Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
international women's day

আন্তর্জাতিক নারী দিবস: একটা ‘দিবস’-এর অপেক্ষায় শতাব্দী পার, বোকা মেয়ে, এই দিনটা কি তোর খুব দরকার?

মেয়েরা বড় হয় ভাল পাত্রের সঙ্গে বিয়ের জন্য। বেশির ভাগ বিয়েতে বিজ্ঞানী বা চিকিৎসক বা শিক্ষিকা, তা সে যাই হন না কেন, সেই নারী আজও কয়েক জন পুরুষের ভরসায় পিঁড়িতে বসে বরের মুখ দেখেন।

‘দিবস’ আসে, ‘দিবস’ যায়, ভাঙে কি নারীর শিকল?

‘দিবস’ আসে, ‘দিবস’ যায়, ভাঙে কি নারীর শিকল?

স্রবন্তী বন্দ্যোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৮ মার্চ ২০২১ ১৪:৪৫
Share: Save:

আজ, ৮ মার্চ নারী দিবস। মেয়েদের জন্য আলাদা করে দেওয়া একটা দিন। মেয়েদের বা ‘মেয়েছেলেদের’ মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর, উদ্‌যাপনের দিন। কেটেছেঁটে কেবল একটাই দিন!

তবে এ শুধু নারীর উৎসব নয়। পুরুষের ছাঁকনিতে ছেঁকে নেওয়া নারীর কৃতিত্ব আর ‘মাধুর্য’-র কোলাহল। যে পুরুষ তার প্রিয় নারীতে যত মুগ্ধ, তার দাম তত বেশি। সেই মতো উপহারে সেজে ওঠে ভোগবাদী দুনিয়ার কাচ ঝলমল দোকান। হিরের হার বা নিদেনপক্ষে আংটি। নয়তো অনলাইনের ঘর সাজানোর জিনিস আসে স্বামী, প্রেমিকের, বন্ধুর হাত ধরে। শাড়ি, গয়না বা ঘরের জিনিসের মধ্যেই শহুরে নারীর ‘আন্তর্জাতিক দিবস’। আর পুরুষ সেই দিবসকে সাজিয়ে তোলে পিতৃতন্ত্রের খোলসে। বড্ড বেশি পুরুষের হস্তক্ষেপ যেন! ১৯ শতক থেকে আজ সেই একই ধারা। মেয়েরা আলোকিত হবে পুরুষের উদার আলোকচিত্তে।

আগেই বলে রাখি, নারী দিবস নিয়ে আমার লেখার উদ্দেশ্য পুরুষকে ছোট করে নারীকে পুরুষ বর্জিত একক শক্তি হিসেবে প্রতিপন্ন করা নয়। ২০২১-এ দাঁড়িয়েও দেখছি, নারী সমাজে দ্বিতীয় লিঙ্গ। নারী-পুরুষের সমতা নেই। বিবাহিতা নারী প্রসঙ্গে আজও বলে চলেছি, ‘‘ওর স্বামী বা শ্বশুরবাড়ির লোক খুব ভাল, বৌকে চাকরি করতে দিয়েছে।’’ এ ভাবেই যেন পুরুষ ‘ভাল’ হয়ে ওঠে। কিন্তু সেই বৌ? সে কি ঘুরিয়ে বলেছে, ‘‘আমি আমার বরকে চাকরি করতে দিলাম?’’

অর্থের স্বনির্ভরতা কি দিতে পারে সামাজিক স্বনির্ভরতার অধীকার?

অর্থের স্বনির্ভরতা কি দিতে পারে সামাজিক স্বনির্ভরতার অধীকার?

এ হওয়ার নয়। এখন অধিকাংশ পরিবারে যখন ভাল খাবার প্রথম পুরুষের পাতেই আসে, সেখানে এমন চাহিদা বেশ ‘বাড়াবাড়ি’ বা ‘মেয়ের বাড় বেড়েছে’ গোছের কটূক্তিতে মিলিয়ে যায়।

কীই বা বলতে পারে আজকের নারী?

বীরভূমের পারুলিয়া গ্রামের ফুলমণি স্বামীর মার খেতে খেতে একদিন নিজেও মাতাল স্বামীর উপর হাত তোলে। পাড়ার সবাইকে চিৎকার করে জানায়, ‘আমার স্বামী আমায় পেটাচ্ছে’। কিন্তু কলেজের অধ্যাপিকা সুচরিতা দিনের পর দিন স্বামীর কাছে মার খেয়েও চুপ। অথচ তার টাকাতেই সংসার চলে। বাড়িও তার। বেরোজগার বরের হাতে রাস্তায় থাপ্পড় খেয়েও সে চুপ। বছর ২০ লেগে যায় তার সোজা হয়ে একা দাঁড়াতে। বিবাহ বিচ্ছেদ করতে গিয়ে বলে সে, ‘আমি পারব না। আমি এত কিছুর পরেও ওকে খুব ভালবাসি। মানুষটা সত্যিই ভাল’।

নারীর আবেগই কি তার সর্বনাশের কারণ? ১৫ বছরের নাতিকে গড়েপিটে মানুষ করার পর নিজের ছেলের জেদে, দুর্ব্যবহারে ঘরছাড়া হন ৭০ বছরের মা। তাঁর বাড়ি তিনি একমাত্র ছেলের নামে সেই কবে করে দিয়েছেন। তিনি রাস্তায় এসে দাঁড়ান। কোথায় যাবেন তিনি? বয়স্কদের আইন অনুযায়ী, তিনি কিন্তু ফিরে পেতে পারেন তাঁর বাড়ি। হ্যাঁ, তার জন্য পুলিশের কাছে তাকে যেতে হবে। যখন তাঁকে বলা হয়, ছেলের নামে ডায়েরি করতে, মা বলেন, ‘‘আমার পেটের ছেলেকে থানায় ডেকে আনতে পারব না।’’ আবার সেই আবেগ। পিতৃতন্ত্র শিখিয়েছে যে, যত আবেগ, কান্না সব মহিলার। পুরুষের জন্য নয়। এর থেকে বেরিয়ে ভাবতে পারেন, এমন জোর খুব কম নারীর মধ্যেই দেখা যায়। এই সত্যি ঘটনার পর কি মনে হয় না, নারী দিবস হিরের গয়না থেকে শাড়ি, সুগন্ধী, রেস্তঁরায় মোমের আলোর শ্যাম্পেন হয়ে থেকে গেল?

গ্রামের সেই লড়াকু মেয়েটির কাছে কী পৌঁছয় নারী দিবসের বার্তা?

গ্রামের সেই লড়াকু মেয়েটির কাছে কী পৌঁছয় নারী দিবসের বার্তা?

মেয়েরা বড় হয় ভাল পাত্রের সঙ্গে বিয়ের জন্য। বেশির ভাগ বিয়েতে বিজ্ঞানী বা চিকিৎসক বা শিক্ষিকা, তা সে যাই হন না কেন, সেই নারী আজও কয়েক জন পুরুষের ভরসায় পিঁড়িতে বসে বরের মুখ দেখেন। মেয়েরা তো আর ওজন তুলতে পারে না! অবশ্য বাবা অথবা বর ব্যস্ত থাকলে, দু’হাতে ভারী বাজারের থলি বইতে দেখা যায় সেই মেয়েকেই। থাক সে কথা! মেয়েরা কি আজও ভাবতে পারে না, সোজা হেঁটে এসে সে বিয়ে করতে পারে? কনে দেখা আলোর নরম বৌ গটগট করে হেঁটে বিয়ে করতে এলে তো সমাজ বলবে ‘কী নির্লজ্জ মেয়েরে বাবা’! অথচ বর আসবে রাজার মেজাজে। বর তো বিয়ে করতে আসে আর মেয়েদের তো বিয়ে হয়।

তা হলে নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে এত হইচই করে লাভ কী? অর্থনৈতিক ভাবে স্বাধীন নারীও তো একা থাকার, বিয়ে ভাঙার কথা সহজে মুখেই আনতে পারে না। উল্টে সস্তা নারীবাদেও দাম্পত্যে মানিয়ে গুছিয়ে নেওয়ার সমীকরণ চলে, ‘আমি যদি তোমার জন্য চা বানাই, তুমি আমার খাবার বেড়ে দেবে’-গোছের।

শ্রম আর বেতনের সমতা নিয়ে রাস্তায় নেমে দেড় শতকের আগে যে মেয়েরা নারী-পুরুষের সাম্যের কথা বলেছিল, তার কিছুই তো হল না! উল্টে যে মেয়েটি ভোরের আগে উঠে কোনও এক প্রত্যন্ত গ্রামে ছাত্র পড়িয়ে অসুস্থ বাবা-মা আর ৩ বোনের খরচ চালিয়ে এক বেলা শাক আর ভাত খেয়ে বাঁচে, তার কাছে নারী দিবস অর্থহীন। সে তো স্নাতক স্তর পর্যন্ত পড়াশোনা করেছে। তাকে নারী দিবস কী দিতে পেরেছে? অনাহার, অন্ধকার, কখনও বা বাড়ি বয়ে আসা বাইকধারী পুরুষের ধর্ষণের হুমকি! প্রেমিক হতে চাওয়া পুরুষ যে মেয়ের গায়ে অ্যাসিড ছুঁড়ে তার মুখ পোড়ায়, তাকে নারী দিবস কী দিয়েছে? থানার সামান্য নিরাপত্তাটুকু দিতে পারেনি তাকে। উল্টে বেল পাওয়া সেই পুরুষ রোজ তার বাড়িতে হুমকি দিচ্ছে। মুখ তো পুড়েছে, এ বার শরীরের পালা। ধর্ষণ!

একা মেয়েটার নরম গালের পাশে, নারী দিবস কি সত্যিই রাত জাগে?

একা মেয়েটার নরম গালের পাশে, নারী দিবস কি সত্যিই রাত জাগে?

তবুও নারী দিবস হয়। শাড়ি আর গয়নার ছটায় মঞ্চ আলো হয়। ‘উইমেন ইন লিডারশিপ’ কর্পোরেটের বড় মুখ, সমাজকর্মীরা, সমাজের গণমান্য নারীরা সম্মানিত হন। নিঃসন্দেহে তাঁরা নিজেদের জায়গায় কৃতী। লড়াই তাঁদেরও আছে। তবে শুধু তাঁদেরই আছে। তাঁরা 'করে দেখাতে' পেরেছেন। আর যারা দেখাতে পারল না? কিন্তু নিয়ত লড়াই চালিয়ে গেল, তাদের গায়ে মাটির গন্ধ, শ্রমের লড়াইকে থামিয়ে দেওয়ার জন্য কি তবে অন্য কোনও দিবসের অপেক্ষায় আরও অনেক শতাব্দী পার হয়ে যাবে?

অন্য বিষয়গুলি:

international women's day
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy