দুই মহানগরে দুই ঘূর্ণিঝড়। বাঁ দিকে কলকাতা, ডান দিকে মুম্বই। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ
একটা মহানগর দুমড়েমুচড়ে গিয়েছিল এক বুধবারে। দু’সপ্তাহ আগে। এ দিন, আর এক বুধবার ভীষণ আতঙ্কে ছিল আর এক মহানগর। কলকাতার পর মুম্বই। কিন্তু প্রকৃতিকে প্রণাম জানাতেই হয়, কলকাতার মতো সেই তাণ্ডব অন্তত সইতে হয়নি মুম্বইকে। নিসর্গ আমপান হয়ে ওঠেনি। বাংলার মতো ঘূর্ণিঝড়ে বিপন্ন হতে হয়নি মহারাষ্ট্রের মানুষকে। সেই মহারাষ্ট্র, সেই মুম্বই, যে এখনও দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত, বিপন্ন হয়ে রয়েছে করোনাগ্রাসে।
বঙ্গোপসাগরের গভীরে তৈরি হওয়া নিম্নচাপ। আর তা ঘনীভূত হতে হতে ক্রমশই শক্তি বা়ড়িয়ে নিয়েছিল নিজের। এক সময় তা প্রচণ্ড শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় হয়ে আছড়ে পড়েছিল পশ্চিমবঙ্গের সাগরদ্বীপে। এর আগে আয়লার মতো শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডব দেখেছে এ রাজ্য। পরবর্তী কালে ফণী বা বুলবুল মতো ঝড়ও এসেছে। কিন্তু ক্ষয়ক্ষতির সমস্ত রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে আমপান।
কলকাতায় আমপানের তাণ্ডব।
গত ২০ মে-র প্রাকৃতিক দুর্যোগের ভয়াবহ সেই ছবিটা এখনও বুক কাঁপিয়ে দেয় রাজ্যবাসীর। সে দিন দৈত্যের মতো আছড়ে পড়েছিল আমপান। ঝড়ের সঙ্গী ছিল তুমুল বৃষ্টি। দুই পরগনা আর কলকাতা লন্ডভন্ড করে দিয়েছিল ওই ঘূর্ণিঝড়। বড় ধাক্কা দিয়েছিল পূর্ব মেদিনীপুরের একাংশেও। ওই দিন সকাল থেকেই ক্ষণে ক্ষণে বদলাতে থাকে আবহাওয়া। ঝড় যে আসছে, তা বুঝিয়ে দিচ্ছিল প্রকৃতি। সাগরদ্বীপে ঘণ্টায় ১৮৫ কিমি গতিবেগ নিয়ে আছড়ে পড়েছিল আমপান। বিপুল গতিতে ধেয়ে এসেছিল কলকাতাতেও। যার জেরে তছনছ হয়ে যায় শহর। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছয় যে স্বাভাবিক অবস্থা ফেরাতে সেনা পর্যন্ত নামাতে হয়। দু’সপ্তাহ কেটে গেলেও কলকাতার বুক থেকে আমপানের সেই ক্ষত এখনও মিলিয়ে যায়নি।
আরও পড়ুন: ১৩৮ বছর পর ঢুকছে ‘নিসর্গ’! সাইক্লোন কেন বিরল মুম্বইয়ে
আমপানের স্মৃতি এখনও টাটকা। এর মাঝেই ঝড় তৈরি হয়েছিল আরব সাগরে। নাম দেওয়া হয়েছিল নিসর্গ। তার অভিমুখ ছিল মুম্বইয়ের দিকে। আরব সাগরের উপকূলে গড়ে ওঠা মুম্বই শেষ ঘূর্ণিঝড় দেখেছিল ১৮৮২ সালে। প্রায় ১৩৮ বছর কোনও ঘূর্ণিঝড় দেখেনি মুম্বই। দেশ জুড়ে করোনা সংক্রমণের আতঙ্কের মধ্যে ঘূর্ণিঝড় আসার খবর আশঙ্কা আরও বা়ড়িয়ে দিয়েছিল বাণিজ্যনগরীর বাসিন্দাদের। আগাম সতর্কতা হিসাবে ফাঁকা করে দেওয়া হয়েছিল উপকূল এলাকা। নামানো হয়েছিল ন্যাশনাল ডিসাস্টার রেসপন্স ফোর্স (এনডিআরএফ) দল। কিন্তু ঘূর্ণিঝড়ের সেই দানবিক চেহারা এ দিন মুম্বইয়ে দেখা যায়নি যেমনটা দেখা গিয়েছিল কলকাতায়।
নিসর্গের প্রভাবে বৃষ্টি মুম্বইয়ে।
দুই মহানগরে দুই ঘূর্ণিঝড়ের ভিন্ন ভিন্ন প্রভাব। প্রকৃতির এই খামখেয়ালিপনার পিছনে অন্য ব্যাখ্যাই দিচ্ছেন আবহবিদরা। তাঁদের মতে, সমুদ্রের জলস্তরের তাপমাত্রার হেরফের থেকে নিম্নচাপ তৈরি হয়। তাপমাত্রা বাড়লে নিম্নচাপের অনুকূল পরিস্থিতি দেখা দেয়। ধীরে ধীরে সমুদ্র থেকে শক্তি সঞ্চয় করে নিম্নচাপ ঘূর্ণিঝড়ের চেহারা নেয়। ঘূর্ণিঝড় সমুদ্রে বেশিক্ষণ থাকলে তার শক্তি ক্রমশই বাড়তে থাকে। যেমনটা ঘটেছে আমপানের ক্ষেত্রে।
আরও পড়ুন: সুন্দরবনে ৫ কোটি ম্যানগ্রোভ, রাজ্যের সব থানা এলাকায় লাগাতে হবে গাছ: মুখ্যমন্ত্রী
আবার আবহবিদরা বলছেন, আরব সাগরে ঘূর্ণিঝড়ের পরিস্থিতি খুব কম তৈরি হয়। যেখানে বঙ্গোপসাগরে বছরে গড়ে ৫-৬টি সাইক্লোন তৈরি হয়। তার মধ্যে আবার ‘সিভিয়ার সাইক্লোনিক স্টর্ম’ বা অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হয় দু’টি। কিন্তু সেই তুলনায় আরব সাগরে একটি বা দু’টি ঘূর্ণিঝড় তৈরি হলেও তা অতিপ্রবল ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে খুব কম। আরব সাগরের বায়ুপ্রবাহ ও আবহাওয়ার গতিপ্রকৃতির কারণেই কোনও ঘূর্ণিঝড় তৈরি হলে তা ওমান বা আডেন উপসাগরের দিকে ঘুরে যায়। সে কারণেই মুন্বইয়ে ঘূর্ণিঝড় বিরল ঘটনা। প্রকৃতির খেয়ালেই দু’টি ঝড়ের এমন ভিন্ন ভিন্ন চিত্র দুই মহানগরে।
তবে একটা প্রশ্ন নানা দিক থেকে উঠছে। তা হল, ‘জাতীয় মিডিয়া’-র দুই সাইক্লোন নিয়ে ভিন্ন ভূমিকা। পশ্চিম ভারতের বিপদ যে গুরুত্ব পেল (যা অবশ্যই পাওয়া উচিত), ততটা কেন পেল না পূর্বের বিপদ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy