লকডাউনে সুনসান জাভেরি বাজার। বন্ধ সোনার দোকানগুলি। —নিজস্ব চিত্র
বাড়িওয়ালাকে কাতর অনুরোধ করে ভাড়াটা বকেয়া রেখেছেন তাঁদের কেউ কেউ। বিদ্যুতের বিল তো প্রায় কেউই জমা দিচ্ছেন না। এত দিন কিন্তু মাসে মাসে তাঁদের পাঠানো টাকাতেই তাঁদের গাঁ-গঞ্জের রূপ বদলে যাচ্ছিল। পালা-পার্বনের জৌলুস বছর বছর বাড়ছিল তাঁদের দেওয়া মোটা চাঁদাতেই। কোথাও ঠাকুরতলায় স্থায়ী নাটমন্দিরটা তৈরি করিয়ে দিচ্ছিলেন তাঁরা। কোথাও প্রাইমারি স্কুলের ভগ্নপ্রায় বাড়িটা সেরে উঠছিল তাঁদের কল্যাণে। মুম্বইয়ের জাভেরি বাজার আলো করে থাকা সেই হাজার হাজার বাঙালি স্বর্ণশিল্পী এখন ঘোর সঙ্কটে। আর্থিক সঙ্কট বললে কিছুই বলা হয় না। সঙ্কটটা এখন থাকা-খাওয়ার। যে কোনও মূল্যে গ্রামে ফিরতে দেওয়া হোক, রোজ আর্তি এসে পৌঁছচ্ছে বাংলায়। কিন্তু কবে ফিরতে পারবেন? আদৌ পারবেন তো? স্পষ্ট নয় তাঁদের কারও কাছেই।
৬০-৭০ হাজার! সংখ্যাটা শুনেই চোখ কপালে উঠবে। মুম্বইয়ের বিরাট এবং রমরমা গয়না ব্যবসার পাঁজর হয়ে কাজ করেন পশ্চিমবঙ্গ থেকে যাওয়া স্বর্ণশিল্পীরা। হাওড়ার ডোমজুড় থেকে গিয়েছেন রতন মালিক। তাঁর কথায়, ‘‘মুম্বইয়ের মহানগরপালিকার (পুরসভা) যে লিস্ট রয়েছে, তাতেই এই জাভেরি বাজারে ৫৫ হাজার বাঙালি স্বর্ণশিল্পীর নাম রয়েছে। মানে সরকারি হিসেব অনুযায়ীই ৫৫ হাজার। আসলে তার চেয়েও কিছুটা বেশি। কারণ সবার নাম ওই লিস্টে নেই।’’ এই ৬০-৭০ হাজার বাঙালি স্বর্ণশিল্পীর অধিকাংশই এখন পশ্চিমবঙ্গে ফিরতে মরিয়া বলে রতন মালিক, রমেশ মালিক, রতি ঘোষ, বিজয় মাল, সুমন মাইতি, পবিত্র মান্নারা জানাচ্ছেন। মার্চ মাসের বেতনটা পেয়েছিলেন। তার পর থেকে আর বেতন মেলেনি। মহারাষ্ট্রের সরকারও প্রায় কিছুই করছে না। কিছুটা সাহায্য মিলেছে স্থায়ীয় বিধায়ক এবং কর্পোরেটরের তরফ থেকে। কিন্তু মাসের পর মাস মুম্বইতে টিকে থাকার প্রশ্নে তা যৎসামান্যই। অতএব বাড়িতে টাকা পাঠানো তো অনেক দূরের কথা, নিজেদের দু’বেলার সংস্থান করাই কঠিন হয়ে উঠেছে।
মুম্বইতে শুধু নয়, আমদাবাদ, সুরত বা দিল্লিতেও স্বর্ণশিল্পীদের অধিকাংশই বাঙালি। হাওড়া, হুগলি আর দুই মেদিনীপুর— মূলত এই চার জেলা থেকেই সোনা এবং গয়নার কাজ করতে ভিন্রাজ্যে যান বাঙালি স্বর্ণশিল্পীরা। দেশের সবচেয়ে বড় জুয়েলারি মার্কেট জাভেরি বাজার টিকেই রয়েছে বাঙালি কারিগরদের উপরে ভর করে। আর সেই কারিগরদের উপরে ভর করে আবার বাংলার গোটা চারেক জেলায় ফুলে-ফেঁপে উঠেছে গ্রামীণ অর্থনীতি। পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা তৃণমূলের সভাপতি অজিত মাইতির কথায়, ‘‘যাঁরা বাইরে গিয়ে স্বর্ণশিল্পী হিসেবে কাজ করেন, তাঁরা বেশ ভালই উপার্জন করেন। নিজের নিজের গ্রামে তাঁরা বাড়ি-ঘর বানান, তাঁদের পরিবারের জীবনযাত্রার মান বাড়ে। শুধু তাই নয়, এই স্বর্ণশিল্পীরা নানা সামাজিক কাজেও অবদান রাখেন। নিজের গ্রামের নানা রকম সামাজিক কর্মকাণ্ডে বা উন্নয়নমূলক কাজে তাঁরা আর্থিক অবদান রাখেন। ফলে গ্রামগুলোর চেহারা বদলাতে থাকে, গ্রামগুলোর অর্থনীতি শক্তিশালী হয়।’’
আরও পড়ুন: আপনার এলাকায় এ বার কী খুলবে, কী খুলবে না, দেখে নিন বিস্তারিত
শুধু ঘাটাল, দাসপুর-১ আর দাসপুর-২ ব্লক থেকেই ২২-২৩ হাজার স্বর্ণশিল্পী ভিন্রাজ্যে কাজ করেন বলে জানাচ্ছেন জেলা তৃণমূলের সভাপতি। আর পাশের জেলা পূর্ব মেদিনীপুরের তৃণমূল সভাপতি তথা কাঁথির দাপুটে সাংসদ শিশির অধিকারী বলছেন, ‘‘এই স্বর্ণশিল্পীরা আমাদের জেলার গর্ব। শুধু মুম্বইতে নয়, গোটা দেশে যত শহরে গয়নার বড় ব্যবসা রয়েছে, সব শহরে আমাদের জেলা থেকে যাওয়া স্বর্ণশিল্পীদের পাবেন। শুধু পাবেন না, তাঁরাই টিকিয়ে রেখেছেন গোটা ব্যবসাটাকে।’’
একের পর এক জেলার শীর্ষ রাজনৈতিক নেতাদের প্রতিক্রিয়া থেকেই স্পষ্ট হয়ে যায়, প্রবাসে থেকেই এ রাজ্যের বেশ কয়েকটা জেলায় গ্রামীণ বা স্থানীয় অর্থনীতির জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ এঁরা। কিন্তু তাতে আর লাভ কী হল? জাভেরি বাজারে ভাড়া নেওয়া গয়নার ওয়ার্কশপ সংলগ্ন একফালি ঘরে বসে প্রশ্ন তুলছেন রতন বা বিশ্বনাথরা। ‘‘লকডাউন শুরু হওয়ার কিছু দিন পর থেকেই লাগাতার চেষ্টা করে যাচ্ছি নিজের রাজ্যে ফেরার। কিছুতেই যেতে পারছি না। কেউ কেউ বাসে করে বা গাড়ি ভাড়া করে ফিরে গিয়েছেন। কিন্তু সেটা খুব কমই। অন্তত ৫০ হাজার স্বর্ণশিল্পী এখানে আটকে রয়েছেন। মহারাষ্ট্রের সরকার আমাদের জন্য কিচ্ছু করছে না। এখনও যদি ফিরতে না পারি, আমাদের রাস্তায় গিয়ে দাঁড়াতে হতে পারে,’’—বললেন রতন।
লকডাউনে কাজ নেই। অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। ঘরে ফেরার অপেক্ষায় স্বর্ণকাররা। মুম্বইয়ের জাভেরি বাজার এলাকায়। —নিজস্ব চিত্র
রাস্তায় দাঁড়াতে হবে কেন? রতন বলছেন, ‘‘একটা দোকান ভাড়া নিয়ে আমি আর আমার কারিগররা এখানে ব্যবসা করি। সেখানেই থাকি। লকডাউন শুরু হতেই ব্যবসা পুরোপুরি বন্ধ। বাড়িতে কেউ একটা টাকা পাঠাতে পারছি না। বাড়িভাড়া মেটাব, সে পয়সাও নেই। বাড়িওয়ালাকে বলেছি, এখন ভাড়া দিতে পারব না। ক’দিন বাড়িওয়ালারা সে কথা শুনবেন, জানি না। কারণ আমার বাড়িওয়ালা এখনও কিছু বলেননি। কিন্তু এখানে অনেকেরই সংসার চলে ওই বাড়িভাড়ার উপরে নির্ভর করে। তাঁরা তো বিনা ভাড়ায় আর থাকতে দেবেন না। যে কোনও দিন স্বর্ণশিল্পীদের রাস্তায় বার করে দেওয়া শুরু হবে ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে পারিনি। কবে এসে লাইন কেটে দিয়ে যাবে জানি না। এখানে আমাদের রেশন কার্ড নেই, ফলে রেশনও পাই না। এই ভাবে চলতে থাকলে থাকবই বা কোথায়? খাবই বা কী!’’
আরও পড়ুন: ভিন্রাজ্যের নার্সরা ফিরে যাওয়ায় সঙ্কট, নয়া নিয়োগের বার্তা মুখ্যমন্ত্রীর
কিন্তু বাংলায় ফিরলেই বা কী সুরাহা হবে? গ্রামে আপনাদের পরিবারও তো আপনাদের উপার্জনের উপরেই নির্ভরশীল। রতন বলেন, ‘‘বাড়ি ফিরে কিছু না কিছু কাজ করব, দু’বেলা দু’মুঠো ডালভাত অন্তত জুটিয়ে নেব। মাথার উপরে ছাদটা নিজের, সেটাই শান্তি। পরিবারের লোকগুলোকে চোখের সামনে দেখতে পাব, সেটাই শান্তি।’’
এই সঙ্কটের সময়ে পরিবার দেশের এক প্রান্তে আর তাঁরা আর এক প্রান্তে, টাকা পাঠানো তো বন্ধ করতে হয়েইছে, কোনও সমস্যায় পড়লে পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর সুযোগটাও নেই— এই দুশ্চিন্তা ক্রমশ চেপে বসছে জাভেরি বাজারের বিরাট বাঙালি জনসংখ্যার মনে। প্রবল মানসিক চাপে অনেকে অসুস্থও হয়ে পড়েছেন বলে খবর।হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর খবরও ঘোরাফেরা করছে।
অতএব ক্ষোভ ক্রমশ বাড়ছে প্রশাসনের বিরুদ্ধে। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী চিঠি লিখেছিলেন মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রীকে। বাংলার যাঁরা কর্মসূত্রে মহারাষ্ট্রে রয়েছেন, এই লকডাউনের সময়ে তাঁদের খেয়াল রাখতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অনুরোধ করেছিলেন উদ্ধব ঠাকরেকে। সে অনুরোধে কোনও কাজ কি হয়েছে? জাভেরি বাজারে আটকে থাকা স্বর্ণশিল্পীদের কথা শুনলে তা অন্তত মনে হচ্ছে না—‘‘বাঙালি কেন, বিহারি, পঞ্জাবি, ঝাড়খণ্ডি কাউকে সাহায্য করছে না মহারাষ্ট্রের সরকার। আমরা যে এলাকায় থাকি, সেখানকার বিধায়ক এবং কর্পোরেটর কিছু সাহায্য করেছেন। শুরুতে কয়েক জন বড় শেঠ (বড় মাপের গয়না ব্যবসায়ী) বেশ কিছু টাকা খরচ করেছেন। কিন্তু ৬০-৭০ হাজার লোককে মাসের পর মাস থাকা-খাওয়া জুগিয়ে যাওয়া কারও পক্ষে সম্ভব নয়। সরকার ছাড়া আর কারও পক্ষে এটা করা সম্ভব নয়। কিন্তু মহারাষ্ট্রের সরকার আমাদের জন্য কিছুই করতে রাজি নয়।’’
লকডাউন উঠে গিয়ে তাড়াতাড়ি চালু হোক এই বাজার। প্রতীক্ষায় স্বর্ণশিল্পীরা। —নিজস্ব চিত্র
ভিন্রাজ্যে আটকে থাকা বাঙালি শ্রমিকদের সঙ্গে ভাল ব্যবহার করা হচ্ছে না, এমন অভিযোগ পশ্চিমবঙ্গের শাসক পক্ষের তরফ থেকে বার বারই তোলা হচ্ছে। অন্যান্য রাজ্যের যে শ্রমিকরা এ রাজ্যে রয়েছেন, বাংলার সরকার তাঁদের যথেষ্ট খেয়াল রাখছে বলেও তৃণমূল নেতারা বার বারই মনে করিয়ে দিচ্ছেন। অজিত মাইতির কথায়, ‘‘আমার জেলায় অন্য রাজ্য থেকে আসা হাজার হাজার পরিযায়ী শ্রমিক রয়েছেন। খড়্গপুর, মেদিনীপুর, বেলদা, দাঁতন, ঘাটাল, চন্দ্রকোনা— সর্বত্র রয়েছে। আমরা যেখান থেকে তাঁদের অসুবিধার খবর পাচ্ছি, সেখানে গিয়ে সুরাহার ব্যবস্থা করে আসছি। অনেক ক্ষেত্রে আমরা পৌঁছনোর আগে স্থানীয় মানুষই ব্যবস্থা করে দিচ্ছেন। কিন্তু অন্য রাজ্যে আমাদের যে শ্রমিকরা আটকে রয়েছেন, তাঁরা সে সব জায়গায় একই ব্যবহার পাচ্ছেন না। এটা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক।’’
শুধু তৃণমূল নয়, জাভেরি বাজারে আটকে থাকা বাঙালি স্বর্ণশিল্পীদের দুর্দশার ইস্যুতে মহারাষ্ট্র সরকারের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে শুরু করেছে পশ্চিমবঙ্গের বিজেপি-ও। প্রাক্তন বিধায়ক তথা রাজ্য বিজেপির অন্যতম মুখপাত্র শমীক ভট্টাচার্যের কথায়, ‘‘উদ্ধব ঠাকরের ভাবা উচিত যে, তাঁর রাজ্যের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি এই বাঙালি কারিগররা। কথায় কথায় মোদী-বিরোধী জিগির তুলে উদ্ধব নানা মঞ্চে উঠে দাঁড়িয়ে পড়বেন, দেশের স্বার্থের বাণী শুনিয়ে বড় বড় কথা বলবেন, আর লকডাউনে বিপন্ন হয়ে পড়া পরিযায়ী শ্রমিকদের সাহায্যের প্রশ্ন এলেই মুখ ফিরিয়ে নেবেন, এর চেয়ে বড় ভণ্ডামি তো আর হতে পারে না।’’ শমীকের কথায়, ‘‘শুনলাম মহারাষ্ট্রের সরকার বলছে, জাভেরি বাজারে বাঙালি স্বর্ণশিল্পীদের অনেকেই নাকি বাংলাদেশ থেকে আসা অবৈধ অনুপ্রবেশকারী। সেই কারণেই নাকি তাঁদের সাহায্য করা হবে না। তা-ই যদি হয়, তা হলে কারা অবৈধ, সেটা চিহ্নিত করুক। যাঁরা বৈধ, তাঁদেরই পাশে দাঁড়ান। একটা অজুহাত দেখিয়ে হাজার হাজার মানুষকে এই রকম বিপদে ফেলে রাখা হবে, সেটা তো মেনে নেওয়া যায় না।’’
উদ্ধব সরকারের কাছ থেকে সাহায্যের আসা অবশ্য জাভেরি বাজারের বাঙালিরা রাখছেন না আর। তাঁরা এখন যে কোনও মূল্যে পশ্চিমবঙ্গে ফিরতে চাইছেন। সে রাজ্য থেকে পরিযায়ীদের বাংলায় ফেরানোর জন্য ট্রেনের বন্দোবস্তও হয়েছে। একটি ট্রেন ইতিমধ্যেই হাজার দুয়েক যাত্রী নিয়ে বাংলায় ফিরেছে। কিন্তু আরও বেশি ট্রেন দরকার এবং দ্রুত দরকার, বলছেন শ্রমিকরা।
সে বিষয়ে কী ভাবছে রাজ্য সরকার? রাজ্যের শাসক দলই বা কী ভাবছে? শিশির অধিকারী বা অজিত মাইতিরা জানাচ্ছেন— ট্রেনের ভরসায় সবাই বসে নেই, অনেকেই বাস বা ছোট গাড়ি ভাড়া করে বাংলায় ফিরেছেন ইতিমধ্যেই। আরও অনেকেই সে ভাবেই ফেরার চেষ্টা করছেন বলে তাঁদের দাবি। যাঁদের পক্ষে অতটা খরচ করা সম্ভব নয়, তাঁরা ট্রেনের ভরসায় রয়েছেন এবং পর্যাপ্ত ট্রেনই মিলবে— আশ্বাস তৃণমূল নেতৃত্বের।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy