রাত জেগে প্রতিবাদ: জামিয়ার রাস্তায় রাজ়ি আনোয়ার (বাঁ দিকে)। গান গেয়েছে ফতেমা, আবিরা ও ইসলা (মাঝে)। শাহিনবাগে বৃহস্পতিবার মধ্য রাতে শিশু কোলে প্রতিবাদী (ডান দিকে)। ছবি: সোমা মুখোপাধ্যায়
নাম কী?
আবিরা।
কোন ক্লাসে পড়?
কেজি।
কখন থেকে এখানে আছ?
সন্ধ্যা থেকে। তার আগে বাড়িতে পড়াশোনা করেছি। আম্মি বলেছে, পড়া বন্ধ করা যাবে না।
রাতে কী খেলে?
খাইনি তো। আম্মি তো এখন এখানেই থাকে। বাড়িতে রান্না হয়নি। দুপুরে মুড়ি আর বিস্কুট খেয়েছি। এখানে ডিমসেদ্ধ আর কেক দেবে। তখন খাব।
খিদে পায়নি?
(মাথাটা সামান্য ঝুঁকিয়ে) না। আম্মি বলেছে, এখন বায়না করার সময় নয়।
গত কাল রাত সাড়ে ১২টার শাহিনবাগ। আবিরা, ফতেমা, ইসলা-রা সদ্য মঞ্চ কাঁপিয়ে নীচে নেমেছে। রাস্তায় প্লাস্টিক পেতে ঠায় বসে থাকা চেহারাগুলোয় যখনই ক্লান্তি এসেছে, ভর করেছে সামান্য ঘুম, তখনই রাশ হাতে নিয়েছে এই খুদেরা। মাইক হাতে মঞ্চে উঠে চেঁচিয়েছে,
‘হাম লেকে রহেঙ্গে আজাদি
ইয়ে বাচ্চে মাঙ্গে আজাদি
সব মিল কর বোলো আজাদি।’
নিমেষে জেগে উঠছে এলাকা।
গত কাল রাতভর ধর্না-অবস্থানের (সিএএ-এনআরসির বিরুদ্ধে) সাক্ষী থাকতে গিয়ে এমন মুহূর্ত সামনে এসেছে বার বার।
গানের পর আবিরা আর ফতিমা— দুই বোন ডেকে এনেছিল তাদের মাকে। বছর পঁচিশের তরুণী সায়রা বললেন, ‘‘জীবনে নাইট শোয়ে সিনেমা দেখতে যাইনি। সেই আমি এখন রাস্তায় রাত জাগছি, দিন কাটাচ্ছি। এটা অধিকার আদায়ের লড়াই। সব করতে হবে। সব।’’ স্থানীয় একটি স্কুলে ইতিহাস পড়ান সায়রা। আর ইসলার মা সাজি সকালে অফিস করে ধর্নামঞ্চে আসেন সন্ধ্যায়। মাঝরাত পর্যন্ত থাকেন।
দিনে এখানে খিচুড়ি বিলি হয়। রাতে কেক, বিস্কুট, ডিমসেদ্ধ, জলের পাউচ ব্যক্তিগত বা সংগঠনগত ভাবে বিলি করা হয়। কারও কারও বাড়ি থেকে খাবার আসে। ১০টা রুটি অনায়াসে ভাগ হয়ে যায় ২০ জনের মধ্যে। কোলে এক বছরের জামিরা, মা সারা বলেন, ‘‘শাহিনবাগ আমাদের শিখিয়েছে, আঙুলে আঙুল আঁকড়ে না-থাকলে টিকে থাকা যায় না।’’
আরও পড়ুন-স্বাধীনতার কোজাগরী শাহিনবাগ, জামিয়ায়
জেগে থাকে জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনের চত্বরও। কাল রাত সাড়ে ১১টা নাগাদ সেখানে মোমবাতি জ্বালতে এসেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়েরই নিরাপত্তা বিভাগের কর্মী নিয়াজ আহমেদ। রাস্তা জুড়ে পড়ুয়াদের আঁকা, দেওয়ালে ঝোলানো হাজারো পোস্টারের ছবি তুলতে বললেন বার বার। বললেন, ‘‘রাস্তা বার করতেই হবে। এত বড় অন্যায় হতে দেওয়া যাবে না।" কয়েক হাত দূরে তখন পোস্টার হাতে দাঁড়িয়ে মহম্মদ সাদিক খান। পুলিশের চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে পুরোদস্তুর সিএএ-এনআরসি বিরোধী আন্দোলনে নেমেছেন। সকাল ৬টা থেকে ১০টা পর্যন্ত বিশ্রাম। বাকি সময় ওখানেই। সাদিক গড়গড় করে বলতে থাকেন, ‘‘কিসিকে বাপকা হিন্দুস্তান থোড়ি হ্যায়....।’’
জামিয়ার পিএইচ ডি পড়ুয়া রাজ়ি আনোয়ারও পোস্টার হাতে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকেন সারা রাত। জামিয়া ক্যাম্পাসে ঢুকে পড়ার সেই রাতে পুলিশ পিটিয়েছিল রাজ়িকে। তার পর থেকে রাজ়ি রাস্তায়। তবে একা নন। সারা রাত বহু মানুষ এসে ভরসা জুগিয়ে যাচ্ছেন। কাল রাত আড়াইটে নাগাদ এসেছিলেন চিকিৎসক সাদাত হোসেন, স্কুলশিক্ষক আশিস তিওয়ারি, কলেজপড়ুয়া মনীষা গুপ্তেরা। ফ্লাস্ক থেকে চা ঢেলে সাদিককে খাওয়াতে খাওয়াতে মনীষা বললেন, ‘‘আর কিছু না-পারি, অন্তত এটুকু তো বোঝাই যে, তোমরা একা নও।’’
রাত বাড়ে। শীতের কামড় কড়া হয়। শাহিনবাগে কোলের বাচ্চার গায়ে কম্বলটা আরও ভাল করে জড়িয়ে দেন মায়েরা। কয়েক মুহূর্ত হয়তো নীরবতা। ফের গানে, কবিতায়, স্লোগানে জেগে ওঠেন সবাই। আম্মি, দাদিদের হাত ধরে ঝাঁকিয়ে ছোটরা বুঝিয়ে দেয়, অনেকটা রাস্তা বাকি। ঘুম এলে চলবে না।
সন্ধ্যার পরে ধর্নার জায়গায় চলে আসেন বাড়ির পুরুষেরাও। স্ত্রীকে কাশির ওষুধ খাওয়াতে খাওয়াতে শওকত আলি বলেন, ‘‘সংসার বলে আলাদা কিছু নেই আর। এই জায়গাটাই এখন সব। এই জায়গাটাই গোটা দেশকে শেষ কথা বলবে।’’
শেষ রাতে শাহিনবাগ থেকে ফের জামিয়া চত্বরে যাই। দেখতে পেয়ে হাসেন সাদিক বলেন, ‘‘আমাদের ঘুম নেই। শাহিনবাগেও তো সকলে জেগে আছে, তা-ই না? দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া মানুষের আর কী-ই বা করার আছে বলুন তো?’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy