ছবি: রয়টার্স।
আগামী ১৫ অগস্টের মধ্যে ভারতের বাজারে আসতে চলেছে কোভিডের প্রতিষেধক বা টিকা কোভ্যাক্সিন। হায়দরাবাদের ভারত বায়োটেক ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড (বিবিআইএল)-এর সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে ওই প্রতিষেধক বাজারে আনছে ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব মেডিক্যাল রিসার্চ (আইসিএমআর)। দাবি মতো ১৫ অগস্ট যদি সত্যিই টিকা বাজারে আসে, তা হলে ভারত প্রথম দেশ হিসেবে করোনার টিকা আবিষ্কারের স্বীকৃতি পাবে। সূত্রের মতে, স্বাধীনতা দিবসে লালকেল্লা থেকে ওই টিকা আবিষ্কারের কথা ঘোষণা করার কথা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর। প্রথম ধাপে চিকিৎসক ও নার্সদের মতো স্বাস্থ্যকর্মী, যাঁরা করোনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সামনের সারিতে, তাঁদের ওই টিকা দেওয়া হবে।
আজ আইসিএমআরের প্রধান বলরাম ভার্গব চিঠি লিখে ওই টিকা বাণিজ্যিক ভাবে ব্যবহারের আগে দেশের ১২টি সংস্থাকে ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল বা মানুষের উপর প্রয়োগ করে দেখার ছাড়পত্র দিয়েছেন। প্রথম দেশীয় প্রতিষেধকের ক্লিনিক্যাল প্রয়োগের প্রশ্নে দিল্লির এমস ছাড়া ওড়িশার এসইউএম , বিশাখাপত্তনমের কিং জর্জ কলেজ, রোহতকের পিজিআইএমএসের মতো ডজনখানেক সংস্থা বাছা হয়েছে। ৭ জুলাইয়ের মধ্যে স্বেচ্ছাসেবকদের উপর ওই টিকার পরীক্ষামূলক প্রয়োগ শুরু হবে। আজ আইসিএমআর জানিয়েছে, কোভিডের মতো সংক্রমণ রুখতে ও দ্রুত প্রতিষেধক বাজারে আনার তাগিদে ওই সংস্থাগুলিকে সমস্ত প্রয়োজনীয় ছাড়পত্র দ্রুত জোগাড় করে কাজ শুরু করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। যার অর্থ, হাতে সময় মাত্র পাঁচ সপ্তাহ। তার মধ্যে মানবদেহে পরীক্ষা শেষ করে, তার ভালমন্দ বিচার করে ১৫ অগস্টের মধ্যে বাজারে প্রতিষেধক ছাড়তে হবে ভারত বায়োটেককে। ভার্গব চিঠিতে লিখেছেন, প্রকল্পটির নজরদারি চলছে সরকারের একেবারে শীর্ষ স্তর থেকে। নির্দেশ না মানলে কঠোর মনোভাব নেবে সরকার।
প্রশ্ন উঠেছে, যে কোনও প্রতিষেধক বা টিকা আবিষ্কারের প্রশ্নে ন্যূনতম কিছু ধাপ থাকে। প্রতিষেধকটি আদৌ সুরক্ষিত কি না, তা প্রতিটি ধাপে পরীক্ষা করে দেখা হয়ে। যা সময়সাপেক্ষ। এ ক্ষেত্রে মাত্র পাঁচ সপ্তাহে কী করে সেই পর্বটি শেষ করা সম্ভব, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন ভাইরোলজিস্ট প্রদীপ শেঠ। এমসের ওই প্রাক্তন চিকিৎসকের কথায়, ‘‘মাত্র পাঁচ সপ্তাহে প্রতিষেধক কী ভাবে সম্ভব!’’ তাঁর বক্তব্য, ধরে নেওয়া হচ্ছে ভারত বায়োটেক কোনও প্রাণীর উপরে ওই প্রতিষেধক প্রয়োগ করেছে। প্রথমেই দেখতে হবে, তাতে ওই প্রাণীর দেহে নেতিবাচক না ইতিবাচক-কী প্রভাব পড়েছে। সেই রিপোর্টের ভিত্তিতে মানবদেহে প্রয়োগের প্রশ্ন। সে ক্ষেত্রেও দেখতে হবে, প্রথম এবং দ্বিতীয় ধাপে ওই টিকা মানবদেহে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে কি না। ওই টিকা কোনও ক্ষতি করছে কি না, সেটাও দেখা দরকার। কোনও কোনও ক্ষেত্রে এই পুরো প্রক্রিয়া বুঝতে ২-৩ বছর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয় বলে জানালেন ২০০৩ সালে নিজের বানানো এইচআইভি ভ্যাকসিন নিজের দেহে প্রয়োগকারী প্রদীপ শেঠ।
পরীক্ষার ধাপ ও সময়
প্রি-ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল: বাঁদর বা ইঁদুরের শরীরে প্রতিষেধক
ধাপ-১: সেফটি ট্রায়াল—খুব অল্প সংখ্যক ব্যক্তির উপরে প্রয়োগ, অ্যান্টিবডি তৈরি হচ্ছে কি না দেখা
* ক্ষতিকর কি না বুঝতে তিন মাস অপেক্ষা
ধাপ-২ : এক্সপ্যান্ডেড ট্রায়াল— ১০০ রোগীর দেহে প্রতিষেধক। প্রতিষেধক কতটা নিরাপদ ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সৃষ্টিতে সক্ষম কি না দেখা হয়
** সাধারণত তিন মাস অপেক্ষা। দেখা হয় আক্রান্তেরা সুস্থ হচ্ছেন কি না, বা শরীরে ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে কি না
ধাপ-৩: এফিকেসি ট্রায়াল: হাজার জনের উপর প্রয়োগ। দেখা হয়, কত জন সংক্রমিত হয়ে সুস্থ হয়ে উঠলেন। তিন মাস অপেক্ষা
ধাপ-৪: ফলাফল দেখে প্রতিষেধক তৈরির ছাড়পত্র
• অনেক সংস্থাই ধাপ ১ ও ২-কে এক সঙ্গে করে। ভারত বায়োটেক যা ৭ জুলাই থেকে শুরু করছে
• বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, ধাপ ১ ও ২- একসঙ্গে করলেও তিন মাস অপেক্ষা করা উচিত। ধাপ ১ থেকে অনুমোদনের স্তরে পৌঁছতে অন্তত ছয় মাস প্রয়োজন। ভারত বায়োটেক পাচ্ছে মাত্র ৫ সপ্তাহ। (৭ জুলাই থেকে ১৫ অগস্ট)
• অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় গত এপ্রিলে প্রায় হাজার জনকে পরীক্ষামূলক প্রতিষেধক দিয়েছে। তবে অক্টোবরের আগে প্রতিষেধক বাজারে নয়
প্রশ্ন: কেন তাড়াহুড়ো? খেসারত দিতে হবে না তো নাগরিকদের?
সরকার যে ভাবে ‘করে দেখানোর’ মনোভাব নিয়েছে, তার সমালোচনায় সরব হয়েছেন ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ সংস্থার বায়োলজিক্যাল সায়েন্স শাখার অধ্যাপক পার্থসারথি রায়। তিনি বলেন, ‘‘বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে, ‘দেখিয়ে দিলাম’, এই মনোভাব বাঞ্ছনীয় নয়। তার চেয়ে বিজ্ঞানসম্মত ভাবে ভাল-মন্দ বিচার করে মানুষের নিরাপত্তার দিক বিশ্লেষণ করে প্রতিষেধক বাজারে ছাড়া উচিত। কিন্তু এ ক্ষেত্রে গোটা বিষয়টি দায়িত্বজ্ঞানহীন পদক্ষেপ বলেই মনে হচ্ছে।’’ আইসিএমআর চিঠিতে যে শব্দ ব্যবহার করেছে, তা কার্যত ‘হুমকি’ বলেই মনে করছেন অনেক বিশেষজ্ঞ। তাঁদের কথায়, কানে বন্দুক ঠেকিয়ে গবেষণা হয় না। প্রতিটি ধাপে প্রতিষেধক প্রয়োগের পরে রোগীর অবস্থা অন্তত তিন থেকে ছয় মাস ধরে পর্যবেক্ষণ করে দেখতে হয়। তার পর পরবর্তী ধাপে যেতে হয়। এ ক্ষেত্রে যদি কোনও ধাপে অসফলতা আসে, তা হলে গোটা বিষয়টি নতুন করে পর্যালোচনা করতে হয়। এখানে সেই সুযোগ কোথায়! তা হলে কি ওই প্রতিষেধক আগে থেকেই সফল বলে ধরে নেওয়া হচ্ছে? এমন প্রশ্নও তুলেছেন জনস্বাস্থ্য চিকিৎসক অনন্ত ভান।
আরও পড়ুন: ‘ট্রোজান হর্স’! বিদ্যুৎক্ষেত্রে চিনা সরঞ্জাম আমদানি নয়
আরও পড়ুন: আবার ফিরল সেই টাকা ফেরানোর দৃশ্য, ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হচ্ছে কি? ধন্দ তৃণমূলেই
বায়োএথিক্স সংক্রান্ত গবেষক অনন্ত বলেন, ‘‘২ জুলাই বলা হচ্ছে, পাঁচ দিনের মধ্যে সব পরীক্ষামূলক প্রয়োগ শুরু করে দিতে হবে। তা না হলে কঠোর পদক্ষেপ করা হবে। প্রশ্ন হল, কে করবে? আইসিএমআর? কোন ক্ষমতাবলে?’’ এ ক্ষেত্রে প্রতিষেধক প্রয়োগের পরে নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয়গুলি মানা হচ্ছে কি না, সে প্রশ্নও তুলেছেন অনন্ত। যদিও আইসিএমআর সূত্রের বক্তব্য, নির্দেশিকায় বলা হয়েছে, যে সব জায়গায় ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল হবে, সেগুলির রিপোর্টের উপরে নির্ভর করবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত। কিন্তু গবেষকদের বড় অংশ বলছেন, ১৫ অগস্টের মধ্যে পুরো পদ্ধতি শেষ করে রিপোর্ট তৈরি করাই অসম্ভব। টিকা তৈরি তো দূর!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy