Advertisement
২৪ নভেম্বর ২০২৪

ডেঙ্গির চেহারায় মামুলি ম্যালেরিয়াই এখন ত্রাস

এ যাবৎ তার তরফে তেমন ভয়ের কিছু ছিল না। কিন্তু হঠাৎই সে বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। স্বভাব পাল্টে সাধারণ ম্যালেরিয়ার জীবাণু প্লাসমোডিয়াম ভাইভাক্স এ বার হাজির হয়েছে কালান্তক রূপ ধরে!

দেবদূত ঘোষঠাকুর
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০৩:০৩
Share: Save:

এ যাবৎ তার তরফে তেমন ভয়ের কিছু ছিল না। কিন্তু হঠাৎই সে বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। স্বভাব পাল্টে সাধারণ ম্যালেরিয়ার জীবাণু প্লাসমোডিয়াম ভাইভাক্স এ বার হাজির হয়েছে কালান্তক রূপ ধরে!

আর সেই চেহারাটা অনেকটা ডেঙ্গির মতো! ডেঙ্গির মতোই সে রক্তের অণুচক্রিকা (প্লেটলেট) কমিয়ে দিচ্ছে হ-হু করে। শরীরের ভিতরে রক্তপাত ঘটাচ্ছে। সব মিলিয়ে ‘আপাত নিরীহ’ প্লাসমোডিয়াম ভাইভাক্স এই মুহূর্তে শহরের ডাক্তারদের ঘুম ছুটিয়ে দিয়েছে। যে প্রেক্ষাপটে আঙুল উঠছে সচেতনতার ঘাটতির দিকেও।

কলকাতার বিভিন্ন নার্সিংহোমে খোঁজ নিয়ে জানা যাচ্ছে, গত এক সপ্তাহে নতুন এই প্রজাতির প্লাসমোডিয়াম ভাইভাক্স সংক্রমণে এক জনের প্রাণ গিয়েছে। দু’জন চিকিৎসাধীন। তিন জনের কারও রক্তে কিন্তু ডেঙ্গি বা প্লাসমোডিয়াম ফ্যালসিপেরাম (ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়ার জীবাণু) কিংবা অন্য কোনও রোগ-জীবাণু মেলেনি। অথচ তিন জনেরই প্লেটলেট হুড়মুড়িয়ে নেমেছে। লিভার, কিডনি, মস্তিষ্ক, ফুসফুস ইত্যাদি একে একে বিকল হতে শুরু করেছে।

অর্থাৎ চিকিৎসা পরিভাষায় যাকে বলে ‘মাল্টিঅর্গান ফেলিওর।’

প্রাণ হারানো ব্যক্তির চিকিৎসা করেছিলেন যিনি, তাঁর বক্তব্য: রোগনির্ণয়ে দেরি হওয়ায় রোগীর শরীরে জীবাণুর সংখ্যা অত্যধিক বেড়ে গিয়েছিল। শেষমেশ মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণে মৃত্যু হয়েছে। হেমারেজিক ডেঙ্গিতে যেমন হয়। অন্য দু’জন অবশ্য বেঁচে গিয়েছেন, কারণ ওঁদের চিকিৎসায় সময় নষ্ট হয়নি। তবে নার্সিংহোম-সূত্রের খবর, এক জনের প্লেটলেট কাউন্ট ৮ হাজারে নেমে গিয়েছিল (প্রাপ্তবয়স্কের প্রতি ঘন মিলিমিটার রক্তে দেড় লক্ষ থেকে চার লক্ষ প্লেটলেট থাকার কথা)।

প্লাসমোডিয়াম ভাইভাক্সেরই এমন দাপট! বাঁচার উপায় কী?

স্কুল অব ট্রপিক্যাল মেডিসিনের প্রাক্তন অধিকর্তা তথা ম্যালেরিয়া ক্লিনিকের প্রাক্তন প্রধান গবেষক অমিতাভ নন্দীর দাবি, চিকিৎসায় দেরি না-হলে তেমন বিপদ নেই। ‘‘নতুন ধরনের ভাইভাক্স সংক্রমণ হচ্ছে ঠিকই। তবে ঠিক সময় রোগ ধরা পড়লে ভয়ের কিছু নেই। কারণ, প্লাসমোডিয়াম ভাইভাক্সের সঙ্গে যুদ্ধ করার নির্দিষ্ট ওষুধ রয়েছে। নতুন প্রজাতিও তাতে কাবু হয়।’’— বলেন অমিতাভবাবু।

প্রসঙ্গত, প্লাসমোডিয়াম ফ্যালসিপেরামের বাজারচলতি বিবিধ ওষুধের বেশ কয়েকটা এখন আর কাজ করে না। নির্বিচার ও ভ্রান্ত প্রয়োগের সুবাদে ফ্যালসিপেরামের জীবাণু সেগুলোর প্রতিরোধী (রেজিস্ট্যান্ট) হয়ে গিয়েছে। তাই ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়া রুখতে নতুন নতুন ওষুধ উদ্ভাবন করতে হচ্ছে। তবে ভাইভাক্স এখনও ওষুধ প্রতিরোধী হয়ে উঠতে পারেনি।

তাই ঠিক সময়ে রোগ ধরা পড়লে সমস্যা হওয়ার কথা নয় বলে পরজীবী-বিশেষজ্ঞেরা আশ্বাস দিচ্ছেন। তাঁদের বক্তব্য: যে কোনও সংক্রমণের প্রাথমিক দাওয়াই হল আশু রোগনির্ণয়। এতে রোগ ছড়ানোর সম্ভাবনাও অনেকটা ছেঁটে ফেলা যায়। অমিতাভবাবুর কথায়, ‘‘নব্বইয়ের দশকের শেষাশেষি কলকাতায় ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গি এক সঙ্গে হানা দিয়েছিল। তখন সচেতনতা যথেষ্ট বেড়েছিল। এমনকী, অনেকে জ্বর হলে সে দিনই রক্ত পরীক্ষা করিয়ে নিচ্ছিলেন।’’

পরিণামে পরবর্তী ক’বছরে কলকাতায় ম্যালেরিয়া-ডেঙ্গির দাপট বেশ কমে যায়। ইদানীং সচেতনতায় ফের ভাটার টান। বিশেষজ্ঞদের আক্ষেপ, অনেকে জ্বর হওয়ার চার-পাঁচ দিন বাদে ডাক্তার দেখাচ্ছেন, তার পরে রক্ত পরীক্ষা হচ্ছে। বিলম্বের সুযোগে জীবাণু অবাধে বংশবিস্তার করছে আক্রান্তের শরীরে। কমিয়ে দিচ্ছে প্রতিরোধ ক্ষমতা। প্রথাগত ওষুধকেও হার মানতে হচ্ছে।

প্লাসমোডিয়াম ভাইভাক্সের নতুন প্রজাতিটি প্রথম দেখা দিল কোথায়?

বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, ম্যালেরিয়াপ্রবণ কিছু দেশে ২০০৭ থেকে এর অস্তিত্ব টের পাওয়া যাচ্ছে। ২০১২-১৩য় ইরান-পাকিস্তানেও তার দেখা মেলে। ২০১৩-য় তার আবির্ভাব হয় মধ্যপ্রদেশে। কলকাতার ডাক্তারেরা গত বছরই সাধারণ ম্যালেরিয়ার কিছু রোগীর শরীরে ডেঙ্গির উপসর্গ লক্ষ্য করেছিলেন। এ বার সেটা রীতিমতো প্রকট।

নতুন চেহারার প্লাসমোডিয়াম ভাইভাক্স কী ভাবে প্লেটলেটে কোপ বসাচ্ছে, সেটা কিন্তু এখনও শারীরবিজ্ঞানীদের কাছে পরিষ্কার নয়। তবে জীবাণুর স্বভাব পরিবর্তনের জন্য আবহাওয়ার পরিবর্তনকে অনেকাংশে দায়ী করছেন জীবাণু-বিজ্ঞানীরা। বিজ্ঞানীদের ব্যাখ্যা: প্রতিকূল পরিবেশে খাপ খাইয়ে নেওয়ার তাগিদে নিম্নবর্গের প্রাণীদের জিনগত পরিবর্তন হচ্ছে প্রতিনিয়ত। সেই প্রক্রিয়ারই ফসল নতুন প্রজাতির এই প্লাসমোডিয়াম ভাইভাক্স।

‘গোবেচারা’ জীবাণুতে সঞ্চিত হয়ে গিয়েছে মারণ ক্ষমতা!

অন্য বিষয়গুলি:

abpnewsletters
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy