Advertisement
২৩ নভেম্বর ২০২৪

‘এক দিন তো ফৌজ সরাতেই হবে, তার পর?’

সপ্তাহখানেক আগে গ্রেনেড বিস্ফোরণে কেঁপে উঠেছিল শ্রীনগরের এই হরি সিংহ হাই স্ট্রিট। মারা যান উত্তরপ্রদেশের এক বাসিন্দা। তার পর থেকে আতঙ্ক বাসা বেঁধেছে। উস্কে দিয়েছে ‘অবিশ্বাস’-এর ছাইচাপা আগুন। অবিশ্বাস ‘এজেন্সি’-দের।

বিচ্ছিন্ন: প্রতিবাদে সাংবাদিকরা। মঙ্গলবার শ্রীনগরে। এএফপি

বিচ্ছিন্ন: প্রতিবাদে সাংবাদিকরা। মঙ্গলবার শ্রীনগরে। এএফপি

প্রেমাংশু চৌধুরী
শ্রীনগর শেষ আপডেট: ১৩ নভেম্বর ২০১৯ ০৩:৪০
Share: Save:

লাল চক থেকে ঝিলম নদীর উপর ছোট্ট ব্রিজ হেঁটে পার হলেই হরি সিংহ হাই স্ট্রিট। সকাল ১০টায় দোকান-বাজার খুলেছে। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই বন্ধ হয়ে যাবে। তাই সকলের মধ্যেই একটা হুড়োহুড়ি ভাব। মোবাইলে বাজারের ছবি তুলছি। কাঁধে টোকা। পিছনে ঘুরতেই কাশ্মীরি যুবক। চোখে সন্দেহ। দাড়িভর্তি ফরসা মুখের রেখায় জমাট অবিশ্বাস।

“কউনসা এজেন্সি? কঁহা ভেজনা হ্যায় ইয়ে সব ফোটো? কিসে দিখানা হ্যায়? কেয়া সাবিত করনা হ্যায়, কে সব কুছ নর্মাল হ্যায়?”

তত ক্ষণে দু’পাশে রাগী মুখের আরও দু’জন। হালকা ধাক্কা দিয়ে ভিড় থেকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা শুরু হয়েছে। আশেপাশের থেকেও ‘এজেন্সি কা আদমি?’ বলে প্রশ্নবাণ উড়ে আসছে। অনেক কষ্টে বোঝানো গেল, কোনও ‘এজেন্সি’ নয়, সাংবাদিক। কিছু ‘সাবিত’ বা প্রমাণ করারও উদ্দেশ্য নেই। ছাড় মিলল বটে, কিন্তু তার পরেও দূর থেকে কয়েক জোড়া চোখের নজরদারি চলল।

সপ্তাহখানেক আগে গ্রেনেড বিস্ফোরণে কেঁপে উঠেছিল শ্রীনগরের এই হরি সিংহ হাই স্ট্রিট। মারা যান উত্তরপ্রদেশের এক বাসিন্দা। তার পর থেকে আতঙ্ক বাসা বেঁধেছে। উস্কে দিয়েছে ‘অবিশ্বাস’-এর ছাইচাপা আগুন। অবিশ্বাস ‘এজেন্সি’-দের। অর্থাৎ, কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের নতুন প্রশাসন, কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা বা আইবি-র মতো নিরাপত্তা বাহিনীকে। অভিযোগ, এরা গোটা দেশকে দেখাতে চাইছে, ৫ অগস্ট ৩৭০ অনুচ্ছেদ রদের পরে কাশ্মীর একেবারে স্বাভাবিক!

স্বাভাবিক? ‘ডাউন টাউন’ বা পুরনো শ্রীনগরের দেওয়ালে দেওয়ালে কালির প্রলেপ। বোঝা যায়, কিছু লেখা হয়েছিল। তার পরে কালি লেপে ঢাকা হয়েছে। সব ঢাকা যায়নি। ইতিউতি চোখে পড়ে ‘গো ব্যাক ইন্ডিয়া’, ‘উই ওয়ান্ট আজাদি’-র মতো দেওয়াল-লিখন। ১৪-১৫ বছরের ছেলেরা সুযোগ পেলেই সেনা-সিআরপি জওয়ানদের লক্ষ্য করে পাথর ছোড়ে। ওরা নাকি টাকা পায়? জামিয়া মসজিদের রাস্তায় প্রশ্নটা করায় এক স্কুল শিক্ষিকা উত্তর দেন, ‘‘আপনাকে ৫০ হাজার টাকা দিলেও বন্দুকের সামনে দাঁড়িয়ে পাথর ছুড়বেন? কেন ছোড়ে, সেটা ভেবে দেখেছেন?’’

৩৭০ রদের পর থেকে কার্ফু ছিল। এখন কার্ফু উঠলেও অঘোষিত ‘হরতাল’ চলছে। সকালে দোকান খুলে বেলা ১১টায় ঝাঁপ বন্ধ। শ্রীনগরের নামজাদা রেস্তরাঁ সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দিচ্ছে, সকাল ৭টা থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত দোকান খোলা থাকবে। স্কুল খুলেছে। কিন্তু বাবা-মায়েরা ছেলেমেয়েদের পাঠাচ্ছেন না। সন্ধ্যার পর গোটা শহর যেন গোরস্থান। উপত্যকার সব শহরেই এক ছবি।

পোলো ভিউ মার্কেটের বৃদ্ধ কার্পেট ব্যবসায়ী প্রশ্ন করেন, ‘‘সব স্বাভাবিক হলে তিন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বন্দি কেন? কেন কাজিগুন্দ থেকে বারামুলা ট্রেন চলাচল বন্ধ ছিল এত দিন? রাজ্য পরিবহণের বাস রাস্তায় নামছে না কেন? হরতাল তো সরকার করছে!’’ উপত্যকার বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতারা এক সময় ‘ক্যালেন্ডার’ জারি করতেন। কবে বাজার খোলা থাকবে, কবে বন্ধ থাকবে। এখন তো তাঁরা গৃহবন্দি। তা হলে কে ‘হরতাল’ ডাকছে?

‘‘কেউ না। কাউকে ডাকতে হচ্ছে না।’’ কাশ্মীরি বৃদ্ধের গলায় ঝাঁঝ, ‘‘আমাদের অপমান করা হয়েছে। ওরা এক সঙ্গে গালে তিনটে থাপ্পড় মেরেছে। ৩৭০ রদ। রাজ্য ভেঙে দু’টুকরো করা। তার পরে রাজ্যের তকমা কেড়ে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পরিণত করা।’’

‘অপমানিত’ কাশ্মীর যেন নিজেকে গুটিয়ে ফেলেছে। মৌলানা আজাদ রোডে জম্মু-কাশ্মীর প্রদেশ কংগ্রেস অফিস। খাঁ খাঁ দফতরে একা বসে অফিস সেক্রেটারি মহম্মদ সেলিম। আর কেউ? সেলিম উত্তর দেন, ‘‘সব নেতাই তো বন্দি। কেউ সেন্টুর হোটেলে, কেউ নিজের বাড়িতে। ১০০ দিন হয়ে গেল। কয়েক জন ছাড়া পেয়েছেন বটে, কিন্তু পার্টি অফিসমুখো হচ্ছেন না। মুখ খুলতে বারণ করা হয়েছে। আবার ভিতরে ঢুকিয়ে দেবে।’’

রেসিডেন্সি রোডে পিডিপি দফতরে সিআরপি জওয়ান, পুলিশ কনস্টেবল ছাড়া কেউ নেই। দলের প্রধান, জম্মু-কাশ্মীর রাজ্যের শেষ মুখ্যমন্ত্রী মেহবুবা মুফতি মুঘলদের বাগান ‘চশমে শাহি’-তে সরকারি বাংলোতে বন্দি। তল্লাটের ধারেকাছেও যাওয়ার অনুমতি নেই। জ়িরো ব্রিজের পাশে ন্যাশনাল কনফারেন্সের সদর দফতর। বিশাল ভবন যেন দিনের বেলাতেই ভূতের বাড়ি। কে বলবে, এটাই রাজ্যের দুই প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ফারুক ও ওমর আবদুল্লার দফতর। ফারুক নিজের বাড়িতে বন্দি। ওমর বন্দি গুপকার রোডের ‘হরি নিবাস’-এ। ১০০ দিন হয়ে গেল।

কংগ্রেসের মহম্মদ সেলিম হতাশ গলায় বলেন, ‘‘রাজনৈতিক নেতারা বাইরে থাকলে এ সব নিয়ে তর্কবিতর্ক হত। মানুষের ক্ষোভ বার হত। এখন আগ্নেয়গিরির মতো ক্ষোভ জমছে।’’

এ ভাবে কত দিন ব্যবসা বন্ধ রাখবেন? সরাফ বাজারের শাল ব্যবসায়ী পাল্টা প্রশ্ন করেন, ‘‘সরকার এ ভাবে রাস্তার মোড়ে মোড়ে সেনা-সিআরপি রেখে দিয়ে কত দিন চালাবে? বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতাদের বন্দি রেখে কি বিচ্ছিন্নতাবাদ ধামাচাপা দেওয়া যায়? এক দিন না এক দিন তো ফৌজ সরাতেই হবে। তার পরে?’’

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy