Advertisement
০২ নভেম্বর ২০২৪

শিশুকে স্তন্যপান করানোর সুযোগ কই শ্রমিক মায়েদের?

কলকাতা শহরের একটি নামী হাসপাতালের শিশুবিভাগ। এক মা তার ছোট্ট শিশুকে দেখাতে নিয়ে এসেছেন। ডাক্তারবাবু শিশুটিকে পরীক্ষা করে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিলেন। সবশেষে বললেন, আপনি যদি বাচ্চাকে বুকের দুধ না খাওয়ান তবে ওর চিকিত্‌সা এখানে করাতে আসবেন না। সেই মা তখন কী করবেন বুঝে উঠতে পারছেন না, কারণ তাঁকে কাজে ফিরতে হবে, না হলে কাজ থাকবে না। এক দিকে শিশুর স্বাস্থ্য, অন্য দিকে রুজিরোজগার। বলা বাহুল্য, অসংগঠিত ক্ষেত্রে কর্মরতা মায়ের সংখ্যা বিপুল। এঁরা কোথায় সহায়তা পাবেন?

সারা দিন কাজের পরে শিশুর পরিচর্যা আর হয়ে ওঠে না।—ফাইল চিত্র।

সারা দিন কাজের পরে শিশুর পরিচর্যা আর হয়ে ওঠে না।—ফাইল চিত্র।

কৃষ্ণা রায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ০১ মে ২০১৪ ০২:৫৮
Share: Save:

কলকাতা শহরের একটি নামী হাসপাতালের শিশুবিভাগ। এক মা তার ছোট্ট শিশুকে দেখাতে নিয়ে এসেছেন। ডাক্তারবাবু শিশুটিকে পরীক্ষা করে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিলেন। সবশেষে বললেন, আপনি যদি বাচ্চাকে বুকের দুধ না খাওয়ান তবে ওর চিকিত্‌সা এখানে করাতে আসবেন না। সেই মা তখন কী করবেন বুঝে উঠতে পারছেন না, কারণ তাঁকে কাজে ফিরতে হবে, না হলে কাজ থাকবে না। এক দিকে শিশুর স্বাস্থ্য, অন্য দিকে রুজিরোজগার। বলা বাহুল্য, অসংগঠিত ক্ষেত্রে কর্মরতা মায়ের সংখ্যা বিপুল। এঁরা কোথায় সহায়তা পাবেন?

আমাদের দেশে অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিক-মা ও তাঁদের সন্তানদের স্বাস্থ্য বা স্তন্যপান সহায়তা সম্বন্ধে সরকারি মন্ত্রক বা বেসরকারি নেটওয়ার্ক সম্পূর্ণ নীরব। স্বাধীনতার ৬৬ বছর পরে নারী-শিশু ও উন্নয়ন মন্ত্রী কৃষ্ণা তিরথ বলেছেন, ‘অসংগঠিত ক্ষেত্রের নারীশ্রমিকদের মাতৃত্বকালীন ছুটি আইনের আওতায় আনা দরকার। আমাদের দেশে প্রায় অর্ধেক নারী কৃষি, নির্মাণশিল্প বা গৃহাশ্রমের মতো অসংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ করেন। এঁরা মাতৃত্বকালীন ছুটি আইনের কোনও সুবিধা পান না। এই বৈষম্য দূর করা দরকার।’

১৯৯০ সালের ১ অগস্ট বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা ও ইউনিসেফ-এর নীতিনির্ধারকরা শিশুর জন্মের পরেই প্রথম ছ’মাস পর্যন্ত শুধু মায়ের দুধকেই শিশুর একমাত্র খাদ্য হিসাবে সুপারিশ করেন। ছ’মাসের পর অন্য পুষ্টিকর খাবারের সঙ্গে শিশু মায়ের দুধ অন্তত দু’বছর অবধি খাবে। ‘একমাত্র মায়ের দুধ খাওয়ানো’র সুপারিশকে জনস্বাস্থ্যের বিষয় হিসাবে দেখতে হবে, কারণ এটি দেশের সমস্ত শিশুকে স্বাস্থ্য সুরক্ষা দেবে। ‘একমাত্র মায়ের দুধ খাওয়ানো’ প্রকল্প যদি বাস্তবে সর্বস্তরে সফল হয় তবে শিশুমৃত্যুর হার লক্ষণীয় ভাবে কমে যাবে। অনেক রোগের সংক্রমণ থেকে শিশুকে বাঁচানো যাবে এবং স্তন্যদায়িনী মায়েরও স্বাস্থ্য ভাল থাকবে। আমাদের দেশে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার ঘোষণাকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার জন্য রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে তেমন বিশেষ কিছু করা হয়নি। শুধুমাত্র সংগঠিত ক্ষেত্রে মাতৃত্বকালীন ছুটি ছ’মাস পর্যন্ত বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। জনস্বাস্থ্যের এত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি শুধুমাত্র মায়েদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। মায়ের উপর শুধু ফরমান জারি করা হচ্ছে, সচেতন করার প্রয়াস নেওয়া হচ্ছে না।

ছ’মাস ধরে বুকের দুধ খাওয়াতে গেলে শিশুর কাছ থেকে মা দু’এক ঘণ্টার বেশি সময় দূরে থাকতে পারেন না। পরিবহণের অসুবিধার জন্য বাচ্চাকে সঙ্গে নিয়েও বেরোনো বিপজ্জনক। প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল বা মফস্সল তো দূরস্থান, খোদ কলকাতা শহরে ট্যাক্সি পাওয়া যায় না। বাসে এত ভিড় থাকে যে শিশু নিয়ে ওঠা ঝুঁকিপূর্ণ। ফলে প্রসূতি মায়েরা মানসিক অবসাদে ভুগতে থাকেন। প্রসূতি মায়েদের সচেতনতা ও মনোবল বাড়াতে উন্নত দেশে ল্যাকটেশন কাউন্সেলর আছেন। এ দেশে সে সবের বালাই নেই। ঘরেবাইরে শুধুই মায়েদের নিন্দে করা হয়। ‘বুকের দুধ খাওয়াতে চায় না তবে এরা মা হয় কেন?’ এই ধরনের কটু মন্তব্য মায়েদের উদ্দেশে ছুড়ে দেওয়া হয়। ‘একমাত্র মায়ের দুধ খাওয়ানো’ জনস্বাস্থ্যের বিষয় হলে জনপরিসরে কী ভাবে মায়েরা বুকের দুধ খাওয়াতে পারেন, তার জন্য সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে পরিষেবার ব্যবস্থা করতে হবে। অসংগঠিত ক্ষেত্র ছাড়াও বহু নারী অস্থায়ী বা চুক্তিকাজে নিযুক্ত আছেন। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেকেই অস্থায়ী কাজ করছেন, রয়েছেন গবেষকরা। এঁদের মধ্যে অনেকের মাতৃত্বকালীন ছুটি নেই, অনেকের ছুটি নেওয়ার অধিকার থাকলেও সময়সীমার মধ্যে কাজ জমা দেওয়ার চাপ থাকার জন্য তাঁরা সেই ছুটি নিতে পারেন না। এঁদের জন্য কর্মস্থলের কাছে শিশুদের রাখার ব্যবস্থা করতে হবে।

আমাদের দেশে ‘একমাত্র মায়ের দুধ খাওয়ানো’ প্রকল্প অনুশীলন সফল করতে হলে ঘরে-বাইরে, কর্মক্ষেত্রে সবাইকে প্রসূতি মা এবং তাঁর শিশুর চাহিদা ও প্রয়োজন সম্বন্ধে সচেতন করতে হবে। রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এমন ব্যবস্থা করতে হবে যাতে প্রসূতি মা তাঁর সন্তানকে নিয়ে সহজে চলাফেরা করতে পারেন। এঁদের জন্য পরিবহণের বিশেষ ব্যবস্থা করা দরকার। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, বড় স্টেশনে, বাস টার্মিনাসে, ট্রেনের মধ্যে, বিমানবন্দরে, বিমানের মধ্যে প্রসূতি মায়েরা যাতে অসংকোচে বুকের দুধ খাওয়াতে পারেন, তার ব্যবস্থা করা। কোনও বিশ্ববিদ্যালয়কে উত্‌কর্ষ পীঠ-এর (সিট অব এক্সেলেন্স) শংসাপত্র দেওয়ার মাপকাঠি হিসাবে যে বিষয়গুলি রাখা হয়ে থাকে, তার মধ্যে মায়ের দুধ খাওয়াবার স্বাস্থ্যসম্মত ঘর থাকা এবং মায়ের দুধ মজুত করার স্বাস্থ্যসম্মত ব্যবস্থা এই বিষয় দু’টি অন্তভুর্ক্ত করা, ইত্যাদি।

মনে রাখা দরকার, মায়ের শরীর ও মন ভাল না থাকলে শিশুর ভাল থাকা সম্ভব নয়। মায়ের রোজগার বন্ধ হয়ে গেলে, তাঁর সামাজিক বা বহির্জগতের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেলে তিনি কখনও ভাল থাকতে পারেন না, এটা সকলের মাথায় রাখা উচিত। সমাজের সর্বস্তরের মানুষ সচেতন না হলে ও রাষ্ট্রীয় পরিকাঠামো গড়ে না তুলতে পারলে ‘একমাত্র মায়ের দুধ খাওয়ানো’ প্রকল্প কোনও দিন জনস্বার্থের বিষয় হয়ে উঠবে না। শুধু মায়েদের উপর দায়িত্ব চাপিয়ে দিলে কৌটোর দুধ শিশুখাদ্যে জায়গা করে নেবে, তাকে ঠেকানো যাবে না।

(প্রতিবেদক নারী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত সমাজকর্মী)

অন্য বিষয়গুলি:

female workers breast feed krishna roy
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE