Advertisement
E-Paper

অনলাইনে সারা বছর, কিন্তু বাঙালির চৈত্র সেল কেন আকর্ষণ হারায়নি আজও! কোথায় তার অনন্যতা?

ফুটপাতে নিত্যদিন যাঁরা তাঁদের পণ্য নিয়ে বসেন, তাঁদের প্রায় দ্বিগুণ মানুষ এ সময়ে এক মাস ফুটপাত ছাপিয়ে নেমে পড়েন বড় রাস্তাতেও। কারা তাঁরা?

Why Chaitra sale is still attractive to Bengalis even in the era of online shopping and sale

সেলের বাজার যখন জমজমাট। ছবি: সংগৃহীত।

অনির্বাণ মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৯ এপ্রিল ২০২৫ ০৮:৫৮
Share
Save

হাতিবাগান অথবা গড়িয়াহাট। ফুটপাত অথবা ছোট-বড় দোকান। চৈত্রে বৈচিত্র প্রায় লুপ্ত। কারণ একটাই— ‘সেল’। ইংরেজি এই শব্দটির বাংলা মানে ‘বিক্রয়’ হলেও, বাঙালির যাপনে এর ব্যঞ্জনা খানিক আলাদা। ‘সেল’ মানে নিছক ‘বিক্রয়’ নয় বঙ্গজীবনে। তার অনাভিধানিক অর্থ ‘কম দামে বিক্রি’। বাঙালির মুখের ভাষায় ‘সেল চলছে নাকি’-র অর্থ মোটেই বিক্রিবাটার খোঁজখবর নয়, সস্তায় কিছু পাওয়া যাচ্ছে কি না, তারই সুলুকসন্ধান। বছরের অন্য সময়ে যে ‘সেল’ চলে না, তা নয়। কিন্তু চৈত্র সেলের মধ্যে যে হরিহরছত্রের মেলা-মার্কা একটা ‘হোলসেল’ কিসিম লুকিয়ে রয়েছে, তাকে অস্বীকার করার উপায় নেই। দোলের রং গা থেকে ফিকে হতে না হতেই, রোদের তেজ বাড়তে শুরু করলেই বঙ্গাব্দের খোঁজ না রাখা বাঙালিও টের পান চৈত্র এসে গিয়েছে। মাসব্যাপী ‘তারকনাথের চরণে সেবা লাগে’ হাঁক ইদানীং শহর বা উপকণ্ঠে তেমন শ্রুত নয়। চৈত্রের অভিজ্ঞান বদলে গিয়েছে। ‘তপ্ত ধূলার পথে’ যখন ‘ঝরা ফুলের রথে’ মাধবীর সঙ্গ খোঁজেন ঋতুরাজ, মন খানিক উদাস হয়ে জানলা টপকিয়ে শেষ বসন্তের উদাসীনতাকে মেখে নিতে তৎপর, তখন কাক্কেশ্বর কুচকুচের মতো হেঁড়ে গলায় কারা যেন ঘোষণা করতে থাকেন— ‘সেল! সেল!!’ সব অভিজ্ঞানকে ছাপিয়ে বঙ্গজন বুঝে যান ‘মরি হায়, বসন্তের দিন চলে যায়’। ঝরাপাতাদের দলে এখন বিকিকিনির হাট। শহর, মফস্‌সল, গঞ্জ— একাকার সেই হাটে।

চৈত্র সেল নিয়ে বাঙালির আড্ডায় রটনা থেকে রসিকতা— কিছুরই অভাব নেই। নিন্দেমন্দপ্রেমী লোকজন অনেক সময়েই বলে থাকেন, চৈত্র সেলের বিক্রি হওয়া পণ্য নাকি আদৌ পুরনো স্টকের ‘মাল’ নয়। সেল উপলক্ষেই নাকি সেগুলি তৈরি করা হয়। আবার চৈত্র সেলে কিছু কিনতে গিয়ে ঠকেছেন, এমন বিষয় নিয়ে আত্মবিদ্রূপও অন্তহীন। বিধান সরণির এক প্রাচীন বস্ত্রবিপণির মুখপাত্র জানালেন, তাঁদের দোকানে চৈত্র সেলে যা বিক্রি হয়, তা একান্ত ভাবেই পুরনো ‘স্টক’। নতুন বছরে গুদামে পড়ে থাকা কাপড়-জামা বিক্রি করে ফেলাই দস্তুর, এমন এক সংস্কার বাঙালি ব্যবসায়ীদের রয়েছে। কিন্তু, প্রশ্ন এই, হাতিবাগান থেকে গড়িয়াহাট— সেলের জমজমাট বাজারে শুধু তো ছোটবড় দোকান নয়, ফুটপাতে ঢালাও বেসাতি চলে। সে সবও কি স্টক ক্লিয়ারেন্স? যদি তা-ই হয়ে থাকে, তবে কার? ফুটপাতে নিত্যদিন যাঁরা তাঁদের পণ্য নিয়ে বসেন, তাঁদের প্রায় দ্বিগুণ মানুষ এই এক মাস ফুটপাথ ছাপিয়ে নেমে পড়েন বড় রাস্তাতেও। কারা তাঁরা?

 অনলাইনে সেল সারা বছর।

অনলাইনে সেল সারা বছর। ছবি: সংগৃহীত।

হাতিবাগানের মোড়ের কাছাকাছি বারমুডা, নাইটি ইত্যাদি নিয়ে বসা আদিনাথ ঘোষ (নাম পরিবর্তিত) জানালেন, কোনও রকম স্টক নিঃশেষ করার ব্যাপার নয়, তিনি নিতান্তই আনকোরা পণ্য বিক্রি করেন এ সময়ে। শুধুমাত্র লাভের মার্জিন খানিক কম রাখেন। তা হলে বছরের বাকি সময়? আদিনাথবাবুর উত্তর, “অন্য কাজ করি বছরের বাকি মাসগুলোয়।” কথায় কথায় জানা গেল, তেমন কোনও নির্দিষ্ট জীবিকা নেই তাঁর। সারা বছর যখন যেমন কাজ জোটে, ফুরনে সে সব করেন। কেবল এই একটি মাস তিনি মনপ্রাণ দিয়ে চৈত্র সেলেই নিয়োজিত থাকেন। তাতে বচ্ছরকার খোরাকি না হোক, কয়েক মাসের সম্বল তো হয়!

বড় বিপণির সংলগ্ন ফুটপাতে সেই দোকানেরই পুরনো স্টক বিক্রি হওয়া চৈত্র সেলের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। সে ক্ষেত্রে তাকে ‘স্টক ক্লিয়ারেন্সের’-ই অঙ্গ বলে ধরা যায়। কিন্তু দোকান থাকতে ফুটপাতে কেন? সোদপুর থেকে হাতিবাগানের সেলে কেনাকাটা করতে এসেছেন কাকলি ভট্টাচার্য। তিনি জানালেন, সেলের বাজারের দমচাপা ভিড়ে অনেকেই দোকানে ঢুকতে চান না। তিনি নিজেও ফুটপাতেই বাজার সারেন। বড় দোকানের জিনিস ফুটপাতে নেমে এলে কি তার দাম আরও খানিকটা পকেটসই হয়? কাকলি একটু বিভ্রান্ত উত্তর দিতে গিয়ে। তবে ব্যস্ত বিপণির কর্মচারীদের হাবভাবে মনে হল, দোকানে বিক্রি হওয়া স্টক আর ফুটপাতে নেমে আসা কাপড়জামার গুণগত মানে ফারাক রয়েছে। সর্বত্র না হলেও অনেক জায়গাতেই বড় বিপণির একটু বেশি পুরনো স্টকই সম্ভবত নেমে আসে সংলগ্ন ফুটপাতে।

চৈত্র সেলে বিক্রি হওয়া পণ্যের মধ্যে যদিও জামাকাপড়ই প্রধান, তবু কাচের বাসন থেকে সাজের সরঞ্জাম— প্রায় সব কিছুই সেলের আওতায় এই এক মাস। সর্বত্রই কি স্টক ফাঁকা করার তাগিদ? না কি বছরের অন্য সময়ে দাম কিঞ্চিৎ বেশি রেখে চৈত্রে খানিক কম রেখে ছেড়ে দেন বিক্রেতারা? প্রশ্নের উত্তর দিতে চাইলেন না শ্যামবাজার পাঁচমাথার মোড় সংলগ্ন গান্ধী মার্কেটের তৈজস ব্যবসায়ীরা। ‘ট্রেড সিক্রেট?’ হবেও বা।

 হাতিবাগান হোক বা গড়িয়াহাট, চৈত্র সেলের আগ্রহের কেন্দ্র কিন্তু শাড়ি।

হাতিবাগান হোক বা গড়িয়াহাট, চৈত্র সেলের আগ্রহের কেন্দ্র কিন্তু শাড়ি। ছবি: সংগৃহীত।

সেল কি শুধুমাত্র চৈত্রেই? অনলাইন বিপণিগুলিতে চোখ রাখলে দেখা যাবে, সারা বছরই কিছু না কিছু উপলক্ষে সেখানে ‘সেল’ বহমান। ‘এন্ড অফ সিজ়ন’ সেখানে বর্ষা থেকে বসন্ত— যে কোনও সময়েই ঘটে। কোন সময়ে কোন ‘সিজ়ন’ যে শেষ হচ্ছে, বলা মুশকিল। শুধু ‘এন্ড অফ সিজ়ন’ নয়, স্বাধীনতা দিবস, প্রজাতন্ত্রের উপলক্ষ থেকে শুরু করে বিপণির জন্মমাস, সব কিছুতেই সেলের অনন্ত আনন্দধারা বহে নিরন্তর। বহু ওয়েবসাইটেই আবার ‘এন্ড অফ রিজ়ন’ সেলের বিষয়ে বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। সেটি যে কী বস্তু, বোঝা কঠিন। কোন ‘কারণান্তে’ এই হরির লুট, তা জানা না গেলেও অনলাইন ‘শপ্যাহলিক’রা জানেন, বিনা কারণে বাজার করার এ এক মওকা বটে! তার বাইরে দৈনিক ‘ফ্ল্যাশ সেল’ তো রয়েছেই, যেখানে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য পণ্যের দামের উপর ছাড় দেওয়া হয়। তবে অনলাইন বিপণিতে চৈত্র মাসেও দেদার সেল। বিশেষ করে এ বাংলার বিভিন্ন বিপণির অনলাইন সংস্করণে সেলের হাওয়ায় চৈত্রের অকালবৈশাখী।

অনলাইনের এই দাপটে কি বঙ্গের চৈত্র সেল কিছুটা হলেও কোণঠাসা? কাকলি জানালেন, তিনি অনলাইনেও কেনাকাটা করেন। তবু চৈত্র-বিকেলের পড়ন্ত আলোয় শ্যামবাজার-হাতিবাগান অথবা গড়িয়াহাটের ফুটপাতে ঘুরে বেড়ানোর একটা আলাদা আনন্দ তো রয়েছেই! একই মত গৃহবধূ অণিমা সাহারও। বারাসত থেকে উজিয়ে শুধুমাত্র সেল দেখতেই প্রতি বছর পাড়ি দেন উপরোক্ত সেল-মহাকুম্ভে। অনলাইনে তাঁত বা ছাপা শাড়ি তেমন মেলে না বা মিললেও তা হাতে নিয়ে পরখ করার সুযোগ থাকে না বলেই এই ভ্রমণ। বচ্ছরকার কেনাকাটা কি এই সেলেই সেরে রাখেন গৃহিণীরা? অণিমা জানালেন, পুজোর সময়ে তো কেনাকাটা হবেই। কিন্তু চৈত্রেই যদি পছন্দসই কিছু কিনে ফেলা যায়, তাকে পুজো পর্যন্ত আলমারিবন্দি করে রাখা কোনও ব্যাপারই নয়।

তা হলে চৈত্র সেল কি কোনও সমান্তরাল অর্থনীতির আভাস রাখে বাংলায়? কোনও আলাদা উৎপাদন…? প্রশ্ন রাখা হয়েছিল ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউটের অর্থনীতির প্রাক্তন অধ্যাপক অভিরূপ সরকারের কাছে। অভিরূপবাবু জানালেন, তিনি তেমন কিছু মনে করেন না। তাঁর মতে চৈত্র সেল একটা ‘রিচুয়াল’। তাঁর কথায়, “বাঙালির কেনাকাটা বিশেষ ভাবে উপলক্ষভিত্তিক। পুজো আর পয়লা বৈশাখের আগেই কেনাকাটা বাড়ে এ রাজ্যে।” আসলে পয়লা বৈশাখকে মাথায় রেখেই চৈত্র সেলের রমরমা, মনে করিয়ে দিলেন অভিরূপবাবু।

সেই সঙ্গে অভিরূপবাবু এ-ও জানালেন, চৈত্র সেল উপলক্ষে আলাদা করে যে পণ্য উৎপাদন করা হয়, তার কোনও প্রমাণ নেই। বড় দোকানের ক্ষেত্রে চৈত্রের এই বেসাতি ‘স্টক ক্লিয়ারেন্স’-ই। হালখাতার আগে পুরনো স্টক শেষ করার একটা তাগিদ থাকেই। তা যতখানি অর্থনৈতিক, ঠিক ততখানি সাংস্কৃতিক বা রেওয়াজ-ভিত্তিকও। অভিরূপবাবুর মতে, অন্য দিক থেকে দেখলে পুজোর কেনাকাটা উৎসব-ভিত্তিক। সে সময় খরচ নিয়ে বাঙালি বিশেষ ভাবে না। কিন্তু চৈত্র সেল অপেক্ষাকৃত কম খরচে কেনাকাটার সময়। অনলাইনের সঙ্গে এই মুহূর্তে কি চৈত্র সেল প্রতিযোগিতায়? অভিরূপবাবুর মত, খানিকটা হলেও প্রতিযোগিতা রয়েছে। তবে আজ অনলাইনও জানে, চৈত্র সেলের সঙ্গে তাকে খাপ খাইয়ে নিতে হবে। আসলে চৈত্র সেল অনেকটাই সমাজের কম সুবিধাপ্রাপ্ত শ্রেণির কাছে আজও আকর্ষণ ধরে রাখতে পেরেছে। অনেকেই অনলাইনের সঙ্গে সড়গড় নন। তাঁদের জন্য চৈত্রের ‘অফলাইন সেল’ই আজও স্বাচ্ছন্দ্যের জায়গা।

চৈত্রদিনের জীর্ণ পাতা ঝরার বেলায় ‘সেল’ নিছক বিকিকিনির হাট নয়। তা যেন এক সামাজিক উপচার। হাতিবাগান, গড়িয়াহাটের সমান্তরালে সোদপুরের বড় বিপণির সামনের রাস্তাও জমজমাট। সোনারপুর থেকে ইছাপুর, কাঁথি থেকে শিলিগুড়ি— বাংলা নববর্ষের আগে চৈত্র সেল যেন আসন্ন বছরের কেনাকাটার মহড়া। অনলাইন, কি অফলাইন, সেল চলছে চলবে।

সংক্ষেপে
  • পয়লা বৈশাখ মানেই বাঙালির বাঙালিত্বের উদ্‌যাপন। সাদা-লাল শাড়ির ফ্যাশন, বাঙালি খাওয়া-দাওয়া, হালখাতা— এই সবই জাগিয়ে তোলে বাঙালির স্মৃতিমেদুরতাকে।
  • বছর ঘুরে আবার আসছে বাংলার নববর্ষ। ১৪৩২ আরও অনেক নতুন কিছু নিয়ে আসবে। নববর্ষকে কী ভাবে স্বাগত জানাবে বাঙালি? তারই হাল হদিস।
Chaitra Sale Bengali Economy

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

এটি একটি প্রিন্ট আর্টিক্‌ল…

  • এমন অনেক খবরই এখন আপনার হাতের মুঠোয়

  • সঙ্গে রোজ পান আনন্দবাজার পত্রিকার নতুন ই-পেপার পড়ার সুযোগ

  • ই-পেপারের খবর এখন শুধুই ছবিতে নয়, টেক্সটেও

প্ল্যান সিলেক্ট করুন

মেয়াদ শেষে নতুন দামে আপনাকে নতুন করে গ্রাহক হতে হবে

Best Value
এক বছরে

৫১৪৮

১৯৯৯

এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।
*মান্থলি প্ল্যান সাপেক্ষে
এক মাসে

৪২৯

১৬৯

এক মাস পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।