তিন দিনে নয় থেকে দশ লাখে পৌঁছল দেশে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা। গ্রাফিক-শৌভিক দেবনাথ।
২ জুলাই ৬ লাখ। ৭ জুলাই ৭ লাখ। ১১ জুলাই ৮ লাখ। ১৪ জুলাই ৯ লাখ। ১৭ জুলাই ১০ লাখ। এই পরিসংখ্যান দেশের করোনাভাইরাস সংক্রমণের। তারিখগুলোর মধ্যের ব্যবধান ক্রমেই কমছে ৫, ৪, ৩ দিন— এই ভাবে বাড়তে বাড়তে শুক্রবার দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ছাড়িয়ে গেল ১০ লাখ। নতুন সংক্রমণের সংখ্যা রোজদিন বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। শুক্রবার সকালে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের দেওয়া পরিসংখ্যানেও সেই একই প্রবণতা। গত ২৪ ঘণ্টায় ৩৪ হাজার ৯৫৬ জন নতুন করে সংক্রমিত হয়েছেন। ২৪ ঘণ্টার নিরিখে যা এখনও অবধি সর্বোচ্চ। এ নিয়ে দেশে মোট আক্রান্ত হলেন ১০ লক্ষ তিন হাজার ৮৩২ জন। আক্রান্তের সঙ্গে সংক্রমণের হারও ঊর্ধ্বমুখী। প্রতিদিন যে সংখ্যক মানুষের টেস্ট হচ্ছে, তার মধ্যে যত শতাংশের রিপোর্ট কোভিড পজিটিভ আসছে, সেটাকেই বলা হচ্ছে ‘পজিটিভিটি রেট’ বা সংক্রমণের হার। গত ২৪ ঘণ্টায় দেশে সংক্রমণের হার ৯.৮ শতাংশ।
বৃহস্পতিবারই বেঙ্গালুরুর ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স (আইআইএসসি)-এর একটি সমীক্ষা হাড় হিম করা পরিসংখ্যান দিয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, এখনকার হারে বাড়তে থাকলে আর মাত্র দেড় মাসে অর্থাৎ সেপ্টেম্বরের গোড়ায় দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা পৌঁছে যেতে পারে ৩৫ লক্ষ। কিন্তু সেখানেই কি শেষ? তার পর কি কমবে? আপাতত উত্তর জানা নেই কারও।
আক্রান্তের পাশাপাশি ধারাবাহিক ভাবে বেড়ে মৃত্যু ছাড়াল সাড়ে ২৫ হাজার। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রকের পরিসংখ্যান অনুসারে গত ২৪ ঘণ্টায় করোনার জেরে মৃত্যু হয়েছে ৬৮৭ জনের। এ নিয়ে দেশে মোট ২৫ হাজার ৬০২ জনের প্রাণ কাড়ল করোনাভাইরাস। এর মধ্যে মহারাষ্ট্রেই মারা গিয়েছেন ১১ হাজার ১৯৪ জন। মৃত্যুর তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে থাকা দিল্লিতে প্রাণ গিয়েছে তিন হাজার ৫৪৫ জনের। দু’হাজার ২৩৬ জনের প্রাণহানি নিয়ে মৃত্যু-তালিকার তৃতীয় স্থানে তামিলনাড়ু। গুজরাতে দু’হাজার ৮৯ জন প্রাণ হারিয়েছেন করোনার কারণে। লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ে কর্নাটকে মৃত্যু সংখ্যা এক হাজার ছাড়াল। সেখানে এক হাজার ৩২ জনের মৃত্যু হয়েছে করোনার কারণে। এর পরই রয়েছে উত্তরপ্রদেশ (১,০৪৬) ও পশ্চিমবঙ্গ (১,০২৩)। উল্লেখযোগ্য মৃত্যু তালিকায় রয়েছে মধ্যপ্রদেশ (৬৮৯), রাজস্থান (৫৩৮), অন্ধ্রপ্রদেশ (৪৯২), তেলঙ্গানা (৩৯৬), হরিয়ানা (৩২২), পঞ্জাব (২৩০), জম্মু ও কাশ্মীর (২২২), বিহার (১৯৭)। বাকি রাজ্যগুলিতে মৃতের সংখ্যা এখনও ১০০ পেরোয়নি। তবে শেষ ক’দিনে কর্নাটক ও অন্ধ্রপ্রদেশে দৈনিক মৃত্যু সংখ্যা বৃদ্ধি উদ্বেগ বাড়াচ্ছে বিশেষজ্ঞদের।
শুরু থেকেই মহারাষ্ট্রে বল্গাহীন ভাবে বেড়েছে সংক্রমণ। গোড়া থেকেই এই রাজ্য সংক্রমণের শীর্ষে রয়েছে। তার পর সময় যত গড়িয়েছে, এই রাজ্য নিয়ে সারা দেশের শঙ্কা বেড়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় সাড়ে আট হাজারেরও বেশি নতুন সংক্রমণের জেরে সে রাজ্যে মোট আক্রান্ত হলেন দু’লক্ষ ৮৪ হাজার ২৮১ জন। দৈনিক চার- সাড়ে চার হাজারের করে বেড়ে তামিলনাড়ুতে মোট আক্রান্ত হয়েছে এক লক্ষ ৫৬ হাজার ৩৬৯ জন। তুলনায় রাজধানী দিল্লিতে দৈনিক সংক্রমণে কিছুটা হলেও লাগাম পড়েছে। সেখানে মোট আক্রান্তের সংখ্যা এক লক্ষ ১৮ হাজার ৬৪৫ জন।
কর্নাটকেও আক্রান্ত সংখ্যা হু হু করে বেড়ে ৫০ হাজার ছাড়াল। সেখানে মোট আক্রান্ত ৫১ হাজার ৪২২ জন। ৪৫ হাজার ৪৮১ আক্রান্ত নিয়ে পঞ্চমে গুজরাত। উত্তরপ্রদেশ (৪৩,৪৪১), তেলঙ্গানা (৪১,০১৮), অন্ধ্রপ্রদেশে (৩৮,০৪৪) ও পশ্চিমবঙ্গে (৩৬,১১৭) আক্রান্তের সংখ্যা রোজদিন উল্লেখযোগ্য হারে বেড়ে চলেছে। এর পর ক্রমান্বয়ে রয়েছে রাজস্থান, হরিয়ানা, বিহার, মধ্যপ্রদেশ, অসম, ওড়িশা, জম্মু ও কাশ্মীরের মতো রাজ্য। কেরলে আক্রান্ত আজ ১০ হাজার ছাড়াল। পঞ্জাবেও দশ হাজার ছুঁইছুঁই। ছত্তীসগঢ়, ঝাড়খণ্ড, উত্তরাখণ্ড, গোয়া, ত্রিপুরার মোট আক্রান্ত এখনও ১০ হাজারের কম।
ভারতে করোনা সংক্রমণের সূত্রপাত কেরল থেকে। দক্ষিণের এই রাজ্যে প্রথম করোনা সংক্রমণ ধরা পড়েছিল উহান ফেরত এক জনের দেহে। সেটা ছিল ৩০ জানুয়ারি। সেই এক থেকে আক্রান্তের সংখ্যা ১০ লাখে পৌঁছল মাত্র সাড়ে পাঁচ মাসে। করোনাভাইরাসের সংক্রমণের ক্ষমতা এতটাই বেশি যে কোনও আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে এলে তাঁরও সংক্রমণের ঝুঁকি থাকে অত্যন্ত বেশি। তাই আক্রান্তের সংখ্যা যত বাড়ে, তাঁ
সেই দিক থেকে দেখলে অবশ্য এক লক্ষ থেকে দুই বা তিন বা দশ লক্ষে পৌঁছনোর মাঝের সময়ের ব্যবধানের তুলনা করা চলেনা। কিন্তু তবু আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধির প্রবণতা বুঝতে এটা সাহায্য করে। তাই আক্রান্তের সংখ্যা ১ লক্ষের গণ্ডিতে ভাগ করে দেখা যাচ্ছে ১ থেকে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ১ লাখে পৌঁছতে সময় লেগেছিল ১১০ দিন। এক লাখ থেকে দু’লাখে পৌঁছতে সেই সময় লেগেছে মাত্র ১৫ দিন। দুই থেকে তিন লাখে ১০ দিন, তিন থেকে থেকে চার লাখে ৮ দিন, চার থেকে পাঁচ লাখে ৬ দিন, পাঁচ থেকে ছ’লাখে ৫ দিন, ছয় থেকে সাত লাখে ৫ দিন, সাত থেকে আট লাখে ৪ দিন, আট থেকে ন’লাখে ৩ দিন সময় লেগেছে। শেষ ন’লাখ থেকে দশ লাখে পৌঁছতে অবশ্য আগের মতোই ৩ দিনই সময় লেগেছে। অর্থাৎ শেষ পাঁত লক্ষ সংক্রমণ হয়েছে মাত্র ২০ দিনে। এই সংক্রমণ বৃদ্ধির হার না কমলে এই ব্যবধান যে ক্রমেই কমতে থাকবে তা বলাই বাহুল্য। ফলে উদ্বেগ বাড়ছে সব মহলে।
উদ্বেগের কারণ রয়েছে পাঁচ দিনের মুভিং অ্যাভারেজ বা চলন্ত গড়েও। কোনও একটি চলমান বিষয়ের কোনও একটি দিনের পরিসংখ্যান তার আগের দু’দিন এবং দু’দিন পরের হিসেবের গড়কেই পাঁচ দিনের চলন্ত গড় বলা হয়। করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সমান তালে বেড়েছে এই চলন্ত গড়ও। মার্চের ৪ তারিখে এই গড় ছিল ৬। অর্থাৎ ওই পাঁচ দিনে গড়ে ৬ জন মানুষ নতুন করে আক্রান্ত হয়েছেন। ৩১ মার্চে এসে সেই গড় হয়ে যায় ২৩০। আবার এক মাস পর ৩০ এপ্রিল এই গড় ছিল ১ হাজার ৮৭৯। ৩১ মে পাঁচ দিনের চলন্ত গড় পৌঁছে গিয়েছে ৮ হাজার ৭৫-এ। ৩০ জুন এই অঙ্ক ছিল ১৯,১৩৮। ১৪ জুলাই এই গড় ছিল ২৯,৫৯২।
(গ্রাফের উপর হোভার বা টাচ করলে প্রত্যেক দিনের পরিসংখ্যান দেখতে পাবেন। চলন্ত গড় কী এবং কেন তা লেখার শেষে আলাদা করে বলা হয়েছে।)
কিন্তু সবচেয়ে ভয়ের বিষয় হল, কোথায় গিয়ে এই সংক্রমণ থামবে তার কোনও স্পষ্ট দিশা নেই। বৃহস্পতিবার আইআইএসসি যে সমীক্ষার পরিসংখ্যান দিয়েছে তাতে শঙ্কাটা এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে কার্যত ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়তে পারে করোনাভাইরাস। এই সংক্রমণের হার রুখতে না পারলে পরিস্থিতি এমন হতে পারে যে হাসপাতালে স্থান সংকুলান হবে না এত মানুষের। তাই আপাতত সুনির্দিষ্ট কোনও প্রতিষেধক বা টিকা আসা পর্যন্ত দু’গজ দূরত্ব, সাবান দিয়ে হাত ধোয়া, স্যানিটাইজার-মাস্ক-সহ যাবতীয় সাবধানতা আর স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা ছাড়া আর কোনও উপায় নেই। সঙ্গে চাই ইমিউনিটি বাড়ানোর প্রচেষ্টা। প্রোটিন ও ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবার রাখতে হবে প্রতিদিনের মেনুতে। কিন্তু করোনাভাইরাস প্রতিরোধ বা নির্মূলের প্রশ্নে বিজ্ঞানী-গবেষক-বিশেষজ্ঞরাও দিশাহারা।
দিশা নেই টিকা আবিষ্কারেও। দৌড়ে এখনও পর্যন্ত সবচেয়ে এগিয়ে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানী-গবেষকরা। পরীক্ষামূলক প্রয়োগের প্রায় শেষ স্তরে তাঁদের টিকা রয়েছে বলে দাবি করেছেন তাঁরা। অক্টোবরকে লক্ষমাত্রা ধরে নিয়ে এগোলেও অনেকেই বলছেন, ২০২১ এর আগে টিকা চূড়ান্ত হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। আবার আমাদের দেশে ভারত বায়োটেকের তৈরি টিকার অগ্রগতিও ভাল। ১৫ অগাস্ট স্বাধীনতা দিবসের দিন প্রধানমন্ত্রী টিকা আবিষ্কারের ঘোষণা করতে পারেন বলে জোর জল্পনা শুরু হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কেন্দ্রও তা নিয়ে আর উচ্চবাচ্য করছে না। এমনও ইঙ্গিত মিলেছে যে, ২০১২১ এর আগে এ দেশেও টিকা তৈরি করা সম্ভব নাও হতে পারে। সব মিলিয়ে সংক্রমণ রোখা থেকে টিকা আবিষ্কার— সামনের দিকে তাকালে সবটাই যেন এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের অশনি সঙ্কেত।
তবে এত অনিশ্চয়তা, এত শঙ্কার মধ্যেও আলোকবর্তিকার মতো একটাই স্বস্তির খবর, ইউরোপ-আমেরিকার তুলনায় ভারতে মৃত্যুর হার অনেক কম। এখন চিকিৎসকরা এমনটাও বলছেন যে কার্যত কো-মর্বিডিটি অর্থাৎ অন্য কোনও অসুস্থতা না থাকলে শুধুমাত্র করোনার কারণে মৃত্যুর ঝুঁকি অত্যন্ত কম। কেন কম, সেটা গবেষণার বিষয়। কিন্তু তাতে কিছুটা হলেও আশা জেগেছে। আবার কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রক এবং বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখনও পর্যন্ত গোষ্ঠী সংক্রমণ হয়নি ভারতে। আবার জনসংখ্যা অনুযায়ী সংক্রমণেও ভারত ভাল জায়গায় রয়েছে। সারা বিশ্বে জনসংখ্যার দিক থেকে দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ হলেও সংক্রমণের নিরিখে এখনও ভারত তৃতী স্থানে। ভারতের উপরে রয়েছে ব্রাজিল এবং আমেরিকা।
আবার সুস্থ হয়ে ওঠার হিসেবও স্বস্তি দিয়েছে ভারতবাসীকে। এখন দে
(গ্রাফের উপর হোভার বা টাচ করলে প্রত্যেক দিনের পরিসংখ্যান দেখতে পাবেন। চলন্ত গড় কী এবং কেন তা লেখার শেষে আলাদা করে বলা হয়েছে।)
(চলন্ত গড় বা মুভিং অ্যাভারেজ কী: একটি নির্দিষ্ট দিনে পাঁচ দিনের চলন্ত গড় হল— সেই দিনের সংখ্যা, তার আগের দু’দিনের সংখ্যা এবং তার পরের দু’দিনের সংখ্যার গড়। উদাহরণ হিসেবে— দৈনিক নতুন করোনা সংক্রমণের লেখচিত্রে ১৮ মে-র তথ্য দেখা যেতে পারে। সে দিনের মুভিং অ্যাভারেজ ছিল ৪৯৫৬। কিন্তু সে দিন নতুন আক্রান্তের প্রকৃত সংখ্যা ছিল ৫২৬৯। তার আগের দু’দিন ছিল ৩৯৭০ এবং ৪৯৮৭। পরের দুদিনের সংখ্যা ছিল ৪৯৪৩ এবং ৫৬১১। ১৬ থেকে ২০ মে, এই পাঁচ দিনের গড় হল ৪৯৫৬, যা ১৮ মে-র চলন্ত গড়। ঠিক একই ভাবে ১৯ মে-র চলন্ত গড় হল ১৭ থেকে ২১ মে-র আক্রান্তের সংখ্যার গড়। পরিসংখ্যানবিদ্যায় দীর্ঘমেয়াদি গতিপথ সহজ ভাবে বোঝার জন্য এবং স্বল্পমেয়াদি বড় বিচ্যুতি এড়াতে এই পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy