জয়পুরের বর্তমান দুই কৃতী বাঙালি, বাঁ দিকে আশিস মুখোপাধ্যায় এবং ডান দিকে সুকান্তকুমার সরকার।
সর্দার পটেল মার্গে কয়েক বিঘে জমির উপর প্রায় দুর্গের চেহারার বিজেপি রাজ্য কার্যালয়। অন্য দিকে সিন্ধি ক্যাম্পের ঘিঞ্জি রাস্তায় রাজস্থান প্রদেশ কংগ্রেস অফিস। জৌলুসের দিক থেকে কোনও তুলনাতেই আসে না।
কংগ্রেস অফিসের পাশ দিয়ে যেতে গিয়েই চোখ আটকে গেল রাস্তার নামে। সংসার চন্দ্র সেন রোড। গাড়ির চালক নেমিচাঁদকে প্রশ্ন করতেই তিনি বললেন, সংসারচন্দ্র জয়পুরের দেওয়ান ছিলেন। সিন্ধি ক্যাম্পের কাছে সেন পরিবারকে বিশাল জায়গির উপহার দিয়েছিলেন জয়পুরের রাজা। বাঙালির চেনা সেন পদবি আর জয়পুরের জায়গিরদার— মেলাতে পারছিলাম না। তত ক্ষণে পাঁচিলে ঘেরা গোলাপি শহর জয়পুরকে পাশ কাটিয়ে পৌঁছে গিয়েছি আড়ে বহরে বেড়ে ওঠা নতুন শহরের প্রান্তে, বৈশালি নগরে।
গন্তব্য এক বঙ্গ সন্তানের বাড়ি। নাম আশিস মুখোপাধ্যায়। পেশায় ব্যবসায়ী আশিসবাবু এ শহরের দীর্ঘ দিনের বাসিন্দা। তাঁর কাছে মরু প্রদেশের ভোট রাজনীতির খুঁটিনাটি শুনতে শুনতেই ফের উঠে এল সংসারচন্দ্রের কথা। শুনেই আশিসবাবু বললেন, “সংসারচন্দ্র কে জানেন? লেখিকা জ্যোতির্ময়ী দেবীর দাদু। উনি জয়পুরে এসেছিলেন সামান্য স্কুল শিক্ষকের চাকরি নিয়ে। কিন্তু নিজের কৃতিত্বে সোয়াই মাধো সিংহ (দ্বিতীয়)-এর দেওয়ান হন। সে যুগে দেওয়ান মানে রাজার প্রধানমন্ত্রী।”
বাংলা মুলুকের সঙ্গে জয়পুরের যোগটা আরও অনেক পুরনো। জয়পুর শহরের উপকণ্ঠে শীলাদেবী মন্দিরের পাথরের ফলকে লেখা থেকে জানা যায়, ষোড়শ শতকে বাংলার বারো ভুঁইঞার অন্যতম, যশোরের প্রতাপাদিত্যর ছেলে কেদারনাথের কাছে যুদ্ধে হারেন মান সিংহ। আর সেই সময়েই স্বপ্নাদেশ পেয়ে যশোর থেকে ওই পাথরের দেবী মূর্তি পান তিনি। দেবীকে প্রতিষ্ঠা করেন আমের দুর্গে। ইতিহাস বলে, জয়পুর শহরটাই তৈরি হয়েছে এক বাঙালির হাতে। নৈহাটির স্থপতি বিদ্যাধর ভট্টাচার্য (মতান্তরে চক্রবর্তী) ছিলেন এই শহরের প্রধান স্থপতি। তাঁর নামে এখনও বিশাল প্রাসাদ এবং লাগোয়া বাগান রয়েছে। গোটা একটি এলাকার নাম দেওয়া হয়েছে বিদ্যাধর নগর।
আশিসবাবুর মতো এ শহরের বাঙালিরা সেই গৌরবময় অতীত এবং বর্তমানটা মেলাতে পারেন না। তিনি বলেন, “এক সময় জয়পুর চালাত বাঙালিরাই। আর এখন আমাদের নূন্যতম প্রতিনিধিত্ব নেই।”
জয়পুর শহরের বাঙালি স্থপতির নামে এই বিদ্যাধর বাগ
দু’পুরুষ ধরে এ শহরেই বাস চিকিৎসক সুকান্তকুমার সরকারের। গোটা শহর এক ডাকে তাঁকে চেনে। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী রাজ্যবর্ধন সিংহ রাঠৌরের বৈশালীনগরের বাংলোর ঠিক পাশেই তাঁর বাড়ি এবং ক্লিনিক। বাঙালি নিয়ে কথা শুনেই ক্ষোভ চেপে রাখতে পারলেন না। তিনি বলেন, “আমরা কেউ একজোট নই। আমরা এককাট্টা নই বলেই আমাদের ন্যূনতম পুরভোটেও কোনও প্রতিনিধিত্ব নেই।” তাঁর হিসাবে, শুধু জয়পুরেই বসবাস করেন কম পক্ষে দু’লাখ বাঙালি পরিবার। বাঙালি ভোটারের সংখ্যা তিন লাখের বেশি। শহরের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকলেও বৈশালী নগর, আদর্শ নগরের মত জায়গায় বাঙালির সংখ্যা বেশি।
আমের দুর্গ (জয়পুর), এখানেই যশোরের দেবী মূর্তিকে প্রতিষ্ঠা করেন মান সিংহ
তিনি বলেন, “রাজনৈতিক দিক থেকে আমরা বিভিন্ন ভাবে অবহেলিত। অথচ, অধিকাংশ বাঙালি পরিবার একজোট হয়ে কোনও দাবি নিয়ে সরব হন না। অনেকে ভোটও দিতে যেতে চান না। সেই কারণে এখানকার কোনও রাজনৈতিক দলই আমাদের গুরুত্ব দেয় না।” সুকান্তবাবু নিজেও এ বছর নির্দল প্রার্থী হিসাবে ভোটে দাঁড়াবেন ঠিক করেছিলেন। কিন্তু বাকি বাঙালিদের উৎসাহের অভাব দেখে না দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নেন।
আরও পড়ুন: হনুমানও ‘দলিত’! ত্রেতা যুগের বার্থ সার্টিফিকেট কলিতে দিলেন যোগী
জয়পুরের বাঙালি মহলে গৌতম সেন পরিচিত নাম। জন্ম থেকে বেড়ে ওঠা এই শহরেই। তিনিও সমর্থন করেন সুকান্তবাবুর অভিযোগকে। তিনি বলেন, “শহরের গোবিন্দজি মন্দিরের মোহন্ত একজন বাঙালি। অঞ্জনকুমার গোস্বামী। অত্যন্ত প্রভাবশালী মানুষ। তিনিও চেষ্টা করেছিলেন রাজনীতির ময়দানে নামার। পারেননি।”
আরও পড়ুন: ‘অযোধ্যা চাই না, ঋণ মকুব করা হোক’, স্লোগান দিতে দিতে সংসদ
এক সময়ের রাজার পারিষদদের পরিবার এখন ক্ষমতা থেকে বহু দূরের আম আদমি। তাই মসনদের দখল নিয়ে যতই ঝড় উঠুক না কেন এই মরুপ্রদেশে, অতীতের গৌরবকে আঁকড়েই রাজনীতির আঁচ থেকে বহু দূরে জয়পুরের নিস্পৃহ বাঙালি কুল।
(ভোটের খবর, জোটের খবর, নোটের খবর, লুটের খবর- দেশে যা ঘটছে তার সেরা বাছাই পেতে নজর রাখুন আমাদেরদেশবিভাগে।)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy