ধানে।
যৌবনদৃপ্ত ভারত তার উদ্ভাবক চরিত্রের কারণে আজ সুপরিচিত এবং সেই বিন্দু থেকে আজ এক নতুন কর্মসংস্কৃতির বিষয়ে নেতৃত্ব দিতে প্রস্তুত।
আমি দেখতে পাচ্ছি, এই নতুন বাণিজ্য এবং কর্মসংস্কৃতি আজ এমন এক জায়গায় দাঁড়িয়ে, যাকে আমরা ইংরেজি ভাষার ভাওয়েল (স্বরবর্ণ)-এর সঙ্গে তুলনা করতে পারি। ভাওয়েল ছাড়া যেমন কোনও শব্দ গঠন সম্ভব নয়, তেমনই কোভিড-উত্তর বিশ্বে তা হয়ে দাঁড়াতে পারে যে কোনও বাণিজ্য মডেলের একান্ত উপাদান। A (এ), E (ই), I (আই), O (ও), U (ইউ)—এই পাঁচটি ভাওয়েলের মডেলে আমরা বিষয়টিকে সাজাতে পারি।
Adaptability: (মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা)
সহজে যাতে এই ব্যবসায়িক ও জীবন যাপন সংক্রান্ত মডেল গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে, এই মুহূর্তে সেটা দেখা জরুরি।
এর দ্বারা যে কোনও সঙ্কটের সময়ে কোনও জীবনহানি না ঘটিয়ে আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য, দফতর ইত্যাদি যাতে দ্রুততর ভাবে কাজ করতে পারে, তা নিশ্চিত করা যায় ।
ডিজিটাল লেনদেনের বিষয়টি এই গ্রহণযোগ্যতার সব থেকে বড় উদাহরণ। বড় থেকে ছোট দোকানদারের তরফে ডিজিটাল মাধ্যমে নির্ভর করা প্রয়োজন, যাতে সঙ্কটের সময়েও ব্যবসা বন্ধ না হয়ে যায়। এর মধ্যেই ভারত ডিজিটাল লেনদেনে এক উৎসাহব্যঞ্জক প্রবাহকে প্রত্যক্ষ করেছে।
আর একটা উদাহরণ টেলিমেডিসিন। ডাক্তারখানা বা হাসপাতালে না গিয়েও চিকিৎসা সংক্রান্ত পরামর্শ যে নেওয়া যায়, তা আমরা আজ দেখতে পাচ্ছি। এটা অবশ্যই একটা ইতিবাচক দিক। আমরা কি আশা করতে পারি, বিশ্বে টেলিমেডিসিনকে এই বাণিজ্যিক মডেলগুলিই সাহায্য করতে চলেছে?
Efficiency (দক্ষতা)
সম্ভবত এই সময়েই আমরা দক্ষতা-র অন্য অর্থকে কল্পনা করতে পারি।
আমরা কত ক্ষণ অফিসে সময় কাটালাম, দক্ষতা নিশ্চয়ই তার উপরে নির্ভর করে না।
আমরা বরং সেই সব মডেলের কথা ভাবতে পারি, যেখানে প্রচেষ্টার বাইরের চেহারার চাইতে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হল উৎপাদনশীলতা আর দক্ষতা।
দক্ষতার অর্থ হওয়া উচিত একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কোনও কাজ শেষ করার ক্ষমতা।
আরও পড়ুন: করোনা আক্রান্তদের ৮০ শতাংশই উপসর্গহীন, দুশ্চিন্তায় আইসিএমআর
Inclusivity (অন্তর্ভুক্তিকরণের ক্ষমতা)
আমরা সেই সব বাণিজ্যিক মডেল গড়ে তুলতে উদ্যোগ নিই, যা দরিদ্র মানুষকে তার সঙ্গে সংযুক্ত করতে পারবে, যুক্ত করতে পারবে দুর্বল মানুষকে, যুক্ত করতে পারবে আমাদের এই গ্রহকেও।
জলবায়ুগত পরিবর্তনের সঙ্গে লড়াই করার ক্ষেত্রে আমরা যথেষ্ট অগ্রগতির পরিচয় রেখেছি। প্রকৃতি তার বিশালত্বকে আমাদের সামনে উন্মোচিত করেছে, আমাদের দেখিয়েছে যখন মানবিক কর্মকাণ্ড অপেক্ষাকৃত ধীর, তখন কত দ্রুত প্রকৃতি তার কাজ করে যেতে পারে। এই গ্রহের পরিবেশের উপরে মানবিক ক্রিয়াকাণ্ডের প্রভাব কমাতে উপযুক্ত প্রযুক্তি এবং অভ্যাসগুলিকে নির্ণয় করতে হবে— এটা এই সঙ্কট আমাদের শেখাল।
কোভিড-১৯ অতিমারি আমাদের এ কথা বোঝাতে সমর্থ হয়েছে যে, কম খরচে স্বাস্থ্য বিষয়ক সমস্যার সমাধান কতটা প্রয়োজন। সভ্যতার সার্বিক কল্যাণ ও স্বাস্থ্য সংরক্ষণের ব্যাপারে বিশ্বের উদ্যোগগুলির সামনে ভারত আজ পথপ্রদর্শকের ভূমিকা নিতে পারে।
আমাদের উচিত এমন সব আবিষ্কারে অর্থ বিনিয়োগ করা, যাতে আমাদের কৃষকরা তথ্য, যন্ত্র ও বাজারকে হাতের মুঠোয় পেতে পারেন। পরিস্থিতি যেমনই হোক, আমাদের নাগরিকদের কাছে যেন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের জোগান অব্যাহত থাকে।
Opportunity (সুযোগ)
প্রতিটি সঙ্কটই কিছু সুযোগকে সামনে নিয়ে আসে। কোভিড-১৯-ও তার ব্যতিক্রম নয়।
আমরা বরং সেই সব সুযোগ বা উন্নয়নের ক্ষেত্রগুলিকে চিহ্নিত করে মূল্যায়িত করে রাখতে পারি এই মুহূর্তে।
প্রতিযোগিতার বাইরে গিয়েই ভারত কোভিড-উত্তর বিশ্বে এগিয়ে থাকতে পারে। বরং সেই দিকে আমরা ভাবি, যাতে আমাদের জনশক্তি, আমাদের দক্ষতা, আমাদের সামর্থকে ব্যবহার করে আমরা সেই জায়গায় পৌঁছতে পারি।
Universalism (সর্বজনীনতা)
কোভিড-১৯ হানা দেওয়ার আগে জাত, ধর্ম, বর্ণ, সম্প্রদায়, ভাষা অথবা সীমান্তকে বিচার করেনি।
এর প্রত্যুত্তরে আমাদেরও ঐক্যবদ্ধ থাকা প্রয়োজন, ভ্রাতৃত্ববোধের উপর সর্বাপেক্ষা গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন।
আমরা এই পরিস্থিতিতে একত্রেই রয়েছি।
ইতিহাসে বহু বার রাষ্ট্র ও সমাজ পরস্পরের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে, কিন্তু আজ আমরা এক সাধারণ শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করছি একসঙ্গে। আমাদের ভবিষ্যৎ ঐক্যবদ্ধতার, সহনশীলতার।
ভারত থেকে উদ্গত বৃহৎ ধারণাগুলি এর পর থেকে বিশ্বজনীন হয়ে উঠবে, আবিশ্ব গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠবে। শুধু ভারত নয়, মানব সভ্যতার কাছেই তা ইতিবাচক পরিবর্তনের দিশারি হয়ে দাঁড়াবে।
সংযোগ ও সরবরাহকে এতকাল রাস্তা, গুদাম, বন্দর ইত্যাদির নিরিখে দেখা হয়ে এসেছে। কিন্তু আজ বিশেষজ্ঞরা বাড়িতে বসেই পৃথিবীর সরবরাহ ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন।
বাস্তব ও ভারচুয়াল— দুই পরিস্থিতির যথাযথ সংমিশ্রণ দ্বারা ভারত কোভিড-১৯ পরবর্তী বিশ্বে বহুজাতিক সরবরাহ ব্যবস্থার আধুনিকতম প্রযুক্তির স্নায়ুকেন্দ্র হয়ে উঠতে পারে। এই সুযোগ আমাদের গ্রহণ করা উচিত।
আমি চাই আপনারা এ বিষয়ে ভাবতে শুরু করুন এবং এই আলোচনায় অংশগ্রহণ করুন।
বাই ইওর ওন ডিভাইস থেকে ওয়ার্ক ফ্রম হোম-এ পরিবর্তনের এই ঘটনা কর্মক্ষেত্র ও ব্যক্তিগত জীবনে সমতা আনার ক্ষেত্রে নতুন কিছু চ্যালেঞ্জকে সামনে নিয়ে এসেছে। যাই হয়ে থাকুক, নিজেকে সচল রাখা ও সেই কারণে ব্যায়াম করার প্রতি নজর দিন। শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতিসাধনে যোগাভ্যাস করুন।
ভারতের পরম্পরাগত চিকিৎসা ব্যবস্থাগুলি শরীরকে সচল রাখতে সাহায্য করে। আয়ুষ মন্ত্রক সুস্থ থাকার উপায়ের এক খসড়াকে আপনাদের সামনে পেশ করছে, এটি পড়ে দেখতে পারেন।
পরিশেষে একটা জরুরি কথা, আরোগ্য সেতু মোবাইল অ্যাপ ডাউনলোড করুন। এটা ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে তৈরি একটা অ্যাপ, যা প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে কোভিড-১৯-এর সম্ভাব্য ছড়িয়ে পড়াকে রোধ করার উদ্দেশ্যে নির্মিত। যত বেশি এর ডাউনলোড হবে, তত বেশি এটি কার্যকর হয়ে উঠবে।
আপনাদের সকলের কাছ থেকে উত্তরের প্রত্যাশায় রইলাম...
(প্রধামনমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তাঁর এই লেখাটি প্রকাশ করেছেন ‘লিঙ্কড ইন’-এ)
গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy