Advertisement
১৮ নভেম্বর ২০২৪
LIfe style news

দিশিকৃষ্ণ ও ঋষিকৃষ্ণ

জিশুর বার্তাবাহী মিশনারিদের উনিশ শতকের বাঙালিরা অনেকেই পছন্দ করতেন না। হিন্দু বাঙালিরা মিশনারিদের প্রভাবে সব ‘কেরেস্তান’ হয়ে যাচ্ছেন এ তো ভাল কথা নয়।

প্রতীকী ছবি।

প্রতীকী ছবি।

বিশ্বজিৎ রায়
শেষ আপডেট: ২৪ ডিসেম্বর ২০১৭ ১৬:৫৬
Share: Save:

বাংলা কবিতার পাঠকদের সঙ্গে জিশুর মোলাকাত উনিশ শতকে। ‘খাঁটি’ বাঙালি সংস্কৃতির ধারক ঈশ্বর গুপ্ত দো-আঁশলা বঙ্গজদের জিশু-ভজনা নিয়ে পদ্যে ফুট কেটেছিলেন—
‘দিশি কৃষ্ণ মানিনেকো, ঋষিকৃষ্ণ জয়।
মেরিদাতা মেরিসুত , বেরিগুড বয়।।’

জিশুর বার্তাবাহী মিশনারিদের উনিশ শতকের বাঙালিরা অনেকেই পছন্দ করতেন না। হিন্দু বাঙালিরা মিশনারিদের প্রভাবে সব ‘কেরেস্তান’ হয়ে যাচ্ছেন এ তো ভাল কথা নয়। রামমোহন, ঈশ্বর গুপ্ত, দেবেন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ– মিশনারিদের কাণ্ডকারখানায় বিচলিত। দেবেন্দ্রনাথ নিরাকার ব্রহ্মের অনুগামী, তবে সে নিরাকার ভজনার সঙ্গে স্বদেশিয়ানার কোনও বিরোধ নেই। বিজাতীয় মিশনারিদের প্রভাব খর্ব করার জন্য মহর্ষি কিছু দিনের জন্য পৌত্তলিকদের সঙ্গেও জোট বেঁধেছিলেন। বিলিতি মিশনারিদের থেকে স্বজাতীয় পৌত্তলিকেরা তাঁর ঢের বেশি আপন।

তবে জিশু আর মিশনারি, বঙ্গজদের কাছে সব সময় সমার্থক নয়। জিশুকে ভারতীয়রা, এমনকী বাঙালিরা, আপন করে নিয়েছিল। জিশুর দিব্য ভারতীয়করণ হয়েছিল। ঈশ্বর গুপ্ত দো-আঁশলাদের জিশু-ভজনার বিরোধিতা করতে গিয়ে ‘ঋষিকৃষ্ণ’ শব্দটি প্রয়োগ করেছেন, সে তো আর এমনি এমনি নয়! তার পেছনে ইতিহাসের অন্য এক স্মৃতি-শ্রুতি কাজ করে যাচ্ছে।

ভারতীয় ধর্মের ইতিহাস অনুসন্ধানী নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য একটি মোক্ষম কথা লিখেছিলেন— ‘ভারতের মাটিতে খ্রীষ্টধর্ম হিন্দুধর্মের অনেক শাখার থেকেই প্রাচীন।’ এ দেশে খ্রিস্টানদের অনুপ্রবেশের একাধিক পর্যায়। ঈশ্বর গুপ্ত, দেবেন্দ্রনাথ উনিশ শতকে যে ‘বহিরাগত’ মিশনারিদের মোকাবিলা করছেন, তাঁরা আধুনিক কালের মানুষ। খ্রিস্টধর্ম এ দেশে এসেছিল তার অনেক আগে। সাধু টমাস উত্তর-পশ্চিম ভারতের পহ্‌লব বংশীয় রাজা গন্ডোফারেসের সভায় এসেছিলেন এবং তাঁকে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করেছিলেন এ নিতান্ত গল্পকথা নয়, তার কিছু ভিত্তি ছিল। খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতকে আলেকজান্দ্রিয়ার বণিক কোসমাস তাঁর ভ্রমণকাহিনিতে দক্ষিণ ভারতের একটি গির্জা ও সেই গির্জার যাজকের কথা লিখেছিলেন। হপ্‌কিন্সের ‘রিলিজিয়নস্‌ অফ ইন্ডিয়া’ প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৯৫ সালে। কৃষ্ণকাহিনি আর খ্রিস্টকাহিনির মিলের কথা লিখেছিলেন তিনি। হপ্‌কিন্স না হয় বিলিতি, দিশি পণ্ডিত ভান্ডারকরও কিন্তু কৃষ্ণে আর খ্রিস্টে মিল দেখেছেন। সাধে ঈশ্বর গুপ্ত জিশুকে ঋষিকৃষ্ণ বলে ডেকেছিলেন! গুপ্ত কবি না হয় একটু ঠাট্টা করেছেন, কৃষ্ণে-খ্রিস্টে মিলিয়ে দেওয়া লোকেরও কিন্তু অভাব ছিল না।

বাইবেলের নিউ টেস্টামেন্ট খুললেই দুজনের মিলের চেহারা-চরিত্র মালুম হবে। কৃষ্ণের যেমন কংস মামা, তেমনি জিশুর জীবনে রাজা হেরোদ। বেথলেহেমে জিশু জন্মেছেন। তাঁকে দেখতে এসেছেন পণ্ডিত জ্যোতির্বিদরা। তাঁরা এসে বলছেন, ‘ইহুদিদের যে রাজা জন্মেছেন, তিনি কোথায়?’ শুনে তো হেরোদের বেজায় ভয়। এই বুঝি তাঁর রাজ্যপাট গেল। হেরোদ যে ভয় পেয়েছেন তা অবশ্য বুঝতে দিচ্ছেন না। কৌশলী রাজা তো। জ্যোতির্বিদদের বললেন, ‘আপনারা গিয়ে ভাল করে শিশুটির খোঁজ নিন। খোঁজ পেলেই খবর দেবেন। আমি গিয়ে প্রণাম করে আসব।’ জ্যোতির্বিদরা রাজার মনের কথা অবশ্য বুঝে ফেললেন। হেরোদের কাছে তাঁরা ফিরলেন না। আর জিশুর বাবা জোসেফ স্বপ্নাদেশ পেলেন, ‘শিশুকে নিয়ে পালিয়ে যাও মিশরে। ফিরো না। হেরোদ শিশুকে মারার প্রস্তুতি নেবে।’

জিশুজীবনের এই আদিকথা শুনলেই কৃষ্ণভক্তরা বলে উঠবেন, আরে আরে এ তো কৃষ্ণকথাই। কংস শিশুকৃষ্ণকে যাতে হত্যা করতে না পারেন সে জন্য রাতের অন্ধকারে ছেলেকে নিয়ে কারাগার থেকে গোপনে পালিয়ে গেলেন বসুদেব। রেখে এলেন গোকুলে। কংস বালক কৃষ্ণকে না পেয়ে যেমন ও দিনে যারা জন্মেছে তাদের সবাইকে হত্যার আদেশ দিয়েছিলেন, তেমনি হেরোদের হুকুম হল ‘দু-বছর বা তার কম বয়সের যত ছেলে তখন বেথলেহেমে ও আশেপাশে আছে, তাদের মেরে ফেল।’

মারলেই কি ঈশ্বরের মৃত্যু হয়? গ্লানি আর অধর্মের হাত থেকে বাঁচানোর জন্যই তো দেবশিশুদের আবির্ভাব, তাঁদের অভ্যুত্থান। বিলিতি জিশু আর দিশি কৃষ্ণের গল্পের সুর প্রথম দিকে যেন খানিকটা একই ধারাই প্রবাহিত, পরে অবশ্য আর মিল পাওয়া যাবে না।

আরও পড়ুন: ক্রিসমাসের উৎসব হবে মহাকাশেও

হিঁদু কৃষ্ণের সঙ্গে বিলিতি জিশুর মতের নানা ফারাক। ফারাক জীবনের পরবর্তী ঘটনারও। কৃষ্ণকে কংস বধ করতে পারবেন না। কৃষ্ণ এক এক করে ‘দুষ্ট’ রাজাদের নিকেশ করবেন। অন্য দিকে জিশু করুণার মূর্ত বিগ্রহ। দিব্যকান্তি জিশু যাচ্ছেন। জর্ডন নদীর জলে দীক্ষাস্নান হয়ে গেছে তাঁর। অপরূপ কান্তি। গালিলেয়ার অঞ্চলে কত লোকের ব্যাধি যে তিনি নিরাময় করেন। মৃগী, পক্ষাঘাতে কাতর সারি সারি মানুষ। তাঁর স্পর্শে রোগমুক্তি। করুণাধারাস্নানে মুক্ত মানুষেরা তাঁর অনুবর্তী। জিশু তাঁদের বলেন, ‘চোখের বদলে চোখ, দাঁতের বদলে দাঁত’ এই প্রাচীন অনুশাসন মান্য না করতে। বলেন, ‘বরং কেউ তোমার ডান গালে চড় মারলে মুখ ঘুরিয়ে অন্য গালটি তার দিকে পেতে দাও। কেউ যদি মামলা করে তোমার জামাটি নিতে চায়, তবে তোমার গায়ের চাদরটিও তাকে নিতে দাও’ (লুক ৬: ২৯-৩০)। ধৈর্য ও ক্ষমার প্রতিমূর্তি তিনি।

নিজের ধর্মকথা প্রচার করতে শেষে নাজারেথের জিশু ষড়যন্ত্রীদের হাতে বন্দি হলেন। যারা জিশুকে পাহারা দিচ্ছিল তারা তাঁকে উপহাস করল, মারল। চোখ বেঁধে দিয়ে প্রশ্ন করল, ‘এ বার দিব্যজ্ঞান দেখাও দেখি। বল দেখি কে তোমাকে মারল?’ নিরুত্তর জিশু অপমান সইতে লাগলেন। খুলিতলায় জিশুকে দু’জন অপকর্মার সঙ্গে ক্রুশে দেওয়া হল। তখনও জিশু বলছেন, ‘পিতা, ওদের ক্ষমা কর। ওরা যে কী করছে ওরা তা জানে না।’ এই সময়ও শাসকের প্রহরীদের হিংস্রতার শেষ নেই। তারা দান চেলে জিশুর জামাকাপড় নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিল (মথি ২৭: ৩৩-৩৮)। বেলা বারোটা। সূর্যে গ্রহণ লাগল। দেশ ছাইল অন্ধকারে। জিশুর মৃত্যু হল। জিশুজীবনীতে এর পর আছে পুনরুত্থানের গল্প।

আরও পড়ুন: ভালবাসার গিফট মানেই খ্রিস্টমাস

এই ধৈর্য, ক্ষমা, করুণার প্রতিমূর্তি অবশ্য কৃষ্ণ নন। সাধে কি উনিশ শতকে বঙ্কিমচন্দ্র কৃষ্ণকে পরাধীন ভারতের সামনে আদর্শ নায়ক হিসেবে তুলে ধরতে চেয়েছেন। শিশুপাল কৃষ্ণকে গালিগালাজ করেন। একটা সময় পর্যন্ত কৃষ্ণ কিছু বলেন না। তার পর সুদর্শনচক্র ঝলসে ওঠে। কৌরবসভায় এসেছেন কৃষ্ণ। পাণ্ডবদের দূত হিসেবে, একা। দুর্যোধন তাঁকে বন্দি করার ফন্দি আঁটেন। পারলেন না। কুরুক্ষেত্রের মাঠে অর্জুন যুদ্ধ করতে চাইছেন না। কৃষ্ণের খরবাক্য, উদ্দীপনবাণী। সেই বাণীই হিন্দুদের গীতা। পরাধীন ভারতে বঙ্কিম আর বিবেকানন্দ কৃষ্ণপন্থী। বিবেকানন্দ তো তাঁর ‘প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য’ রচনায় জিশুকে সামনে রেখে দু-কথা শোনাতেও পিছপা হননি। বিলেতের ভগবান এক গালে মারলে আর এক গাল এগিয়ে দিতে বলেছিলেন, ইউরোপীরা মোটে তা করেনি। বরং অন্য দেশ দখল করেছে। আর এদেশি কৃষ্ণ অর্জুনকে ক্লীবতা ত্যাগ করতে বললেন, যুদ্ধ করতে বললেন। এদেশিরা সে কথা না শুনে, শুনলে যেন জিশুর কথা। লড়াই করল না। বিদেশিরা দখল করে নিল এ দেশ। সুতরাং পরাধীন ভারতবাসীর কাছে জিশুর বাণী দূরে থাক, বরং কৃষ্ণের মন্ত্রে লড়াই শুরু হোক।

উনিশ শতক পিছনে পড়ে আছে। স্থান-কালের বাইরে গিয়ে করুণাঘন জিশুর দিকে তাকাতে ইচ্ছে করে। শঙ্খ ঘোষ লিখেছিলেন তাঁর কবিতায়—
‘দুই হাতে দুই প্রান্ত রেখে তখন থেকে দাঁড়িয়ে আছি আমি।
যিশুর মতো।’

জিশুর এই ক্ষমা ও ধৈর্য গুণগত দিক দিয়ে বিচার করতে হবে, আক্ষরিক অর্থে নিলে হবে কেন? যোহন মনে করিয়ে দিয়েছেন, ‘পরিস্থিতি বুঝে অন্যায়কারীদের সঙ্গে ব্যবহার’ করতেন জিশু। রোমিয় বলেছিলেন, এই ক্ষমাধর্ম আসলে অপরের মনে শুভের সঞ্চার ঘটানোর উপায়।

শীত ঘন হয়। ‘করুণাঘন’ জিশুকে ঘিরে জ্বলে ওঠে উৎসবের আলো। কৃষ্ণ আর জিশুর মিল-বেমিল গৌণ হয়ে যায়। ক্রুশবিদ্ধ জিশু দেশ-কাল প্রয়োজন-অপ্রয়োজন অতিক্রম করে উঠে দাঁড়ান।

অন্য বিষয়গুলি:

Christmas Festival Jesus Christ
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy